পর্যাপ্ত উৎপাদন-মজুত সত্ত্বেও অস্থির চালের বাজার

সরদার আনিছ
প্রকাশ : ০৬ আগস্ট ২০২৫, ০৯: ২৮

চলতি বছরে বোরো মৌসুমে ফলন, উৎপাদন ও মজুতে রেকর্ড সত্ত্বেও চালের বাজার অস্থির। বাজারে চাহিদার অনুপাতে সরবরাহ ব্যবস্থায় অনিশ্চয়তাকেই চালের দামের অস্থিরতা তৈরির পেছনে কাজ করছে বলে অভিযোগ করছেন খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, সরবরাহ ব্যবস্থায় সংকট তৈরি করে একশ্রেণির অসাধু মিলমালিক ও করপোরেট কোম্পানিগুলো উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে চালের বাজার অস্থির করে তুলছে।

কারওয়ান বাজার এলাকার সবচেয়ে বড় ব্যবসায়ী জনতা রাইস এজেন্সির স্বত্বাধিকারী হাজি আবু ওসমান আমার দেশকে বলেন, চালের বাজারে সিন্ডিকেট সক্রিয় থাকায় চাহিদা অনুপাতে সরবরাহ ব্যবস্থায় সংকট রয়েছে। বর্তমান বাজারে পাইজাম চালের সংকট চলছে।

বিজ্ঞাপন

চাঁদপুর রাইস এজেন্সির মালিক বাচ্চু মিয়া বলেন, কোনো কারণ ছাড়াই বড় কোম্পানিগুলো সিন্ডিকেট করে মাঝেমধ্যে চালের সরবরাহ ব্যবস্থায় সংকট তৈরি করে দাম বাড়ায়। যদিও তারা বলছেন ধানের দাম বাড়ার কথা। তিনি বলেন, সরকারিভাবে চালের মোকাম, তথা বড় বড় মিলে অভিযান না করে খুচরা বাজারে দাম মনিটরিং করা হয়। এটা সঠিক পদ্ধতি নয়। এছাড়া তিনি বেশি করে চাল আমদানি বাড়ানোর ওপর জোর দেন।

ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন আমার দেশকে বলেন, চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হলেও বেশির ভাগ ব্যবসায়ী চাল আমদানি করেন না। এর মানে ব্যবসায়ীদের হাতে পর্যাপ্ত চাল মজুত আছে এবং তা উচ্চমূল্যে বিক্রি করতেই সরবরাহে সংকট তৈরি করা হচ্ছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি মৌসুমে প্রায় ৫০ লাখ হেক্টর ৬৯ হাজার ৪০০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে, লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় দুই কোটি ২৬ লাখ দুই হাজার ২০০ টন। ফলন হয়েছে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও ছয় হাজার টন বেশি, যা গত অর্থবছরের তুলনায় ১৬ লাখ টন বেশি।

অন্যদিকে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২৯ জুলাই পর্যন্ত সরকারি গুদামে মোট খাদ্যশস্যের মজুতের পরিমাণ ২০ লাখ ৭৩ হাজার ২৬৩ টন। এর মধ্যে চালের পরিমাণ ১৮ লাখ ১৯ হাজার ৫১২ টন। এছাড়া এক লাখ ২১ হাজার ৩০৮ টন ধান এবং এক লাখ ৭৫ হাজার টন গম মজুত রয়েছে। সরকারি গুদামগুলোতে ধান, চাল ও গমÑখাদ্যের মজুতে নতুন রেকর্ড গড়েছে। গত বছর এ সময়ে মজুত ছিল ১৬ লাখ টনের মতো। মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, এবার ধান ও চালের সংগ্রহ ১৫ লাখ টন ছাড়িয়ে যেতে পারে। তিন লাখ টন ধানের পাশাপাশি সাড়ে ১৪ লাখ টন চাল (সেদ্ধ) সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে সরকার।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (মনিটরিং ও বাস্তবায়ন) ড. জামাল উদ্দীন আমার দেশকে বলেন, উচ্চ ফলনশীল (উফশী) জাতের আবাদের ফলে ক্রমেই ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এদিকে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশে অন্যান্য পণ্যের দাম কমায় মূল্যস্ফীতি কমে এলেও চালের দাম কমেনি, বাড়তি চাপ যোগ করছে মূল্যস্ফীতিতে। জিইডির জুলাই মাসের ইকোনমিক আপডেট অ্যান্ড আউটলুকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর থেকে মূল্যস্ফীতি ধারাবাহিকভাবে কমছে। ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারির পর প্রথমবারের মতো গত জুন মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের নিচে এবং খাদ্যে মূল্যস্ফীতি কমে ৮ শতাংশের নিচে নেমেছে। এতে সাধারণ ভোক্তারা কিছুটা স্বস্তিতে থাকলেও চালের দামে অস্বস্তি রয়েছে।

খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে চালের অবদান মে মাসের ৪০ শতাংশ থেকে বেড়ে জুনে ৫০ শতাংশে পৌঁছেছে। জুনে সব ধরনের চালেই মূল্যস্ফীতি ১৫ শতাংশে পৌঁছে, শুধু মাঝারি মানের চালই খাদ্য মূল্যস্ফীতিতে ২৫ শতাংশ অবদান রেখেছে। আর মোটা চালের অবদান ছিল ১৭.৮২ শতাংশ। জুলাই মাসে মাঝারি চালের দাম আরো বেড়েছে, যা বড় উদ্বেগের কারণ সংশ্লিষ্টদের।

মজুতে রেকর্ড সত্ত্বেও চালের দাম ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় কয়েক মাস ধরে অব্যাহতভাবে বেড়েই চলেছে চালের মূল্যস্ফীতি। বোরো ধানের ফলনও চালের দামে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। চালের দাম নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাজার পরিস্থিতির ওপর নিবিড়ভাবে নজর রাখা জরুরি।

সরকারি ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর গতকাল সোমবার বাজার দরে তালিকা অনুযায়ী বর্তমানে সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৭৫ থেকে ৮৫ টাকা কেজি, যা গত এক মাসে দাম না বাড়লেও গত বছরের এ সময়ের তুলনায় ১৫ দশমিক ৯৪ শতাংশ বেশি। মাঝারি মানের চাল বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৭৫ টাকা কেজি, যা এক মাসের ব্যবধানে বেড়েছে ৮ শতাংশ আর গত বছরের এ সময়ের তুলনায় ২০ দশমিক ৫৪ শতাংশ বেশি। আর মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা কেজি, যা গত এক মাসে দাম না বাড়লেও গত বছরের এ সময়ের তুলনায় ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি।

খাদ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (সংগ্রহ বিভাগ) মনিরুজ্জামান আমার দেশকে বলেন, রেকর্ড পরিমাণ বোরো সংগ্রহ এবং মজুতও ভালো। বেসরকারিভাবে চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সরকারিভাবেও চাল আমদানি করা হচ্ছে। এছাড়া ১৫ আগস্ট থেকে ওএমএস এবং খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি শুরু হচ্ছে, যা চার মাস চলবে। এতে আশা করা যায়, চালের বাজার স্থিতিশীল থাকবে।

সম্প্রতি কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, চাল আমদানি ও অভ্যন্তরীণ ফলন ভালো হলেও বাজারে দাম বাড়তি। সরকার চালের বাড়তি দর নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে।

সম্প্রতি খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার বলেন, চালের দাম কিছুটা বেড়েছে। আর যেন না বাড়ে, তা নিয়ে নজরদারি চলছে। এছাড়া আগস্ট থেকে চালু হচ্ছে সরকারের খাদ্যবান্ধব কর্মসূচি। এতে দেশের ৫৫ লাখ পরিবার ১৫ টাকা করে প্রতি মাসে ৩০ কেজি করে চাল পাবে ছয় মাস ধরে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত