মন্তব্য প্রতিবেদন

২০২৫ হোক সংস্কার শেষে গণতন্ত্রে অভিযাত্রার বছর

প্রকাশ : ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮: ৪৮
আপডেট : ০১ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮: ৫২

সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সচেতন পাঠক নিশ্চয়ই বলে উঠবেন, শিরোনামের সঙ্গে তো মিলল না। আমি বুঝেশুনেই লেখার শিরোনামে সংস্কার সম্পন্নের কথা বলে প্রথম বাক্যেই স্মরণ করিয়ে দিয়েছি যে, সংস্কারকে চলমান রাখতে হয়। আমার শিরোনামের লক্ষ্য একপক্ষ আর প্রথম বাক্য লিখেছি অন্যপক্ষের উদ্দেশে। শিরোনামে ড. ইউনূস সরকারকে সতর্ক করেছি, ২০২৫ সালের মধ্যে তাদের প্রয়োজনীয় সংস্কার সম্পন্ন করে প্রতিশ্রুত নির্বাচনের সব আয়োজন শুরু করে দিতে হবে। আগামী বছরের মধ্যেই জনগণ এক অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে তাদের পছন্দের সরকার বেছে নেওয়ার প্রত্যাশা করছে। সেই অনাগত গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকেও যে জনগণের কল্যাণে সংস্কার কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে, সে কথাটাই শুধু আমি প্রথম বাক্যে বলতে চেয়েছি।

অনেক প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত ফ্যাসিবাদ-পরবর্তী সরকার ক্ষমতায় এসে ডজনখানেক সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে। একসঙ্গে এত সংস্কার এই মুহূর্তে দরকার ছিল কি নাÑ এ নিয়ে নানা রকম বিতর্ক থাকলেও, ড. ইউনূস কাজ যখন হাতে নিয়েছেন, সেগুলো ফেলে রেখে যেতে পারবেন না। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক, উভয় পরিমণ্ডলে তার কাছে প্রত্যাশা যুক্তিসংগতভাবেই বেশি। কিছু সংস্কার একেবারে শেষ করতে না পারলেও অন্তত একটা বাস্তবসম্মত রূপরেখা অবশ্যই দিয়ে যেতে হবে। যেমন ধরুন সংবিধান সংস্কার। যেহেতু বর্তমান সরকার প্রথাগতভাবে নির্বাচিত নয়, তাই পুরোনো সংবিধানের জঞ্জাল পরিষ্কার কিংবা নতুন সংবিধান প্রণয়ন, এর কোনোটা সম্পাদনেরই বৈধতা তার নেই। তবে জন-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে এমন একটি সংবিধানের একটা রূপরেখা তারা অবশ্যই নির্বাচিত সংসদের বিবেচনার জন্য রেখে যেতে পারেন।

বিজ্ঞাপন

আমি মনে করি, বাংলাদেশে ব্রিটেনের ওয়েস্টমিনস্টার ধাঁচের গণতন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে। সেই পদ্ধতির দুর্বলতা ব্যবহার করেই শেখ হাসিনার মতো এক ভয়ানক দুর্বৃত্ত, দিল্লির মদতে বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছিল। ভবিষ্যতে গণতন্ত্রের লেবাসে কোনো ভয়ংকর ব্যক্তি, পরিবার ও গোষ্ঠীতান্ত্রিক ফ্যাসিস্ট শাসন কায়েমের সুযোগ আমাদের যথাসম্ভব আটকাতে হবে। নতুন বন্দোবস্তে এ দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ফ্রান্সের সরকারের আদলে একটি ভারসাম্যমূলক রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার হতে পারে। পাঁচ বছর মেয়াদি সেই রাষ্ট্রপতি দুবারের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারবেন না। শুধু রাষ্ট্রপতি নয়, তিনি রাষ্ট্রের কোনো দায়িত্বই আর নিতে পারবেন না। না হলে দেখা যাবে, রাশিয়ার পুতিনের মতো তিনি একবার রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন, আবার পরবর্তী মেয়াদে ক্ষমতাহীন এক রাষ্ট্রপতি বানিয়ে নিজে একচ্ছত্র ক্ষমতাসম্পন্ন প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন। ঘুরেফিরে সব ক্ষমতা তার কাছেই থেকে যাচ্ছে। ভারতে পলাতক ফ্যাসিস্ট হাসিনার পিতা, বাংলাদেশের প্রথম স্বৈরাচার শেখ মুজিবও পুতিনের মতো একই দুষ্কর্ম করেছিলেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের বন্দিশালা থেকে মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিব রাষ্ট্রপতি রূপে বাংলাদেশে এসেই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খায়েস জানালেন। তারপর তিন বছর পার না হতেই তার আবার রাষ্ট্রপতি হওয়ার ইচ্ছা জাগল। ১৯৭৫ সালের জানুয়ারির ২৫ তারিখে সংসদে পাঁচ মিনিটের মধ্যে সংবিধান সংশোধন করে শেখ মুজিব চরম স্বৈরতান্ত্রিক বাকশাল শাসনব্যবস্থা কায়েম করলেন এবং একাধারে রাষ্ট্রপতি ও জাতির পিতা বনে গেলেন। বাংলাদেশে ওয়েস্টমিনস্টার আদলে প্রতিষ্ঠিত সংসদ অপব্যবহারের মাধ্যমেই পিতা এবং কন্যা যাবতীয় কুকর্ম করেছেন।

আমরা আশা করছি, আগামী বছর এক নতুন নির্বাচিত সরকার রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে যাবে। সংস্কারের বিষয়ে এসব রাজনৈতিক সরকারগুলোর অতীত তেমন একটা উজ্জ্বল নয়। আমরা অতীতে দেখেছি, এই জাতীয় সরকার স্থিতাবস্থা (Status Quo) বজায় রাখতে পছন্দ করে। স্থিতাবস্থা থাকলে একদিকে যেমন মেধার তেমন একটা দরকার পড়ে না, অন্যদিকে মিলেমিশে খাওয়া-দাওয়াটাও ভালোই হয়। এবারের বন্দোবস্ত ভিন্ন হতে হবে। মিলেমিশে খাওয়ার পরিণতি আমরা ফ্যাসিবাদের উত্থান এবং পতন, দুটোর মধ্য দিয়েই দেখেছি। ১৯৭১ সালে অর্জিত স্বাধীনতা বেহাত হয়েছে, ১৯৭৫ সালের সিপাহি-জনতার বিপ্লব পরবর্তী সময়ে সরকার পরিচালনায় তেমন কোনো গুরুত্ব পায়নি এবং ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান পথভ্রষ্ট হয়ে ২০০৯ সালে ফ্যাসিবাদ জন্ম নিয়েছে। ২০২৪ সালের তারুণ্যের মহান বিপ্লব আমরা ব্যর্থ হতে দিতে পারি না। ভবিষ্যতের কোনো সরকারপ্রধানকে জনগণ আর শেখ হাসিনার মতো রাষ্ট্রের মালিক হতে দেবে না। সেই ফ্যাসিস্ট আমলের নিয়মিত তেলবাজির সংবাদ সম্মেলনে দেওয়া হাসিনার ফেরাউনসুলভ এক দম্ভোক্তির কথা প্রসঙ্গক্রমে মনে পড়ল।

সে রকম এক সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনা সম্পাদক নামধারী তার সব চামচাদের বলেছিলেন, তিনি নাকি মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের প্রথমাবস্থায় বাংলাদেশে আশ্রয় দিতে চাননি। তার ছোট বোন শেখ রেহানা হাসিনার অহংকারে বাতাস দিয়ে তাকে সম্মত করিয়েছিলেন। শেখ রেহানা তাকে নাকি বলেছিলেন, ‘আপা তুমি সতেরো কোটি লোককে খাওয়াচ্ছো আর মাত্র কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে খাওয়াতে পারবে না?’ হাসিনার বক্তব্য থেকে আমরা সেদিন জেনেছিলাম যে, সৃষ্টিকর্তা নন, তিনিই বাংলাদেশের সব মানুষকে আহার জোগান! ফেরাউন তার মন্ত্রী হামানকে নির্দেশ দিয়েছিল এক সুউচ্চ সিঁড়ি নির্মাণ করতে, যাতে সে মুসা (আ.)-এর আল্লাহকে দেখতে পারে (নাউজুবিল্লাহ)। তবে ফেরাউনও ইজিপ্টের সব নাগরিককে খাওয়ানোর দাবি করেনি। আত্মম্ভরিতায় হাসিনা ফেরাউনকেও ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

ইউনূস সরকারের প্রথম পাঁচ মাস সফলতা এবং ব্যর্থতা মিলেই কেটেছে। সবচেয়ে বড় সফলতা হলো সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠেনি। শেখ হাসিনা সর্বগ্রাসী দুর্নীতির পঙ্কিলতায় সমাজ ও রাষ্ট্রকে নিমজ্জিত করে পালিয়েছিল। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণ সহজ হবে না। মানুষের চরিত্র পরিবর্তন হতে সময়ের প্রয়োজন। বিশেষ করে, দুর্নীতিলব্ধ সম্পদের নেশা বড় ভয়ানক। সে জন্যই আগামী এক বছরের মধ্যে বর্তমান সরকারকে এমন একটি পদ্ধতি প্রবর্তন করে যেতে হবে, যাতে পরবর্তী গণতান্ত্রিক সরকারের আমলেও দুর্নীতি লোপ না পেলেও অন্তত নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। আর একটি ব্যাপারেও ইউনূস সরকার বিশেষ প্রশংসার দাবিদার। হাসিনা সরকারের পতনে পাগলপারা দিল্লির ষড়যন্ত্র এবং হুমকি অন্তর্বর্তী সরকার সাহসিকতা এবং প্রাজ্ঞতার সঙ্গে মোকাবিলা করেছে। বর্তমান ভূরাজনৈতিক বাস্তবতায় কোনো রাজনৈতিক দলের সরকারের পক্ষেই এতটা দৃঢ়তার সঙ্গে মোদিকে মোকাবিলা করা সম্ভব হতো না। দুটি প্রধান সফলতার কথা বলে এবার সরকারের দুটি বড় ব্যর্থতার প্রসঙ্গে যাচ্ছি।

ক্ষমতা নিয়েই দ্রুততার সঙ্গে প্রশাসনকে আওয়ামীমুক্ত না করার ব্যর্থতার জন্য সরকারকে বহু ক্ষেত্রে খেসারত দিতে হচ্ছে এবং হবে। এ কারণেই বিভিন্ন পর্যায়ে আমরা প্রশাসনিক দুর্বলতা দেখতে পেয়েছি। সচিবালয়ে নিশুতি রাতে রহস্যময় অগ্নিকাণ্ড প্রশাসনিক দুর্বলতার একটি প্রমাণ। আর সরকারের দ্বিতীয় প্রধান ব্যর্থতা হলো বাজার নিয়ন্ত্রণে অক্ষমতা। এ ক্ষেত্রে তারা সীমাহীন অদক্ষতার পরিচয় দিয়েছে। সবাই বাজার সিন্ডিকেটের কথা বললেও সরকারের পক্ষ থেকে সেই সিন্ডিকেট ভাঙা কিংবা তাদের কারসাজি ব্যর্থ করে দেওয়ার সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে বিশাল ঘাটতি ছিল। তারা না পেরেছে অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে, না পেরেছে সাধারণ জনগণের কাছে সুলভমূল্যে পণ্য পৌঁছাতে। এই অদক্ষতার একটা উদাহরণ দেওয়া যাক। আওয়ামী আমলের বাজার সিন্ডিকেটের (Oligarch) কারসাজি মোকাবিলার জন্য সরকারের উচিত ছিল ক্ষমতা গ্রহণ করেই টিসিবিকে শক্তিশালী করার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া। তারা যদি রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে পর্যাপ্ত ট্রাকে করে নির্ধারিত মূল্যে অন্তত চাল, ডাল, চিনি ও সয়াবিন তেল বিক্রির ব্যবস্থা করতে পারত, তাহলে ওই চারটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে তো থাকতই, উপরন্তু এর প্রতিক্রিয়ায় অন্য পণ্যের দামও কমে যেত। এক রাজধানীতেই ট্রাকে করে পণ্য বিক্রির ব্যবস্থা নিতে সরকার অনেক দেরি করেছে এবং নিলেও তা এখন পর্যন্ত একেবারেই অপ্রতুল। ফলে নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত পরিবারের গৃহিণীদের পর্যন্ত আমরা দীর্ঘ সারিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি। অনেক স্থানে দীর্ঘ সময় ধরে অপেক্ষমাণ, অধৈর্য মানুষের মধ্যে বাকবিতণ্ডাসহ অন্যান্য অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেছে। এদিকে সময়মতো কৃষকদের কাছ থেকে ধান ও চাল কেনা নিয়েও সময়ক্ষেপণ হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব ব্যর্থতার দায় সরকারকে অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে।

নির্বাচনের দিনক্ষণ আমাদের জানা নেই। এ নিয়ে বিএনপি এবং সরকারের মধ্যকার বিরোধ ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। দ্রুত নির্বাচনের দাবিতে দলটির আন্দোলনে নামার হুমকি এখন প্রচ্ছন্ন থেকে প্রকাশ্য হচ্ছে। আমার বিবেচনায় সমস্ত কাজ সম্পন্ন করে যথাযোগ্য সম্মানের সঙ্গে দায়িত্ব থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য ড. ইউনূসের হাতে অনধিক দেড় বছর সময় আছে। এর মধ্যে তিনি যদি সব রাজনৈতিক দলকে আস্থায় নিয়ে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে যেতে পারেন, তাহলে জাতি তাকে চিরকাল শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রফেসর ইউনূস এক অতি সম্মানিত নাম। তবে দেশ পরিচালনায় তার পরীক্ষা দেওয়া শুরু হয়েছে এবং সেই পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল জানার জন্য আমাদের হয়তো এক থেকে দেড় বছর অপেক্ষা করতে হবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত