নেচার সাময়িকীতে তিন বিজ্ঞানীর বিশ্লেষণ

‘সুপারশিয়ার ভূমিকম্প’ আঘাত হানেছিল মিয়ানমারে,ঘটে বিরল বিস্ফোরণ

প্রকাশ : ০৪ এপ্রিল ২০২৫, ১০: ১৬

বিজ্ঞানীরা মিয়ানমারের ৭ দশমিক ৭ মাত্রার ভূমিকম্পটিকে ‘সুপারশিয়ার ভূমিকম্প’ নামে অভিহিত করেছেন। তারা বলেন, এই সুপারশিয়ার ভূমিকম্প বিরল ধরনের বলে মনে হচ্ছে। এক্ষেত্রে ফাটলের শক্তি মাটির মধ্য দিয়ে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে প্রবাহিত হয়েছে, যা ধ্বংসকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। এ ধরনের ফাটল ‘একটি সুপারসনিক জেটের সমতুল্য’।

বিজ্ঞাপন

বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান সাময়িকী ‘নেচার’ পত্রিকার এক বিশেষ রিপোর্টে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। নেচারে জার্মানির পটসডামের জিএফজেড হেলমহোল্টজ সেন্টার ফর জিও সায়েন্সেসের ভূ-কম্পবিদ ফ্রেডেরিক টিলম্যানসহ তিন বিজ্ঞানীর বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়।

বিজ্ঞানী ফ্রেডেরিক টিলম্যান বলেন, মিয়ানমারের ভূমিকম্পটি একটি বিরল বিস্ফোরণ ছিল। সুপারশিয়ার ভূমিকম্পটি দ্রুত সংঘটিত হয়েছে এবং বহুদূরে আঘাত হেনেছে, যার ফলে ক্ষয়ক্ষতি ও মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে।

গত শুক্রবার ২৮ মার্চ দুপুরে ৭ দশমিক ৭ মাত্রার শক্তিশালী এই ভূমিকম্প হয় মিয়ানমারে। ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর মান্দালয়ের ১৬ কিলোমিটার দূরের একটি এলাকায়। একই সময়ে মিয়ানমার ছাড়াও অন্তত সাত দেশে ভূমিকম্প হয়। ভূমিকম্পে এ পর্যন্ত তিন হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। প্রতিদিনই নতুন মৃতদেহ উদ্ধার করা হচ্ছে। মিয়ানমারের পর ভূমিকম্পে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হচ্ছে থাইল্যান্ড।

বিজ্ঞানী তার বিশ্লেষণে টিলম্যান বলেন, মিয়ানমারের ভূমিকম্পটি পুরোপুরি সুপারশিয়ার বৈশিষ্ট্যের। ভূমিকম্পটির সময় ভূ-তাত্ত্বিক চ্যুতি বা ফাটল হয়। এ ফাটল বিশাল সাগাইং চ্যুতি, যেটি মিয়ানমারের কেন্দ্রস্থল দিয়ে উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত এবং ৪০০ কিলোমিটার বা তারও বেশি দূরে ফাটল সৃষ্টি করেছে। আগামী দিনে ভূমিকম্পের আগে ও পরে তোলা অঞ্চলবিশেষের স্যাটেলাইট চিত্র দেখে এ বিষয়ে আরো নিশ্চিত হওয়া যাবে। বিজ্ঞানী টিলম্যান আরো জানান, সুপারশিয়ার ভূমিকম্পের তীব্রতা এর তরঙ্গের তুলনায় দ্রুতগতিতে প্রবাহিত হয়। এই প্রভাব ভূমিকম্পের শক্তি ফেটে যাওয়ার আগে কেন্দ্রীভূত হতে পারে, যার ফলে সুপারশিয়ার নয় এমন ভূমিকম্পের তুলনায় বেশি দূরত্বে ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। যেমন এই ভূমিকম্পের সময় ব্যাংককে নির্মাণাধীন একটি বহুতল ভবন ধসে পড়ে, যদিও ভূমিকম্পটির কেন্দ্রস্থল থেকে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দূরে ছিল ব্যাংকক। ভূমিকম্পে মিয়ানমারজুড়ে এবং কিছুটা হলেও প্রতিবেশী থাইল্যান্ডেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

ভূমিকম্পটি সম্পর্কে নেচারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ক্যালিফোর্নিয়ার পাসাডেনার ইউএসজিএসের ভূ-কম্পবিদ ড. সুসান হাফ বলেন, মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ ইউএসজিএসের সহযোগিতায় মিয়ানমারের দুটি ভূকম্পন কেন্দ্র ভূমিকম্পের সময় পরিমাপ ধারণ করেছে। ভূমিকম্পের সময় কী ঘটেছিল, তা আরো ভালোভাবে বুঝতে—বিশেষ করে আফটার শক পর্যবেক্ষণ করতে থাইল্যান্ডের জাতীয় ভূকম্পন নেটওয়ার্ক থেকে প্রাপ্ত তথ্যও ব্যবহার করছি আমরা গবেষকরা।

মিয়ানমারের সাগাইং ফল্ট সম্পর্কে বিজ্ঞানীদের বিশ্লেষণে বলা হয়, এই সাগাইং ফল্ট হলো একটি স্ট্রাইক-স্লিপ ফল্ট, যা ক্যালিফোর্নিয়ার সান আন্দ্রেয়াস ফল্টের মতো, যেখানে পৃথিবীর ভূত্বকের দুটি ফেটে যাওয়া অংশ একে অপরের পাশ দিয়ে চলে যায়। ১৯০০ সাল থেকে এই অঞ্চলে ৭ বা তার বেশি মাত্রায় আরো ছয়টি ভূমিকম্প হয়েছে। গবেষকরা হাইলাইট করেছেন, ২৮ মার্চ মান্দালয়ের কাছে ভেঙে যাওয়া সাগাইং ফল্টের অংশটি একটি ‘ভূমিকম্পের ফাঁকে’ ছিল, যেখানে কিছু সময়ের জন্য ভূমিকম্প হয়নি এবং তাই এটি ফেটে যাওয়ার ঝুঁকিতে ছিল। ভূমিকম্পের প্রাথমিক পর্যবেক্ষণ থেকে জানা যায়, ফল্টের দুপাশ একে অপরের পাশ দিয়ে ৬ দশমিক ৫ মিটার পর্যন্ত সরে গিয়েছিল। নিউ ইয়র্কের ইথাকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকম্প বিজ্ঞানী ও আর্থকোয়াক ইনসাইটস নিউজলেটারের প্রতিষ্ঠাতা ড. জুডিথ হাবার্ড তার বিশ্লেষণে বলেন, মিয়ানমারের সংঘটিত ভূমিকম্পটি আমাদের পর্যবেক্ষণ করা সবচেয়ে বড় স্ট্রাইক-স্লিপ ভূমিকম্পগুলোর মধ্যে একটি। তিনি বলেন, এই ভূমিকম্পের গতিও অসাধারণ ছিল। পুরো ফাটলটি প্রায় ৯০ সেকেন্ডের মধ্যে ঘটেছিল। ফল্টের একটি শাখা মান্দালয়ের উত্তরে ভেঙে যায় এবং দ্বিতীয় শাখাটি দক্ষিণে ভেঙে যায়। মিয়ানমারের বাইরে ভূমিকম্পটির শক্তি কীভাবে মাটিতে প্রবাহিত হয়েছিল, তা সিসমোমিটার ব্যবহার করে পাওয়া গেছে। বেশ কয়েকটি বিশ্লেষণ থেকে পাওয়া তথ্যে জানা গেছে, দক্ষিণে চলমান এই ফাটলটিই সুপারশিয়ার বলে মনে হচ্ছে।

নেচারকে সুপারশিয়ার ভূমিকম্প সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা জানান, সুপারশিয়ার ভূমিকম্প একটি বিরল ও শক্তিশালী ঘটনা, যা ভূমিকম্পের সময় ঘটে, যখন ফাটলটি ভূকম্পিত তরঙ্গের চেয়ে দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে। এ ধরনের ভূমিকম্পকে সুপারসনিক জেটের গতির সঙ্গে তুলনা করা হয়, যা সামনের দিকে ভূমিকম্প-উদ্ভূত শক্তি কেন্দ্রীভূত করে এবং এর ফলে অস্বাভাবিকভাবে বিশাল অঞ্চলে ক্ষয়ক্ষতি ছড়িয়ে পড়ে।

মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ভূমিকম্প এ কারণেই মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞের কারণ বলে তারা উল্লেখ করেন। বিজ্ঞানীরা বলেন, সাগাইং ফল্ট বরাবর একটি সুপারশিয়ার ফাটলের ফলে এটি ঘটেছিল। আন্দামান সাগর থেকে দেশের উত্তর অংশে মিয়ানমারের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এই ফল্টটি ক্যালিফোর্নিয়ার সান আন্দ্রেয়াস ফল্টের মতোই। এই ভূমিকম্পে প্রতি সেকেন্ডে তিন থেকে পাঁচ কিলোমিটার বেগে তরঙ্গের দ্রুত বিস্তার ঘটেছিল।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত