সড়ক পরিবহন আইন

বাস্তবায়নে বাধা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চাঁদাবাজি

মাহমুদা ডলি
প্রকাশ : ১৬ আগস্ট ২০২৫, ১০: ১১
আপডেট : ১৬ আগস্ট ২০২৫, ১৪: ০১

দেশের সড়ক ও মহাসড়গুলোয় দুর্ঘটনা যেন থামেছে না। এতে অনেক মানুষ হারাচ্ছে তাদের প্রিয়জন, অনেক পরিবার তাদের একমাত্র উপার্জক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে হচ্ছে নিঃস্ব। এমন অপূরণীয় ক্ষতি সত্ত্বেও দিনদিন সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েই চলেছে।

এর পেছনে যানবাহনের বেপরোয়া গতি ও আইন না মানার প্রবণতাকে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা জানান, সড়ক পরিবহন আইন থাকলেও সেটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ এটি বাস্তবায়নে সবচেয়ে বড় বাধা রাজনৈতিক ছত্রছায়া, যেটির সঙ্গে আবার চাঁদাবাজি ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

বিজ্ঞাপন

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের গবেষণার তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে চার হাজার ১১৯টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত চার হাজার ১২৩ জন প্রাণ হারান, আহত হন আট হাজার ৭১০ জন।

সড়ক দুর্ঘটনাকে মানবাধিকারের দিক থেকে পদ্ধতিগত সহিংসতা (সিস্টেমেটিক ভায়োলেন্স) আখ্যায়িত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, সড়কে গাড়ি নামাতে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনকে বড় অঙ্কের চাঁদা দিতে হয়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজনৈতিক পরিচয়ে এবং মালিক-শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠনের আড়ালে এ চাঁদাবাজি সংঘটিত হয়। এছাড়া মাসভিত্তিক ও রুটভিত্তিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদেরও চাঁদা দিতে হয়। এ কারণে চালক ও মালিকরা নিজেদের আইনের ঊর্ধ্বে মনে করেন। ফলে রুট পারমিট, যানবাহনের ফিটনেস, চালকের উপযুক্ত ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকা সত্ত্বেও তারা অনুমোদন পেয়ে যান। ফলে অনেক সময় অদক্ষ চালক ও ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কারণে ঘটে দুর্ঘটনা। কিন্তু চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটের কারণে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করা যায় না। ফলে সড়কে আইন ভঙ্গ করার প্রবণতা থেকে বের হতে পারেন না চালকরা।

আইন বাস্তবায়নে বড় বাধা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় চাঁদাবাজি

২০২৪ সালের ১৩ জুন প্রকাশিত টিআইবির গবেষণা প্রতিবেদন বলছে, শুধু যাত্রী পরিবহন খাতের ব্যবসায়ীরাই প্রতি বছর প্রায় এক হাজার ৬০ কোটি টাকা চাঁদা দেন। পণ্য পরিবহনের হিসাব করলে চাঁদার অঙ্ক দুই হাজার কোটি টাকা ছাড়াবে। দেশের আন্তঃজেলা ও দূরপাল্লা রুটের বাসের ক্ষেত্রে বাসপ্রতি গড় চাঁদার পরিমাণ এক হাজার ১৯ টাকা, আন্তঃজেলা ও আঞ্চলিক রুটের বাসের ক্ষেত্রে এক হাজার ১৩৩ এবং সিটি সার্ভিসের বাসের ক্ষেত্রে গড় চাঁদার পরিমাণ পাঁচ হাজার ৬৫৬ টাকা। এ হিসাবে বছরে এক হাজার ৬০ কোটি টাকা গুনতে হয় পরিবহন খাতসংশ্লিষ্টদের।

বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের গবেষণা বলছে, দীর্ঘকাল ধরে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা চাঁদাবাজ সিন্ডিকেটই মূলত গণপরিবহন খাতে শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় প্রধান বাধা। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আইন বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না এই সিন্ডিকেটের কারণে।

ফাউন্ডেশনটির নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান আমার দেশকে বলেন, গণপরিবহন খাতে বছরে হাজার কোটি টাকার বেশি চাঁদাবাজি হয়। এ চাঁদাবাজি প্রধানত তিন পদ্ধতিতে হয়। প্রথমত, মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নামে প্রতিদিন প্রায় দুই কোটি টাকা চাঁদা তোলা হয়। দ্বিতীয়ত, বাস-মিনিবাস নির্দিষ্ট পথে নামাতে মালিক-সমিতি সংগঠনের চাঁদা (বাসপ্রতি দুই থেকে ২৫ লাখ টাকা)। তৃতীয়ত, রাজধানী ও আশপাশে কোম্পানির অধীন বাস চালাতে ওয়েবিল বা গেটপাস চাঁদা (প্রতিদিন প্রায় এক কোটি টাকা)।

তিনি আরো বলেন, ২০১৮ সালে প্রণীত সড়ক পরিবহন আইনে জামিন অযোগ্য ধারা, সাজা ও জরিমানা বৃদ্ধির বিধান থাকায় পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা তা বাস্তবায়নে বাধা দিচ্ছেন।

যা আছে সড়ক পরিবহন আইনে

সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮-এর ৪৯ ধারার প্রথম অংশে বলা হয়েছে, মদ্যপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে কোনো মোটরযান চালানো যাবে না। মদ্যপান বা নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে কোনো কন্ডাক্টর বা মোটরযান শ্রমিক মোটরযানে অবস্থান করতে পারবেন না। চালক কোনোভাবেই কন্ডাক্টর বা শ্রমিককে মোটরযান চালানোর দায়িত্ব দিতে পারবেন না। সড়ক বা মহাসড়কে উল্টো দিক থেকে মোটরযান চালানো যাবে না। নির্ধারিত স্থান ছাড়া মোটরযান থামিয়ে যানজট বা অন্য কোনো ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা যাবে না। মোটরসাইকেলে একজনের বেশি সহযাত্রী বহন করা যাবে না এবং চালক ও সহযাত্রী উভয়কে যথাযথভাবে হেলমেট ব্যবহার করতে হবে।

চলন্ত অবস্থায় চালক, কন্ডাক্টর বা অন্য কোনো ব্যক্তি কোনো যাত্রীকে মোটরযানে ওঠাতে বা নামাতে পারবেন না। প্রতিবন্ধী যাত্রীদের জন্য গণপরিবহনে অনুকূল সুযোগ-সুবিধা রাখতে হবে। মোটরযানের বডির সামনে-পেছনে, উভয় পাশে, বডির বাইরে বা ছাদে কোনো যাত্রী, পণ্য বা মালামাল বহন করা যাবে না। সরকার বা কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়া কোনো মোটরযানে বিজ্ঞাপন প্রদর্শন বা প্রচার করা যাবে না। কোনো মহাসড়ক, সড়ক, ফুটপাত, ওভারপাস বা আন্ডারপাসে মোটরযান মেরামতের নামে যন্ত্রাংশ বা মালামাল রেখে বা দোকান বসিয়ে বা অন্য কোনোভাবে দ্রব্যাদি রেখে যানবাহন বা পথচারী চলাচলে বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। সড়কসংলগ্ন ফুটপাতের ওপর দিয়ে কোনো ধরনের মোটরযান চলাচল করতে পারবে না। কোনো ব্যক্তি কোনো মোটরযানের মালিক বা কোনো আইনানুগ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া সংশ্লিষ্ট মোটরযান চালিয়ে বাইরে নিয়ে যেতে পারবেন না। আইনানুগ কর্তৃপক্ষ বা যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া কোনো ব্যক্তি দাঁড়িয়ে থাকা কোনো মোটরযানে প্রবেশ বা আরোহণ করতে পারবেন না।

দ্বিতীয় অংশে বলা হয়েছে, যান চালানো অবস্থায় মোবাইল ফোন বা অনুরূপ সরঞ্জাম ব্যবহার করা যাবে না। চালক সিটবেল্ট বাঁধা ছাড়া মোটরযান চালাতে পারবেন না। দূরপাল্লার মোটরযানে নির্ধারিতসংখ্যক যাত্রী বা আরোহীর অতিরিক্ত কোনো যাত্রী বা আরোহী বহন করা যাবে না। কোনো চালক, কমান্ডার বা মোটরযান পরিচালনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি পরিবহনের যাত্রীসাধারণের সঙ্গে দুর্ব্যবহার বা অসৌজন্যমূলক আচরণ বা হয়রানি করতে পারবেন না। রাতের বেলায় বিপরীত দিক থেকে আসা মোটরযান চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি হয় এমন হাইবিম ব্যবহার করে মোটরযান চালানো যাবে না।

আইন অনুযায়ী, প্রথমাংশের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক তিন মাসের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসাবে দোষসূচক এক পয়েন্ট কাটা হবে। দ্বিতীয় অংশের কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে এবং চালকের ক্ষেত্রে অতিরিক্ত হিসাবে দোষসূচক এক পয়েন্ট কাটা যাবে। নতুন আইনে বেপরোয়া বা অবহেলায় গাড়ি চালানোর কারণে কেউ গুরুতর আহত বা কারো প্রাণহানি হলে অপরাধীর সর্বোচ্চ পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে।

আইনে বলা আছে, সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু বা হত্যার উদ্দেশ্য প্রমাণ হলে তা দণ্ডবিধির ৩০২ ধারার অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। কোনো ব্যক্তির ড্রাইভিং লাইসেন্স না থাকলে বা মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স ব্যবহার করে গাড়ি চালালে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২৫ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড হবে। সড়কে দুটি গাড়ি পাল্লা দিয়ে চালানোর সময় যদি দুর্ঘটনা ঘটে, সেক্ষেত্রে তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা ২৫ লাখ টাকা জরিমানার বিধান রয়েছে। চলন্ত অবস্থায় চালক মুঠোফোনে কথা বললে এক মাসের কারাদণ্ড বা পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা দিতে হবে। এ আইনে অপরাধের তদন্ত, বিচার, আপিল ইত্যাদি ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি প্রযোজ্য হবে।

আইনে কী নেই

জাতিসংঘের ‘সেকেন্ড ডিকেড অব অ্যাকশন ফর রোড সেফটি ২০২১-৩০’-এ বর্ণিত পাঁচটি পিলার তথা নিরাপদ সড়ক ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ মোটরযান, নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী ও দুর্ঘটনাপরবর্তী ব্যবস্থাÑএগুলোর যথাযথ অন্তর্ভুক্তি বিদ্যমান আইনে নেই। এছাড়া সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় উল্লিখিত সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্যও আইন ও বিধিমালা করা হয়নি। আইন বা বিধিতে সড়ক অবকাঠামো, যানবাহনের নিরাপত্তা, সিটবেল্ট, শিশুদের নিরাপত্তার বিষয়গুলো গুরুত্ব পায়নি। নেশাগ্রস্ত ও মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালানোসংক্রান্ত বিষয় স্পষ্ট ও বিস্তারিতভাবে উল্লেখ নেই। দুর্ঘটনার পর আহত ব্যক্তির চিকিৎসা ও পুনর্বাসনসংক্রান্ত কোনো বিধান উল্লেখ করা হয়নি। এছাড়া দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তিকে সহযোগিতার বিষয়ে সেবাদানকারীদের আইনি সুরক্ষার বিষয়টিও এখানে অনুপস্থিত।

প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ

বিশেষজ্ঞদের মতে, মূলত রাজনৈতিক কারণে দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি না থাকা এবং এর পাশাপাশি বিআরটিএ, হাইওয়ে পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা সড়ক পরিবহনকে ঝুঁকিমুক্ত করতে পারছে না। এ কারণে সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন এবং সড়কে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সমন্বিত উদ্যোগ ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন তারা।

গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও অন্যান্য অংশীজনের মতে, চলমান বাস্তবতায় সড়কে শৃঙ্খলা আনতে অন্যান্য ইস্যুর মতো সড়ক দুর্ঘটনার জন্যও রাজনৈতিক ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করা এবং যানবাহনে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। একই সঙ্গে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের পাশাপাশি মালিক, শ্রমিক, যাত্রী, পথচারী এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবার জন্য এ-সংক্রান্ত আইন ও বিধিনিষেধ জানা ও সেগুলো মেনে চলার যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলেও জানান তারা।

এসব সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের গণমাধ্যম বিশ্লেষক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং সড়ক নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা সুপারিশগুলো করেছেন। পাশাপাশি রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দায়িত্বশীল আচরণ এবং সাধারণ মানুষকে আরো সচেতন হতে হবে। এসব বিষয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিলে দুর্ঘটনা পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব। এ কারণে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি একটি অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন। একই সঙ্গে আইনকে যুযোপযোগী করা জরুরি।

বিশ্লেষকদের বক্তব্য

বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান আমার দেশকে বলেন, ‘সারা দেশে ৯ হাজার কিলোমিটার সড়কের মাত্র তিন হাজার কিলোমিটারে ট্রাফিক টহল টিমের সক্ষমতা রয়েছে। ট্রাফিক পুলিশেরও স্বল্পতা রয়েছে। কোম্পানিগুলো তাদের বাসের প্লেট নম্বর না রাখার কারণে হাইওয়েতে ঘটে যাওয়া ডাকাতি এবং নারী নির্যাতনসহ সড়ক দুর্ঘটনাগুলোর সঠিক তদন্ত হচ্ছে না। এসব ঘটনার সঙ্গে বাসচালক ও তাদের সহযোগীদের পরোক্ষ সহযোগিতা থাকে। তাদের বাঁচাতে পরিবহন মালিকরা ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু প্লেট নম্বর থাকলে তদন্ত করতে সহজ হয়-কোন গাড়ি কীভাবে দুর্ঘটনার শিকার হলো।

সাইদুর রহমান আরো বলেন, সড়ক পরিবহন আইনে (২০১৮) ক্ষতিপূরণের যে অর্থ নির্ধারণ করা হয়েছে, তা একেবারেই কম। যে প্রক্রিয়ায় ক্ষতিপূরণ আদায়ের কথা বলা আছে, সেটিও জটিল। ট্রাস্টি বোর্ডের কোনো শাখা হবে কি না, বিধিমালায় তা স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়নি। আবার শাস্তির বিধান পাঁচ বছর থেকে কমিয়ে তিন বছর করা হয়েছে, যা একদমই ঠিক হয়নি।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের ভাইস চেয়ারম্যান ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ সৈয়দ জাহাঙ্গীর বলেন, সড়ক দুর্ঘটনা রোধ ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা অত্যন্ত জরুরি। অন্তর্বর্তী সরকার চাইলে এখনই একটি সড়ক ব্যবস্থাপনা সংস্কার কমিশন গঠন করে প্রস্তাবিত রূপরেখার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ বাস্তবায়ন করতে পারে। পরবর্তী নির্বাচিত সরকার এ উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে পারবে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের অবহেলা ও দীর্ঘদিনের অযত্নের কারণে সড়ক খাত আজ ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছে আর এর মাশুল দিচ্ছে সাধারণ মানুষ।

বেসরকারি সংস্থা যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘মোটরচালিত যানবাহন চালকদের জন্য প্রশিক্ষণ অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। এর পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট সব অংশীদাদের জন্য সচেতনতা কার্যক্রম, মোটরসাইকেলচালকদের জন্য হেলমেট আইনের প্রয়োগ, লাইসেন্স প্রক্রিয়া আরো কঠোর করা এবং বিএসটিআই মানদণ্ডের হেলমেট না পরা চালকদের জ্বালানি সরবরাহ না করাসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।’

মোজাম্মেল হক চৌধুরী আরো বলেন, সড়ক পরিবহন আইন অনুযায়ী চাঁদাবাজি একটি বেআইনি কাজ এবং এর সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। তিনি বলেন, যাত্রী কল্যাণ সমিতি এ বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে এবং চাঁদাবাজি বন্ধে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছে।

নিরপাত্তা বিধান ও চাঁদাবাজি বন্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থান

পুলিশের অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক (হাইওয়ে) মো. দেলোয়ার হোসেন মিঞা বলেছেন, সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নে চাঁদাবাজি প্রতিবন্ধকতা হলে চাঁদাবাজি কেন হয় কিংবা কোন কোন ক্ষেত্রে হয়, সে বিষয়টি নিয়ে বিশদ আলোচনা হওয়া উচিত এবং বিষয়ভিত্তিক সব অংশীজনের স্ব স্ব দায়-দায়িত্ব নিরূপণ করা দরকার। তাহলে পরিবহনের চাঁদাবাজি বলতে আমরা যা বোঝাই, সেটি বন্ধ করা সম্ভব। ধরুন, মহাসড়কে যেসব কোম্পানির পরিবহন চলাচল করে তাদের প্রত্যেক পরিবহনের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়মিত হালনাগাদ করার কথা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, একই গাড়ির কাগজ দিয়ে একাধিক গাড়ি চালানো হচ্ছে কিংবা দীর্ঘদিন ধরে কাগজপত্র হালনাগাদ করা হচ্ছে না। এতে সরকার তথা দেশ রাজস্ব হারাচ্ছে।

পুলিশের এই অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক বলেন, ‘এই গাড়িগুলো চলাচলের ক্ষেত্রে স্থানীয় শ্রমিক ও মালিক সংগঠন, কিছু সুবিধাভোগী গোষ্ঠীসহ কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা থাকে। এ ধরনের সুবিধা দেওয়ার জন্য অনেকগুলো গ্রুপ আর্থিকভাবে লাভবান হয়, যাকে আমরা চাঁদাবাজি বলছি। সেখানে উভয়পক্ষ লাভবান হয়ে থাকে। এরকম অনেকগুলো ক্ষেত্রে রয়েছে, যা আলোচনাসাপেক্ষে নির্ধারণ করা যেতে পারে।’

দেলোয়ার হোসেন মিঞা আরো বলেন, ‘আরেকটি বিষয় হলোÑশ্রমিক কিংবা মালিক সংগঠনগুলো মহাসড়ক থেকে তাদের প্রতিষ্ঠানের নামে যে চাঁদা আদায় করে তার একটি সঠিক গাইডলাইন থাকা দরকার। এ অর্থ প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এবং ব্যাংকিং চ্যানেলে লেনদেনের ব্যবস্থা করলে মহাসড়কে এ ধরনের চাঁদাবাজি রোধ করা সম্ভব। মহাসড়কের চাঁদাবাজি রোধের জন্য নতুন কোনো আইনের প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না।’

ঢাকা মেট্রোপলিটনের পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান আমার দেশকে বলেন, ‘সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য ট্রাফিক আইন প্রয়োগ এবং ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পুলিশের। তবে নিরাপদ সড়ক অবকাঠামো নির্মাণ এবং যানবাহনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে অন্যান্য সংস্থাও কাজ করে। পুলিশ মনে করে, সড়ক নিরাপত্তা একটি সম্মিলিত দায়িত্ব এবং এজন্য সব অংশীদার সংস্থার সমন্বিত পদক্ষেপ প্রয়োজন।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত