এক ডেথ ভ্যালির গল্প

সৈয়দ আবদাল আহমদ, যুক্তরাষ্ট্র থেকে
প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২: ৪৮

হাজার তারার রাতের আকাশ শুধু মুগ্ধ করেনি, চোখ জুড়িয়ে দিয়েছে। তারা ঝলমল এই রাতের আকাশ উপভোগ করেছি ক্যালিফোর্নিয়ার ডেথ ভ্যালিতে বেড়াতে এসে।

বিজ্ঞাপন

ডেথ ভ্যালি বা মৃত্যু উপত্যকা ক্যালিফোর্নিয়ার মরুভূমি এলাকায় অবস্থিত। এটি নেভাডা সীমান্তের কাছে দক্ষিণ-পূর্ব ক্যালিফোর্নিয়ায় পড়েছে। লাস ভেগাসও কাছে।

ডেথ ভ্যালি পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম, শুষ্কতম এবং একই সঙ্গে এর একটি জায়গা আছে যা পৃথিবীর সবচেয়ে নিচুতম স্থান হিসেবে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে চিহ্নিত।

প্রচণ্ড ঠান্ডা আর বরফ পড়ার কারণে ওয়াশিংটন ডিসিতে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেক অনুষ্ঠান হচ্ছে ঘরের ভেতরে তথা ক্যাপিটল ভবনের ভেতরে। ঠিক তখন যুক্তরাষ্ট্রেরই ক্যালিফোর্নিয়ার এই উষ্ণতম জায়গাটা কেমন সাংবাদিক হিসেবে দেখতে কৌতূহল হলো। না, শুধু আমরাই নই, শত শত পর্যটক এই জায়গা দেখতে ভিড় করেছেন। ‘ডেথ ভ্যালি’ পাঁচ হাজার বর্গমাইলের এক মরু উপত্যকা। যুক্তরাষ্ট্র সরকার পুরো এলাকাকে ডেথ ভ্যালি ন্যাশনাল পার্ক হিসেবে পর্যটকদের জন্য দর্শনীয় স্থান হিসেবে উন্মুক্ত করেছে। পূর্ব ক্যালিফোর্নিয়ার এই মরুভূমি পৃথিবীর একটি ভয়ংকর জায়গা। মাইলের পর মাইল শুধু ধূসর রঙের পাথরের পাহাড় আর মরুভূমি।

এখানে আছে বালিয়াড়ি, আছে গভীর খাদ, গুহা, বোরাক্সের খনি, ডেভিলস হোল বা শয়তানের বাড়ি, লবণের লেক, নানা উদ্ভিদ, বনফুল, জীবজন্তু আর আছে ‘টিম্বিশা শোশোন’ নামে এক আদিবাসী গোষ্ঠী। ডেথ ভ্যালিতে এমন এমন কিছু পাহাড় আছে, যেখানে গেলে মনে হয় এগুলো শিল্পীর তুলিতে আঁকা। এখানে আছে ‘স্লাইডিং স্টোন’ নামে এক ধরনের পাথর যেগুলো চলমান। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পাথরগুলো স্থান পরিবর্তন করে।

ডেথ ভ্যালির উৎপত্তি কয়েক মিলিয়ন বছর আগে সমুদ্র থেকে, টেকটোনিক প্লেটের সংঘর্ষে সৃষ্ট ভূমিকম্পের ফলে।

নাম কেন ডেথ ভ্যালি বা মৃত্যু উপত্যকা হলো তা অনুসন্ধান করে জানা গেল, বহু বছর আগে ইউরোপীয় একটি দল এখানে সোনার খনির খোঁজে এসেছিল। সোনা খুঁজতে গিয়ে দলটির কেউ কেউ মারা যায়। উদ্ধার পাওয়াদের একজন বেঁচে গিয়ে লিখে যান ‘গুড বাই ডেথ ভ্যালি’। সেই থেকে নাম ডেথ ভ্যালি। ডেথ ভ্যালিতে ২০০৭ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ৬৮ জন মারা গেছে বিভিন্ন কারণে।

ডেথ ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের ভিজিটর গাইডে উল্লেখ আছে এটি পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণতম জায়গা। ১৯১৩ সালের ১০ জুলাই তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ১৩৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৫৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সাহারা মরুভূমির চেয়েও বেশি। এটা নিয়ে আবহাওয়াবিদদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওয়েদার সার্ভিস এর সত্যতা নিশ্চিত করেছে।

২০২৪ সালের জুন-আগস্টে গড় তাপমাত্রা ছিল ১০৪ দশমিক ৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট বা ৪০ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। শীতকাল হওয়ায় আমরা বেঁচে যাই। টি-শার্ট পরে ঘোরাঘুরি করা গেছে। এখানে আছে ‘বেডওয়াটার বেসিন’। দূর থেকে তাকালে মনে হয় পানির লেক। কিন্তু পুরোটাই লবণ। লবণ পানির হ্রদ মানলির ওপর আমরা হেঁটেছি। এই বেসিন পৃথিবীর সবচেয়ে নিচু স্থান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৮২ ফুট বা ৮৬ মিটার নিচু এই এলাকা। পর্যটকদের বলা হয়ে থাকে এখানে ভ্রমণ করলে গ্যালন গ্যালন পানি পান করতে হবে। গাড়িতে পানির বোতল থাকতে হবে। নইলে পানিশূন্যতায় পড়তে হবে। ভ্রমণ করতে গিয়ে এটা আমরা লক্ষ করেছি। ঠোঁট-মুখ শুকিয়ে যাচ্ছে, পানির পিপাসা লাগছে কিছুক্ষণ পরপর। গড়ে বছরে এখানে বৃষ্টিপাত ২ দশমিক ২ ইঞ্চি। অবশ্য ডেথ ভ্যালিতে প্রচুর বৃষ্টিপাতের কারণে বন্যা হওয়ারও রেকর্ড আছে।

শরৎকাল ডেথ ভ্যালি ভ্রমণের উপযুক্ত সময়। ডেথ ভ্যালির প্যানামিন্ট পর্বতমালা এলাকার গভীরে আছে একটি ভয়ংকর গুহা। এটাকে ‘ডেভিলস হোল’ বা ভূতের বাড়ি বলা হয়ে থাকে। পর্যটকদের জন্য জায়গাটি নিরাপদ নয়। সেজন্যই এটার নাম ভূতের গুহা।

ডেথ ভ্যালির প্রাণীরা কেমন? খোঁজ নিয়ে আমরা জানতে পেরেছি এখানে হাজারের বেশি স্তন্যপায়ী প্রাণী আছে। খচ্চর, শিয়াল, লম্বা সিংওয়ালা হরিণ, বিগহর্ন ভেড়া আছে। আছে ক্যাঙারু, ইঁদুর, কাছিম, লিজার্ড নামক গিরগিটি এবং সাপ। ৩৬ প্রজাতির সরীসৃপ আছে। হেমিং বার্ডসহ পাখি আছে ৩০০ প্রজাতির। বসন্তে ডেথ ভ্যালি রঙিন হয়ে ওঠে নানা বনফুলে। তখন প্রজাপতির মেলা বসে।

এখানে আগ্নেয়গিরির লাভা শুকিয়ে একটি জায়গা আছে যা ‘শয়তানের লাঠি’ হিসেবে পরিচিত। তেমনি একটি জায়গা আছে যার নাম ডেভিলস গলফ এরিয়া। এখানে শয়তানরা গলফ খেলে।

তবে সবকিছু ছাপিয়ে ডেথ ভ্যালিতে রাতের আকাশ দেখা এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। জমকালো অন্ধকারের কারণে আকাশের তারা পরিষ্কার দেখা যায়। এক-দুটি নয়, হাজারে হাজারে, লাখে লাখে তারা। পুরো আকাশ যেন তারায় তারায় খচিত। তেমনি সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দেখার এক মনোরম জায়গা এই ডেথ ভ্যালি। এই দুই সময়ে সূর্যের কিরণ পাথরের পাহাড়ে পড়ে নানা রঙের সৃষ্টি করে যা নয়ন জুড়ানো। দেখতে মনে হয় আর্টিস্ট প্লেট।

ডেথ ভ্যালির টিম্বিশা শোশোন আদিবাসী এখন নেই বললেই চলে। স্থানীয় হোটেল ও রিসোর্টে কাজ করতে দেখা যায়। এ ছাড়া বোরেক্স খনিতেও এরা কাজ করেন। বহু বছর আগে থেকে এখানে বোরেক্স খনি থেকে বোরেক্স উৎপাদন হচ্ছে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত