কোরআন পড়তেও অনুমতি লাগত

রকীবুল হক
প্রকাশ : ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯: ১৭
আপডেট : ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ১০: ১৮

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার তরুণ শিক্ষক মাওলানা এহসানুল হক। বিগত আওয়ামী সরকারের জুলুম-নির্যাতনের বিরুদ্ধে লেখালেখি ছাড়াও হেফাজতে ইসলামের ব্যানারে নানা কর্মসূচিতে সক্রিয় ছিলেন তিনি। এ কারণে কোনো অপরাধ না করেও ফ্যাসিস্ট সরকারের টার্গেটে পড়েন তিনি।

তার এই তৎপরতা থামাতে গ্রেপ্তার করে মিথ্যা ১০টি মামলা দিয়ে জেলে রাখা হয় ১১ মাস। কয়েক দফায় সাত দিন রিমান্ডে নিয়ে মিথ্যা স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। কারাগারের লকারে অমানবিক আচরণ করা হয় তার সঙ্গে।

বিজ্ঞাপন

এ সময় স্বাভাবিক বন্দির কোনো সুবিধাতো দূরের কথা, সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যায়িত করে তাকে চরম কষ্ট দেওয়া হয়। জেলে কোরআন পড়তেও অনুমতি নেওয়া লাগত। হাইকোর্ট থেকে জামিন নিলেও একের পর এক জেলগেট থেকে আটক করে নতুন নতুন মামলা দেওয়া হয়। কারাজীবনে বাইরের সব সংবাদ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির এই সদস্যকে।

আওয়ামী আমলের সেই নির্যাতন প্রসঙ্গে মাসিক রাহমানী পয়গামের অন্যতম কর্ণধার মাওলানা এহসানুল হক বলেন, বিগত ১৬ বছরের আগেও ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী দেশের ইসলামপন্থি ও আলেমদের ওপর বিদ্বেষমূলক আচরণ করতে দেখেছি। ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত জুলুম-নির্যাতন চালায়। ২০২১ সালে মোদিবিরোধী আন্দোলন ঘিরে আলেমদের ওপর সবচেয়ে বড় নির্যাতন শুরু করে আওয়ামী সরকার। একটি ট্র্যাজেডি ঘটিয়ে আলেমদের ওপর অত্যাচার করে।

তিনি বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে বিপ্লবী ভূমিকা রেখেছিলেন আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী, আল্লামা নুর হোসাইন কাসেমী এবং মাওলানা মামুনুল হক। তাদের কর্মকাণ্ড এগিয়ে নিতে আমাদের মতো তরুণ আলেমদের একটা ভূমিকা ছিল।

বিশেষ করে করোনার শেষদিকে লেখালেখির অনেক গুরুত্ব ছিল। আমি নিজেও লেখালেখি করতাম। তখনই আমি সরকারের টার্গেটে পড়ি। সেই সময় ঢাকা মহানগর হেফাজতের সহকারী প্রচার সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলাম আমি। ২০২১ সালের মার্চে মোদিবিরোধী আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ২৮ মার্চ হরতালের পরই সরকার আলেমদের ধরপাকড় শুরু করে।

শীর্ষ আলেমদের গ্রেপ্তারের বেশ কিছুদিন পর কিছুটা স্বাভাবিক পরিবেশে ১ আগস্ট মাওলানা এহসানুল হককে গ্রেপ্তার করে আওয়ামী সরকারের গোয়েন্দা বাহিনী। সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিনি গ্রেপ্তারের কোনো আশঙ্কায় ছিলেন না। এমন সময় হঠাৎ লালবাগে তার বাসায় আশপাশে বিপুলসংখ্যক সাদাপোশাকের লোক উপস্থিত হয়।

সেটা অনুমান করে পাশের ফ্ল্যাটে চলে যান তিনি। তবে পরিস্থিতি দেখে গ্রেপ্তার নিশ্চিত জেনে নিজেই বের হয়ে আসেন। তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা ছিল না। তারপরও সিআইডি থেকে আসার লোকজন তাকে নিয়ে সোজা চলে যান মালিবাগের সংস্থাটির কার্যালয়ে।

মাওলানা এহসানুল হক বলেন, সিআইডি কার্যালয়ে নিয়ে প্রথমে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে একটি পরিত্যক্ত ভবনের করিডরে তাকে নেওয়া হয়। তিনি বলেন, সিআইডি কার্যালয়ে বড় বড় ভবন থাকলেও বন্দিদের রাখার জন্য যে ব্যবস্থা রয়েছে, তা খুবই দুঃখজনক। এর চেয়ে নোংরা আর কিছু হতে পারে না। সেখানে একটি করিডরের দুই পাশে ছিল নোংরা-পরিত্যক্ত ছোট ছোট সেল। সেখানে মানুষ ঢোকার মতো কোনো পরিবেশ ছিল না।

একটা ডাস্টবিনের মতো। মাঝখানের করিডরটা চার ফিট আকারের। সেখানেই আরও কয়েকজন বন্দি ছিল। রুমে কেউ থাকে না, করিডরেই রাখা হয়। তার এক পাশে ডাস্টবিনের মতো একটি বাথরুম ছিল। সেখানেই তাকে দুদিন থাকতে হয়। লম্বা হয়ে শোয়া যায় না। জড়ো হয়ে মাথায় পানির বোতল বা অন্যকিছু দিয়ে ঘুমিয়ে ছিল সবাই। সেখানে দিন-রাত কিছুই বোঝা যেত না। খাবার দেওয়ার সময় বুঝতাম দিন না রাত। এই পরিবেশেই একজন ২১ দিন পর্যন্ত ছিল বলে জানান।

তিনি বলেন, সিআইডি কার্যালয়ে এক দিন কঠিন জিজ্ঞাসাবাদের মুখোমুখি করা হয় তাকে। ডিআইজি, এসপিসহ বড় অফিসারদের সামনে বসিয়ে হেফাজতের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা কথা বলানোর চেষ্টা করেন তারা। এ সময় তুমি কেন হেফাজত করো, তুমি কেন এত লেখালেখি করো ইত্যাদি বলে চরম গালাগালসহ মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। তাদের কথা শুনে মনে হয়েছে, হেফাজত সম্পর্কে তাদের জ্ঞান কম।

ঢাকার লালবাগ থেকে আটক করলেও এই আলেমের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয় নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানায়। তিনি বলেন, স্বাভাবিকভাবেই আমাকে কেরানীগঞ্জ কারাগারে নেওয়ার কথা। কিন্তু সিআইডি কার্যালয় থেকে জানানো হয়, আপনার নামে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় মামলা দেওয়া হবে, নারায়ণগঞ্জ থেকে পুলিশ আসবে নিতে।

তার নামে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় ভাঙচুরসহ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের দুটি মামলা দেওয়া হয়। তবে তাকে ওই থানায় না নিয়ে নেওয়া হয়েছিল নারায়ণগঞ্জ সিআইডি অফিসে। সেখান থেকেই মামলার পর নেওয়া হয় কোর্ট গারদে। সেখানকার অবস্থা আরো ভয়াবহ। সেখানে যে আসামিদের রাখা হয়েছিল, তাদের দেখে মনে হচ্ছিল আমার ওপর হামলে পড়বে। ভেতরে ঢোকার পর কিছুটা স্বাভাবিক হই। এই যুগেও এ রকম গারদ কীভাবে থাকে? রাজনৈতিক নেতারাও তো জেলে গারদে যান, তারাও বিষয়গুলো দেখেন, কিন্তু কোনো প্রতিকারের ব্যবস্থা করেন নাÑ এটা দুঃখজনক। সারাদেশের গারদেই একই অবস্থা।

গারদ থেকেই নারায়ণগঞ্জ কারাগারে নেওয়া হয় মাওলানা এহসানুল হককে। সেখানে ঢোকার পর জানতে পারেন যে তার বিরুদ্ধে দুটি মামলা দেওয়া হয়েছে। সেখানে প্রথমে কোয়ারেন্টাইন হিসেবে ব্যবহৃত ‘রজনী’ নামের কক্ষে রাখা হয় তাকে। যে রুমে ৩০-৩৫ জন থাকতে পারেন, সেখানে ছিলেন ৭০-৮০ জন। প্রচণ্ড গাদাগাদি করে তাকে সেখানে থাকতে হয়। এই পরিবেশেই ১৪ দিন থাকতে হয় তাকে। সেখানে ২৪ ঘণ্টা সম্পূর্ণ লকআপে রাখা হয়। দুটি বাথরুমের একটি ছিল নষ্ট।

১৪ দিন পর তাকে দুদিনের রিমান্ডে নেয় সিআইডি। সেই এসপি হারুনের মুখোমুখি করা হয় তাকে। তিনি তাকে দিয়ে বলানোর চেষ্টা করেন, সিদ্ধিরগঞ্জে যে সংঘাত ঘটেছে, তা হেফাজতের নির্দেশে করা হয়েছে। কী নির্দেশনা ছিল তা জানতে চান তিনি। একপর্যায়ে সাদা কাগজ দিয়ে বিষয়গুলো লিখতে বলা হয়। এ সময় তিনি তার ইচ্ছামতো লেখেন, তিনি জীবনে সিদ্ধিরগঞ্জ আসেননি, এসব ঘটনার সঙ্গে তার কোনো সম্পর্কও নেই। এতে তারা আবার তার সঙ্গে খারাপ আচরণ শুরু করেন। এভাবে দুদিন রিমান্ডের পর আবার কারাগারে নেওয়া হয়। আবার ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়।

তিনি বলেন, হেফাজত নেতাদের সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী তার যে ‘কেস কার্ড’ ছিল সেখানে এক কর্নারে লাল কালি দিয়ে সন্ত্রাস লেখা থাকত। এতে তারা স্বাভাবিক কোনো সুবিধা পেতেন না। এর মধ্যে টাকার বিনিময়ে ফোন করা, পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ, লকআপ খোলা রাখার সুযোগ ছিল না তাদের। সব সময় লকআপে রাখা হতো।

মাওলানা এহসানুল হক বলেন, কারাগারে এমন অবস্থায় থাকত, রাতে ঘুমানো শেষে সকালে বালিশ নাড়া দিলে প্রচুর ছারপোকা বের হতো। একটা বাথরুমে দিনে দুই ঘণ্টার জন্য পানি আসত। সব কাজ দ্রুত শেষ করতে হতো। চারজন করে কথা বলতে দেখলেও তারা খারাপ ব্যবহার করত। সাড়ে ৩ মাস বাইরের সব খবর থেকে তারা বিচ্ছিন্ন ছিলেন।

হেফাজতের আমির আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী মারা গেলে তা সেলের পেছন দিকের একটি জানালা দিয়ে এক নারীর মাধ্যমে জানতে পারেন। ইউনুস নামের একজন তার মা মারা যাওয়ার দেড় মাস পর সংবাদ পান। স্বাভাবিকভাবে বন্দিরা মা-বাবা মৃত্যুর পর প্যারোলে মুক্তির সুযোগ পেলেও হেফাজতের নেতারা সংবাদও পাননি।

কারা নির্যাতনের একপর্যায়ে দুই মাসের মাথায় হাইকোর্ট থেকে জামিন পেলে মুক্তির জন্য দিন গুনছিলেন তিনি। প্রক্রিয়া শেষে বের হওয়ার সময় জেলগেট থেকে আবার তাকে আটক করে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তখন নতুন করে আরও চারটি মামলা দেওয়া হয়। সেই মামলাগুলোর জামিন নিয়ে মুক্তির পর আবারও একইভবে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।

এভাবে তিন দফায় জেলগেট থেকে ফেরত দেওয়া হয় তাকে। জামিন আটকাতে আদালতেও কাগজ আটকে রাখা হয় বহু দিন। তার মামলার সংখ্যা দাঁড়ায় ১০টিতে। এসব মামলায় সিআইডিতে চার দিন, ডিবিতে দুদিন এবং পিবিআইতে এক দিনসহ সাত দিনের রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয় এই আলেমের ওপর।

এভাবে ১১ মাস দুদিন কারা নির্যাতনের পর অবশেষে ২০২২ সালের ২ জুলাই জামিনে মুক্তি পান তিনি। তবে এসব মামলা চালাতে তার বিপুল অঙ্কের টাকা খরচে পরিবার চরম ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

মুক্তির পরও গত ৫ আগস্টের আগ পর্যন্ত তার জীবনযাত্রা স্বাভাবিক ছিল না। মুক্তির কিছুদিনের মাথায় তাকে এনএসআই কার্যালয়ে ডেকে নানা বিষয়ে সতর্ক করা হয়। এ সময় মাসে অন্তত ১০ দিনই আদালতে কাটাতে হয় মামলার হাজিরা দিতে। ৫ আগস্টের পরও হাজিরা দিতে হয়েছে তাকে। বর্তমানে হাজিরা শিথিল হয়েছে, মামলাগুলো থেকে অব্যাহতি দেওয়ার প্রক্রিয়াও চলছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

এমবি

মাওলানা মুহিবুল্লাহ মাদানি নিখোঁজ, সন্দেহের তীর ইসকনের দিকে

সাবেক চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন তালুকদারের মৃত্যুতে লন্ডন বাংলা প্রেস ক্লাবের শোক

রাবাদার রেকর্ডে স্বস্তিতে প্রোটিয়ারা

যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায় ট্রাম্প-বিরোধী বিক্ষোভ নিয়ে খামেনির উপহাস

হোয়াইট হাউসে বলরুম নিয়ে রহস্য, নির্মাণে টাকা দিচ্ছে কারা

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত