আমুর জমজমাট ভবন এখন ভূতের বাড়ি

শফিউল আজম টুটুল, ঝালকাঠি
প্রকাশ : ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১: ৩১

কয়েক মাস আগেও ঝালকাঠি শহরের রোনালসে রোডে অবস্থিত আমির হোসেন আমুর বাড়ি সব সময়ই থাকত জমজমাট। তার বাড়িকে কেন্দ্র করে পুরো সড়কটি ছেয়ে থাকত বড় বড় ফেস্টুনে। এসব ফেস্টুনে শোভা পেত তার বড় বড় ছবি।

বিজ্ঞাপন

আমির হোসেন আমু যখন ঢাকা থেকে এসে ঝালকাঠির এই বাসায় অবস্থান করতেন, পুলিশ তখন এই ব্যস্ত সড়কটিতে যান চলাচল বন্ধ করে দিত। জেলার সব পর্যায়ের আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা মগ্ন থাকত আমু বন্দনায়। এ বাসায় কর্মীরা তার পছন্দের খাবার নিয়ে আসত। আমির হোসেন আমুর পছন্দের খাবারের মধ্যে অন্যতম ছিল মধু এবং কাঁচা ছানা। কোনো অনুষ্ঠানে গেলেও আয়োজকরা খাবার মেনুতে এ দুটি আইটেম রাখতে কখনও ভুলে যেতেন না।

জনশ্রুতি আছে এ বাসায়ই হতো টেন্ডার-বাণিজ্য ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের মনোনয়ন বাণিজ্যের লেনদেন। কখনও তিনি টাকা ঢাকা নিয়ে যেতেন আবার কখনও এ বাসায়ই রেখে যেতেন। কিন্তু বিধি বাম শেষ বারের টাকা আর ঢাকা নিয়ে যেতে পারেননি।

বলছিলাম ঝালকাঠি তথা দক্ষিণাঞ্চলের আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী কেন্দ্রীয় নেতা ঝালকাঠি-২ আসনের সাবেক এমপি আমির হোসেন আমুর কথা। আমার দেশ-এর অ্যাসাইনমেন্ট পেয়ে গত ০৯ নভেম্বর রাতে শহরের রোনালসে রোডে আগুনে পোড়া বিধ্বস্ত আমুর বাসার সামনে দাঁড়াতেই গা কেমন শিউড়ে ওঠে।

রাতের আলো-আঁধারে বাড়িটির দিকে তাকালে মনে প্রশ্ন জাগে এটাই কি সেই জৌলুসপূর্ণ রাজপ্রাসাদ? যেখানে প্রজারা সর্বক্ষণ রাজা বন্দনায় লিপ্ত থাকত। আহা! এটাতো এখন কোনো রাজপ্রাসাদ নয়, এটাতো এখন ভূতের বাড়ি। পুরো বাড়িটির অবয়বে এখন ভৌতিক বাড়ির প্রতিচ্ছায়া।

বাড়িটি ঘুরে দেখা যায়, দ্বিতল ও তৃতীয় তলাবিশিষ্ট বিশাল দুটি ভবন নিয়ে এ বাড়িটির প্রতিটি কক্ষ আগুনে পোড়া। বাড়ির মধ্যে কোনো আসবাবপত্রই আর ব্যবহারযোগ্য নেই। এমনকি কক্ষের দরজা-জানালাও নেই। বাড়ির শুধু মেইন গেটটি অক্ষত রয়েছে। সেখানে জুলাই-আগস্টের গণহত্যার দায়ে আমির হোসেন আমুর ফাঁসির দাবিতে একটি ব্যানার টানানো রয়েছে।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে যাবার পরে ঝালকাঠির বিক্ষুব্ধ জনতা হামলে পড়ে আমির হোসেন আমুর বাসায়। এ সময় বাসায় কেউ ছিল না। বিক্ষুব্ধ জনতা রোনালসে রোডের এই বাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং ব্যাপক ভাংচুর করে। জনতার আগুনে পুরতে থাকে সাধারণ মানুষের মধ্যে পুষে থাকা ১৬ বছরের দানাবাঁধা ক্ষোভ। এ ক্ষোভের যেন কোনো শেষ নেই।

সন্ধ্যা নাগাদ আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও ঢুকতে দেয়নি জনতা। অবশেষে রাতে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা ভবনের আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। এ সময় ঘটে আরেক নাটকীয় ঘটনা। আগুন নেভাতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা কম্বলে মোড়ানো টাকা দেখতে পায়। ততক্ষণে অর্ধেক টাকাই পুড়ে যায় আগুনে।

এরপরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় নগদ ৫ কোটি টাকা ও ডলার। অসমর্থিত সূত্রে জানা যায়, টেন্ডার বাণিজ্য ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে প্রার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া টাকাই ওখানে রক্ষিত ছিল। ৫ আগস্টের পরে চার মাস পার হয়ে গেলেও এক সময়ের প্রভাবশালী এই নেতার বাড়িটি আগুনে পোড়া বিধ্বস্ত অবস্থায়ই রয়েছে।

জেলা শহরে নতুন কোনো অতিথি এলে এখন আমির হোসেন আমুর পোড়া বাড়ি না দেখে কেউ যান না। বাড়িটি ঘিরে এখন শুধুই পিনপতন নীরবতা ও স্তব্ধতা। সে যেন এক ভৌতিক পরিবেশ। ১৬ বছরের স্বৈরশাসনের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমির হোসেন আমুর এই বাড়ি। যে বাড়িকে এখন বলে সবাই ‘আমুর বাড়ি-ভূতের বাড়ি।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত