মাহমুদা ডলি
এক সময়কার উন্মুক্ত খেলার মাঠ, শিশুদের হাসি-আনন্দের কেন্দ্র আর তরুণ খেলোয়াড় তৈরির আঁতুড়ঘর ছিল আবাহনী ও শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব মাঠ। ধানমন্ডির এ মাঠ দুটি আজ সাধারণ মানুষের হাতছাড়া হয়ে গেছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মাঠগুলো একে একে বেসরকারিকরণ, অবৈধ দখল ও ব্যবসায়িক কমপ্লেক্সে পরিণত হয়। রাজনীতির প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মাঠের জায়গা দখল করে ক্যাসিনো, জুয়ার আসর এবং শতকোটি টাকায় স্থায়ী সদস্যপদ বিক্রির মাধ্যমে গড়ে তোলেন দুর্নীতির সাম্রাজ্য।
আবাহনী ক্লাব মাঠ এক সময় শেখ কামাল ক্লাব হিসেবে পরিচিত ছিল। সেখানে এখন দোতলা সুপার কমপ্লেক্স। রয়েছে সুইমিংপুল, ব্যায়ামাগার, বাস্কেটবল কোর্ট, দোকান ও ক্যাসিনো। মাঠের অর্ধেকের বেশি এলাকা ঘিরে ফেলা হয়েছে লোহার ব্যারিকেড দিয়ে। মাঠে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে শুধু অর্থের বিনিময়ে প্রবেশাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৎকালীন বাণিজ্য উপদেষ্টা এবং আবাহনী ক্লাবের সাবেক বোর্ড চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান মাঠটির বাণিজ্যিক রূপান্তরের পেছনের মূল ক্রীড়ানক। তার সঙ্গে ছিলেন ধানমন্ডি মাঠের বোর্ড অব ডিরেক্টর ‘শেখ জামাল ক্লাব’-এর লেফট্যানেন্ট মনজুর কাদের। তিনি মরহুম শেখ জামালের বন্ধু। তারা দুজনই দুটি মাঠকে নিজস্ব কোম্পানি বানিয়ে রেখে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করেছেন।
সালমান এফ রহমান চীনা প্রতিষ্ঠান সিকেজিই রিয়েল এস্টেটের মাধ্যমে স্থাপনা নির্মাণের কাজ শুরু করেন এবং স্থানীয় লোকদের প্রবেশাধিকার বন্ধ করে ‘আজীবন সদস্যপদ’ বিক্রি করেন কোটি টাকা মূল্যে। শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ কামালের জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মারক বা স্যুভেনির আকারে এই সদস্যপদ বিক্রির মাধ্যমে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে বলে জানা গেছে। জানা গেছে, আবাহনী মাঠে সুপার কমপ্লেক্স নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০২২ সালে। ২০২৫ সালের ৫ আগস্ট কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তবে এর আগেই অবৈধ স্থাপনাটির কাজ প্রায় ৬০ ভাগ শেষ হয়েছিল। এরপর থেকে চীনা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ করা নিরাপত্তারক্ষীরা স্থাপনাটি পাহারা দিচ্ছেন।
আবাহনী মাঠকে শেখ কামাল ক্লাবের নামে ক্যাসিনো বানিয়ে রেখেছিলেন ‘দরবেশ’ হিসেবে কুখ্যাত সালমান এফ রহমান। টাকার বিনিময়ে স্থানীয় ধনাঢ্য ব্যক্তিদের খেলাধুলার সুযোগ দেওয়া হতো । স্থানীয় জনসাধারণের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে মাঠের অর্ধেক দখল করে সীমানা প্রাচীর তৈরি করে গড়ে তোলা হয় সুপার কমপ্লেক্স। দুই তলাবিশিষ্ট সুপার কমপ্লেক্সে সুইমিংপুল, ব্যায়ামাগার ও বাস্কেটবল, ক্যাসিনো এবং ২০টি দোকানঘর নির্মাণ করা হয়।
প্রশাসনের নীরবতা
আবাহনী ক্লাবের ম্যানেজার ও সাবেক ফুটবলার সত্যজিৎ দাস রুপুর নাম উঠে এসেছে এই ‘মাঠ বাণিজ্যে’। তবে নিজের দায় মানতে নারাজ তিনি। বোর্ডের ওপর দোষ চাপালেও মাঠ কর্মচারীদের দাবি, সত্যজিৎ দাসই নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগ করেছেন এবং সালমান এফ রহমানের অবৈধ স্থাপনা রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। চীনা প্রতিষ্ঠানের সুপারভাইজার শাহীন মিয়ার বক্তব্যেও এর সত্যতা পাওয়া গেছে।
অভিযোগের বিষয়ে বাফুফের সদস্য ও আবাহনী লিমিটেডের ম্যানেজার সত্যজিৎ দাস রুপু বলেন, ‘আমি কোনো পাহারাদার বসাইনি, যা কিছু করছেন তা বোর্ডের পরিচালকরা করছেন। তারা সব জানেন। আমি কিছুই জানি না।’
মাঠের দীর্ঘদিনের স্টাফ এমনকি নিরাপত্তা প্রহরীরাও বলেছেন রুপু দাদা আমাদের এখানে নিয়োগ দিয়েছেন- এমন অভিযোগের জবাবে রুপু বলেন, ‘আপনার সঙ্গে আমি এসব নিয়ে কোনো কথাই বলব না। যদি কিছু জানতে চান তাহলে বর্তমানে এ সবকিছুর তত্ত্বাবধানে থাকা স্কয়ার গ্রুপের অঞ্জন চৌধুরীসহ অন্য ডিরেক্টরদের কাছে থেকে জেনে নিন।’
সরেজমিন দেখা যায়, আবহানী মাঠের অর্ধেকের বেশি জায়গাজুড়ে স্থাপনার জন্য লোহার জালের ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে। বাকি মাঠের মধ্যে এক পাশে মাঠের প্রশাসনিক ভবন এবং আরেক পাশে স্টাফদের বাসা।
স্থাপনা পাহারা দেওয়ার দায়িত্বে থাকা চীনা কোম্পানির সুপারভাইজার শাহীন মিয়া আমার দেশকে বলেন, ‘৫ আগস্টের পর থেকে এসব স্থাপনা এমনিভাবেই পড়েছিল। কয়েকদিন আগে রুপু দাদা লুট হওয়ার ভয়ে এখানে সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ দিয়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘২০২২ সালে নির্মাণকাজ শুরুর পর সালমান এফ রহমানের কাছে চীনা প্রতিষ্ঠানটির ৩৫ কোটি টাকা বিল পাওনা রয়েছে। এখন কাজ বন্ধ থাকায় তারা স্থাপনাটি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য পাহারা দিয়ে রেখেছে। বর্তমানে যেখানে আবাহনী মাঠের স্থাপনা রয়েছে, মূলত ওই জায়গায়ই ছিল প্রশাসনিক ভবন। রুপুর সাহায্যে তা সরিয়ে অন্য প্রান্তে নেওয়া হয়। এমনকি মাঠ সম্পূর্ণভাবে জনসাধারণের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়।’
মাঠে খেলতে ফি লাগে এক কোটি টাকা
সালমান এফ রহমান সুপার কমপ্লেক্স তৈরির কাজ শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই সদস্য ফরমের নামে স্যুভেনির তৈরি করে তা বিক্রি করেন কয়েকশ’ কোটি টাকায়। শেখ কামালের জন্মদিন বা মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে স্যুভেনির তৈরি করতেন। মাঠে আজীবন খেলার সুবিধা পেতে কথিত আজীবন সদস্যপদ পেতে একটি স্যুভেনির এক কোটি টাকায় কিনতে হতো। ২০২২ সালের আগে থেকে সুপার কমপ্লেক্সে সব সুবিধা পেতে এক কোটি টাকা দামে পদ বিক্রি করেছেন। একটি স্যুভেনির পাওয়া মানে এক কোটি টাকা জমা। সুপার কমেপ্লেক্সের ভেতরে বাস্কেটবল, সুইমিংপুল আর ক্রিকেট খেলার মাঠ ব্যবহার করার জন্য এলাকাবাসীর কাছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার স্যুভেনির বিক্রি করেন গত পাঁচ বছরে।
আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে অবৈধ দখল শেখ জামাল ক্লাবের
ধানমন্ডি ক্লাব নামে পরিচিত মাঠটি ২০১০ সালে দখল নেন শেখ জামালের বন্ধু লেফটেন্যান্ট মনজুর কাদের। পরে ক্লাবের নাম পরিবর্তন করে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব লিমিটেড করেন এবং সেখানে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ শুরু করেন। মাঠটিতে বছরের পর বছর ধরে ক্যাসিনো ও জুয়ার আসর চালানো হয়। ২০১১ সালে হাইকোর্ট মাঠটি উন্মুক্ত রাখার নির্দেশ দিলেও তা কার্যকর হয়নি। বরং ক্লাব কর্তৃপক্ষ মাঠ অবরুদ্ধ করে নিরাপত্তারক্ষী বসিয়ে দেয়।
আদালতের নির্দেশনা না মেনে ধানমন্ডি মাঠকে ক্লাব বা শেখ জামাল ক্লাব লিমিটেড নাম দিয়ে বেআইনি দখলদার মাঠ উন্নয়নের নামে অধিকারবহির্ভূত ও স্বঘোষিত কার্যকলাপ চালিয়ে আসছিল। সেখানে বছরের পর বছর চলে ক্যাসিনো ও জুয়ার আসর। এমনকি ধানমন্ডি মাঠ অবরুদ্ধ করে ফটকে পাহারাদার বসিয়েছিল ক্লাব কর্তৃপক্ষ।
আদালত এই মাঠ সবার জন্য উন্মুক্ত রাখতে রাজউক ও সিটি করপোরেশনকে নির্দেশ দেয়। কিন্তু সিটি করপোরশেন, গণপূর্তসহ প্রশাসন নির্বিকার ছিল। তাদের নীরবতা দখলদারদের সমর্থন জুগিয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
ধানমন্ডি মাঠে স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ ও সবার প্রবেশাধিকার দাবিতে ২০১৪ সালের ১১ এপ্রিল ৫০টি সংগঠনের সমন্বয়ে আন্দোলন হয়। আন্দোলনকারীরা তখন মাঠে ঢুকে পড়েন। ওই ঘটনায় অবৈধ দখলদার লেফটেন্যান্ট কাদেরের হয়ে ‘ধানমন্ডি ক্লাব কর্তৃপক্ষ’ চারজনের নামসহ অজ্ঞাত ২০০ জনকে আসামি করে ‘অবৈধ প্রবেশের’ অভিযোগে মামলা করে।
শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব লিমিটেডের ম্যানেজার টিপু সুলতান মাহমুদ দৈনিক আমার দেশকে বলেন, যেসব স্থাপনা তৈরি হয়েছে সেগুলো সেভাবেই রয়েছে। তবে স্থানীয় জনগণের জন্য মাঠ এখনো উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। টিপু সুলতান বলেন, এখন ধানমন্ডি সোসাইটি ক্লাবটিকে চালাচ্ছে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে লেফটেন্যান্ট মনজুর কাদের পলাতক রয়েছেন বলেও জানান তিনি।
নামের পেছনে রাজনীতি, ব্যবসার আড়ালে দখল
ক্লাবগুলোর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু ট্রাস্টের’ অনুমতি নিয়ে শেখ জামালের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন গণমাধ্যমকে বলেন, ট্রাস্টের নিয়ম অনুযায়ী কোনো ব্যবসায়িক কাজে বঙ্গবন্ধু পরিবারের নাম ব্যবহার নিষিদ্ধ।
২০১৪ সালের ১১ এপ্রিল বাপা ও অন্যান্য সংগঠন মাঠ উন্মুক্ত রাখার দাবিতে আন্দোলন করলে ক্লাব কর্তৃপক্ষ আন্দোলনকারীদের নামে মামলা করে। আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও সিটি করপোরেশন, রাজউক ও গণপূর্ত বিভাগ নির্বিকার থাকে।
ওই সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার হয় বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিনসহ অন্যদের বক্তব্য। গণমাধ্যমগুলোয় আবদুল মতিন বলেন, ব্যবসায়িক কারণে ধানমন্ডি মাঠ দখল হয়েছে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যের নাম (শেখ জামাল) ব্যবহার করা হয়েছে। ক্লাব কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, তারা বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট থেকে এই নাম ব্যবহারের অনুমতি নিয়েছে। তবে ট্রাস্টের আইনে কোনো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু পরিবারের কারো নাম ব্যবহারের অনুমতি নেই।
২০১১ সালের ১৫ মার্চ হাইকোর্ট মাঠ রক্ষায় চূড়ান্ত আদেশ দেয়। হাইকোর্ট অপ্রয়োজনীয় সব অবৈধ স্থাপনা ১৫ দিনের মধ্যে অপসারণ করে সবার জন্য মাঠ উন্মুক্ত রাখতে ঢাকা সিটি করপোরেশন, রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে আদেশও দেয়। হাইকোর্টের ওই রায় বাস্তবায়নে সক্ষমতা নেই জানিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন তখন আপিল করে।
মাঠ দুটি এখনো দুর্নীতির আখড়া
স্থানীয় বান্দিদাদের দাবি, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগেই ধানমন্ডির দুটি মাঠ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সেখানে ক্যাসিনো, ক্লাব কমপ্লেক্স আর স্থায়ী সদস্যপদ বিক্রির মাধ্যমে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করা হয়। এজন্য গড়ে তোলা হয় সুগঠিত চক্র। আদালতের রায় উপেক্ষা করে, প্রশাসনের নীরবতা কাজে লাগিয়ে এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব খাটিয়ে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা গড়ে তোলা হয় মাঠগুলো ঘিরে। এখন মাঠগুলো আর কোনো শিশুর হাসি, তরুণের ক্রীড়া চাঞ্চল্য কিংবা সাধারণের অবাধ প্রবেশের প্রতীক নয়; এগুলো এখন ক্ষমতা ও লোভের বেদখল ইতিহাস।
এক সময়কার উন্মুক্ত খেলার মাঠ, শিশুদের হাসি-আনন্দের কেন্দ্র আর তরুণ খেলোয়াড় তৈরির আঁতুড়ঘর ছিল আবাহনী ও শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব মাঠ। ধানমন্ডির এ মাঠ দুটি আজ সাধারণ মানুষের হাতছাড়া হয়ে গেছে। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় মাঠগুলো একে একে বেসরকারিকরণ, অবৈধ দখল ও ব্যবসায়িক কমপ্লেক্সে পরিণত হয়। রাজনীতির প্রভাবশালী ব্যক্তিরা মাঠের জায়গা দখল করে ক্যাসিনো, জুয়ার আসর এবং শতকোটি টাকায় স্থায়ী সদস্যপদ বিক্রির মাধ্যমে গড়ে তোলেন দুর্নীতির সাম্রাজ্য।
আবাহনী ক্লাব মাঠ এক সময় শেখ কামাল ক্লাব হিসেবে পরিচিত ছিল। সেখানে এখন দোতলা সুপার কমপ্লেক্স। রয়েছে সুইমিংপুল, ব্যায়ামাগার, বাস্কেটবল কোর্ট, দোকান ও ক্যাসিনো। মাঠের অর্ধেকের বেশি এলাকা ঘিরে ফেলা হয়েছে লোহার ব্যারিকেড দিয়ে। মাঠে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে শুধু অর্থের বিনিময়ে প্রবেশাধিকার দেওয়া হচ্ছে।
পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৎকালীন বাণিজ্য উপদেষ্টা এবং আবাহনী ক্লাবের সাবেক বোর্ড চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান মাঠটির বাণিজ্যিক রূপান্তরের পেছনের মূল ক্রীড়ানক। তার সঙ্গে ছিলেন ধানমন্ডি মাঠের বোর্ড অব ডিরেক্টর ‘শেখ জামাল ক্লাব’-এর লেফট্যানেন্ট মনজুর কাদের। তিনি মরহুম শেখ জামালের বন্ধু। তারা দুজনই দুটি মাঠকে নিজস্ব কোম্পানি বানিয়ে রেখে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করেছেন।
সালমান এফ রহমান চীনা প্রতিষ্ঠান সিকেজিই রিয়েল এস্টেটের মাধ্যমে স্থাপনা নির্মাণের কাজ শুরু করেন এবং স্থানীয় লোকদের প্রবেশাধিকার বন্ধ করে ‘আজীবন সদস্যপদ’ বিক্রি করেন কোটি টাকা মূল্যে। শেখ মুজিবুর রহমানের বড় ছেলে শেখ কামালের জন্ম বা মৃত্যুবার্ষিকীতে স্মারক বা স্যুভেনির আকারে এই সদস্যপদ বিক্রির মাধ্যমে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে বলে জানা গেছে। জানা গেছে, আবাহনী মাঠে সুপার কমপ্লেক্স নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০২২ সালে। ২০২৫ সালের ৫ আগস্ট কাজ বন্ধ হয়ে যায়। তবে এর আগেই অবৈধ স্থাপনাটির কাজ প্রায় ৬০ ভাগ শেষ হয়েছিল। এরপর থেকে চীনা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ করা নিরাপত্তারক্ষীরা স্থাপনাটি পাহারা দিচ্ছেন।
আবাহনী মাঠকে শেখ কামাল ক্লাবের নামে ক্যাসিনো বানিয়ে রেখেছিলেন ‘দরবেশ’ হিসেবে কুখ্যাত সালমান এফ রহমান। টাকার বিনিময়ে স্থানীয় ধনাঢ্য ব্যক্তিদের খেলাধুলার সুযোগ দেওয়া হতো । স্থানীয় জনসাধারণের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করে মাঠের অর্ধেক দখল করে সীমানা প্রাচীর তৈরি করে গড়ে তোলা হয় সুপার কমপ্লেক্স। দুই তলাবিশিষ্ট সুপার কমপ্লেক্সে সুইমিংপুল, ব্যায়ামাগার ও বাস্কেটবল, ক্যাসিনো এবং ২০টি দোকানঘর নির্মাণ করা হয়।
প্রশাসনের নীরবতা
আবাহনী ক্লাবের ম্যানেজার ও সাবেক ফুটবলার সত্যজিৎ দাস রুপুর নাম উঠে এসেছে এই ‘মাঠ বাণিজ্যে’। তবে নিজের দায় মানতে নারাজ তিনি। বোর্ডের ওপর দোষ চাপালেও মাঠ কর্মচারীদের দাবি, সত্যজিৎ দাসই নিরাপত্তারক্ষী নিয়োগ করেছেন এবং সালমান এফ রহমানের অবৈধ স্থাপনা রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। চীনা প্রতিষ্ঠানের সুপারভাইজার শাহীন মিয়ার বক্তব্যেও এর সত্যতা পাওয়া গেছে।
অভিযোগের বিষয়ে বাফুফের সদস্য ও আবাহনী লিমিটেডের ম্যানেজার সত্যজিৎ দাস রুপু বলেন, ‘আমি কোনো পাহারাদার বসাইনি, যা কিছু করছেন তা বোর্ডের পরিচালকরা করছেন। তারা সব জানেন। আমি কিছুই জানি না।’
মাঠের দীর্ঘদিনের স্টাফ এমনকি নিরাপত্তা প্রহরীরাও বলেছেন রুপু দাদা আমাদের এখানে নিয়োগ দিয়েছেন- এমন অভিযোগের জবাবে রুপু বলেন, ‘আপনার সঙ্গে আমি এসব নিয়ে কোনো কথাই বলব না। যদি কিছু জানতে চান তাহলে বর্তমানে এ সবকিছুর তত্ত্বাবধানে থাকা স্কয়ার গ্রুপের অঞ্জন চৌধুরীসহ অন্য ডিরেক্টরদের কাছে থেকে জেনে নিন।’
সরেজমিন দেখা যায়, আবহানী মাঠের অর্ধেকের বেশি জায়গাজুড়ে স্থাপনার জন্য লোহার জালের ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে। বাকি মাঠের মধ্যে এক পাশে মাঠের প্রশাসনিক ভবন এবং আরেক পাশে স্টাফদের বাসা।
স্থাপনা পাহারা দেওয়ার দায়িত্বে থাকা চীনা কোম্পানির সুপারভাইজার শাহীন মিয়া আমার দেশকে বলেন, ‘৫ আগস্টের পর থেকে এসব স্থাপনা এমনিভাবেই পড়েছিল। কয়েকদিন আগে রুপু দাদা লুট হওয়ার ভয়ে এখানে সিকিউরিটি গার্ড নিয়োগ দিয়েছেন।’ তিনি বলেন, ‘২০২২ সালে নির্মাণকাজ শুরুর পর সালমান এফ রহমানের কাছে চীনা প্রতিষ্ঠানটির ৩৫ কোটি টাকা বিল পাওনা রয়েছে। এখন কাজ বন্ধ থাকায় তারা স্থাপনাটি যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেজন্য পাহারা দিয়ে রেখেছে। বর্তমানে যেখানে আবাহনী মাঠের স্থাপনা রয়েছে, মূলত ওই জায়গায়ই ছিল প্রশাসনিক ভবন। রুপুর সাহায্যে তা সরিয়ে অন্য প্রান্তে নেওয়া হয়। এমনকি মাঠ সম্পূর্ণভাবে জনসাধারণের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়।’
মাঠে খেলতে ফি লাগে এক কোটি টাকা
সালমান এফ রহমান সুপার কমপ্লেক্স তৈরির কাজ শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই সদস্য ফরমের নামে স্যুভেনির তৈরি করে তা বিক্রি করেন কয়েকশ’ কোটি টাকায়। শেখ কামালের জন্মদিন বা মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে স্যুভেনির তৈরি করতেন। মাঠে আজীবন খেলার সুবিধা পেতে কথিত আজীবন সদস্যপদ পেতে একটি স্যুভেনির এক কোটি টাকায় কিনতে হতো। ২০২২ সালের আগে থেকে সুপার কমপ্লেক্সে সব সুবিধা পেতে এক কোটি টাকা দামে পদ বিক্রি করেছেন। একটি স্যুভেনির পাওয়া মানে এক কোটি টাকা জমা। সুপার কমেপ্লেক্সের ভেতরে বাস্কেটবল, সুইমিংপুল আর ক্রিকেট খেলার মাঠ ব্যবহার করার জন্য এলাকাবাসীর কাছে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার স্যুভেনির বিক্রি করেন গত পাঁচ বছরে।
আদালতের নির্দেশ উপেক্ষা করে অবৈধ দখল শেখ জামাল ক্লাবের
ধানমন্ডি ক্লাব নামে পরিচিত মাঠটি ২০১০ সালে দখল নেন শেখ জামালের বন্ধু লেফটেন্যান্ট মনজুর কাদের। পরে ক্লাবের নাম পরিবর্তন করে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব লিমিটেড করেন এবং সেখানে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ শুরু করেন। মাঠটিতে বছরের পর বছর ধরে ক্যাসিনো ও জুয়ার আসর চালানো হয়। ২০১১ সালে হাইকোর্ট মাঠটি উন্মুক্ত রাখার নির্দেশ দিলেও তা কার্যকর হয়নি। বরং ক্লাব কর্তৃপক্ষ মাঠ অবরুদ্ধ করে নিরাপত্তারক্ষী বসিয়ে দেয়।
আদালতের নির্দেশনা না মেনে ধানমন্ডি মাঠকে ক্লাব বা শেখ জামাল ক্লাব লিমিটেড নাম দিয়ে বেআইনি দখলদার মাঠ উন্নয়নের নামে অধিকারবহির্ভূত ও স্বঘোষিত কার্যকলাপ চালিয়ে আসছিল। সেখানে বছরের পর বছর চলে ক্যাসিনো ও জুয়ার আসর। এমনকি ধানমন্ডি মাঠ অবরুদ্ধ করে ফটকে পাহারাদার বসিয়েছিল ক্লাব কর্তৃপক্ষ।
আদালত এই মাঠ সবার জন্য উন্মুক্ত রাখতে রাজউক ও সিটি করপোরেশনকে নির্দেশ দেয়। কিন্তু সিটি করপোরশেন, গণপূর্তসহ প্রশাসন নির্বিকার ছিল। তাদের নীরবতা দখলদারদের সমর্থন জুগিয়েছে বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
ধানমন্ডি মাঠে স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ ও সবার প্রবেশাধিকার দাবিতে ২০১৪ সালের ১১ এপ্রিল ৫০টি সংগঠনের সমন্বয়ে আন্দোলন হয়। আন্দোলনকারীরা তখন মাঠে ঢুকে পড়েন। ওই ঘটনায় অবৈধ দখলদার লেফটেন্যান্ট কাদেরের হয়ে ‘ধানমন্ডি ক্লাব কর্তৃপক্ষ’ চারজনের নামসহ অজ্ঞাত ২০০ জনকে আসামি করে ‘অবৈধ প্রবেশের’ অভিযোগে মামলা করে।
শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব লিমিটেডের ম্যানেজার টিপু সুলতান মাহমুদ দৈনিক আমার দেশকে বলেন, যেসব স্থাপনা তৈরি হয়েছে সেগুলো সেভাবেই রয়েছে। তবে স্থানীয় জনগণের জন্য মাঠ এখনো উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। টিপু সুলতান বলেন, এখন ধানমন্ডি সোসাইটি ক্লাবটিকে চালাচ্ছে। গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে লেফটেন্যান্ট মনজুর কাদের পলাতক রয়েছেন বলেও জানান তিনি।
নামের পেছনে রাজনীতি, ব্যবসার আড়ালে দখল
ক্লাবগুলোর পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, ‘বঙ্গবন্ধু ট্রাস্টের’ অনুমতি নিয়ে শেখ জামালের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন গণমাধ্যমকে বলেন, ট্রাস্টের নিয়ম অনুযায়ী কোনো ব্যবসায়িক কাজে বঙ্গবন্ধু পরিবারের নাম ব্যবহার নিষিদ্ধ।
২০১৪ সালের ১১ এপ্রিল বাপা ও অন্যান্য সংগঠন মাঠ উন্মুক্ত রাখার দাবিতে আন্দোলন করলে ক্লাব কর্তৃপক্ষ আন্দোলনকারীদের নামে মামলা করে। আদালতের নির্দেশ সত্ত্বেও সিটি করপোরেশন, রাজউক ও গণপূর্ত বিভাগ নির্বিকার থাকে।
ওই সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার হয় বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিনসহ অন্যদের বক্তব্য। গণমাধ্যমগুলোয় আবদুল মতিন বলেন, ব্যবসায়িক কারণে ধানমন্ডি মাঠ দখল হয়েছে। সেখানে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যের নাম (শেখ জামাল) ব্যবহার করা হয়েছে। ক্লাব কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, তারা বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট থেকে এই নাম ব্যবহারের অনুমতি নিয়েছে। তবে ট্রাস্টের আইনে কোনো ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু পরিবারের কারো নাম ব্যবহারের অনুমতি নেই।
২০১১ সালের ১৫ মার্চ হাইকোর্ট মাঠ রক্ষায় চূড়ান্ত আদেশ দেয়। হাইকোর্ট অপ্রয়োজনীয় সব অবৈধ স্থাপনা ১৫ দিনের মধ্যে অপসারণ করে সবার জন্য মাঠ উন্মুক্ত রাখতে ঢাকা সিটি করপোরেশন, রাজউকসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষকে আদেশও দেয়। হাইকোর্টের ওই রায় বাস্তবায়নে সক্ষমতা নেই জানিয়ে ঢাকা সিটি করপোরেশন তখন আপিল করে।
মাঠ দুটি এখনো দুর্নীতির আখড়া
স্থানীয় বান্দিদাদের দাবি, আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগেই ধানমন্ডির দুটি মাঠ সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে সেখানে ক্যাসিনো, ক্লাব কমপ্লেক্স আর স্থায়ী সদস্যপদ বিক্রির মাধ্যমে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করা হয়। এজন্য গড়ে তোলা হয় সুগঠিত চক্র। আদালতের রায় উপেক্ষা করে, প্রশাসনের নীরবতা কাজে লাগিয়ে এবং ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব খাটিয়ে হাজার কোটি টাকার ব্যবসা গড়ে তোলা হয় মাঠগুলো ঘিরে। এখন মাঠগুলো আর কোনো শিশুর হাসি, তরুণের ক্রীড়া চাঞ্চল্য কিংবা সাধারণের অবাধ প্রবেশের প্রতীক নয়; এগুলো এখন ক্ষমতা ও লোভের বেদখল ইতিহাস।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে বিভিন্ন মেরূকরণ। এ নির্বাচনে কোন দল ক্ষমতায় আসবে, কোন দল কার সঙ্গে সমঝোতা বা জোট করে ভোট করবেÑএসব বিষয় নিয়ে আলোচনা ও তৎপরতাও জোরদার হচ্ছে। বিশেষ করে ইসলামি দলগুলোকে নিয়ে সাধারণ ভোটারদের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মহলে বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
৭ ঘণ্টা আগেনীলের দেশখ্যাত নীলফামারী দীর্ঘদিন শোষণ করেছিল ইংরেজরা। তাদের স্থানীয় নিপীড়ক নীলকরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিলেন উত্তরের এই জেলার চাষিরা। ২০০ বছর পর সেই নিষ্ঠুর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করেন আওয়ামী ‘কসাই’খ্যাত আসাদুজ্জামান নূর।
১১ ঘণ্টা আগেআগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় জেলা প্রশাসকদেরই (ডিসি) রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ হিসেবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার দুজন বিভাগীয় কমিশনার এবং ৬৪ জন ডিসিসহ ৬৬ জন রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে।
১ দিন আগেবছরের প্রায় ১০ মাস পার হলেও মাধ্যমিক স্তরের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ শুরু হয়নি। এমনকি পাঠ্যবইয়ের কনটেন্টও পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি; এখনো চলছে পরিবর্তন-পরিমার্জনের কাজ। এছাড়া ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনও মেলেনি এখনো।
১ দিন আগে