ভোলায় অগ্রণী ব্যাংকের শাখায় ব্যাপক দুর্নীতি

ইউনুছ শরীফ, ভোলা
প্রকাশ : ১৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৩: ৪৯

ভোলার কালীনাথ রায়ের বাজার অগ্রণী ব্যাংক পিএলসি শাখায় কৃষিঋণ বিতরণকে ঘিরে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। একাধিক সূত্র জানিয়েছে, শাখার ব্যবস্থাপক ও সংশ্লিষ্ট কিছু কর্মকর্তা কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে নিয়ম ও সক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে ঋণ বিতরণ করছেন।

অভিযোগ রয়েছে- একই ব্যক্তিকে একাধিকবার ঋণ দেওয়া, একই জাতীয় পরিচয়পত্রে একাধিক ঋণ অনুমোদন এবং প্রতিটি ঋণ প্রদান প্রক্রিয়ায় ১০ শতাংশ কমিশন গ্রহণ এখন নিয়মে পরিণত হয়েছে। ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রেও অনিয়ম ও জালিয়াতির অভিযোগ পাওয়া গেছে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনুসন্ধানেও এসব অনিয়মের প্রমাণ মিলেছে বলে জানা গেছে।

বিজ্ঞাপন

সক্ষমতার বাইরে ঋণ বিতরণ

সূত্রমতে, শাখাটির মোট আমানত ১৫ কোটি টাকা, যার সর্বোচ্চ ৮০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১২ কোটি টাকা পর্যন্ত ঋণ বিতরণের অনুমোদন রয়েছে। অথচ বাস্তবে ওই শাখা ৫২ কোটি টাকারও বেশি ঋণ বিতরণ করেছে, যা আমানতের প্রায় ৩৫৭ শতাংশ। বিষয়টি নিয়ে পূর্ণাঙ্গ তদন্তের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় কৃষক ও ভুক্তভোগীরা।

দালালদের মাধ্যমে ঋণ বাণিজ্য

পুরোনো ঋণ আদায় না করেই প্রতি সপ্তাহে ইউনিয়নভিত্তিক দালালদের মাধ্যমে ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা নতুন ঋণ বিতরণের অভিযোগ রয়েছে। এ কাজে যুক্ত রয়েছেন বহিরাগত কয়েকজন এজেন্ট- ভেদুরিয়ার সিদ্দিকুর রহমান, পাতা ভেদুরিয়ার ইউসুফ, চরকালির জাহানারা বেগমসহ আরো অনেকে।

অভিযোগ রয়েছে, ঋণগ্রহীতাদের কোনোরকম যাচাই-বাছাই, অনুমোদন, ফাইল প্রক্রিয়া এবং মাঠপর্যায়ের পরিদর্শন ছাড়াই ‘ম্যানুয়াল তালিকা’ ও ব্যক্তিগত পরিচয়ে ঋণ অনুমোদন করা হচ্ছে। প্রতিটি ঋণ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার টাকা কমিশন কাটা হয়—এর মধ্যে তিন হাজার টাকা শাখা ব্যবস্থাপকের, এক হাজার টাকা জোনাল অফিসে পাঠানো হয় এবং বাকি টাকা দালালদের হাতে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে।

অনুমোদনবিহীন ‘ফিল্ড রিপ্রেজেন্টেটিভ’

অগ্রণী ব্যাংক পিএলসি কালীনাথ রায়ের বাজার শাখা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ছিদ্দিকুর রহমান, ইউসুফ, জাহানারা বেগম, মিজানুর রহমান, সুমী নন্দী ও আব্দুল মালেক কবিরাজ নামের কয়েকজন ব্যক্তি ‘ফিল্ড রিপ্রেজেন্টেটিভ’ হিসেবে কাজ করছেন। তবে তারা কেউই অগ্রণী ব্যাংকের আনুষ্ঠানিক কর্মচারী নন।

স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব দালাল কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে ব্যাংকের বাইরে লেনদেন করছেন, ফলে প্রকৃত কৃষকরা ঋণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। শুধু কিছু মধ্যস্বত্বভোগী লাভবান হচ্ছেন।

অকৃষকরাও পাচ্ছেন কৃষিঋণ

বাণিজ্যিক ঋণ না দিয়ে অনেক ক্ষেত্রেই কৃষক নন এমন ব্যক্তিদের ‘কৃষিঋণ’ হিসেবে অর্থ বিতরণ করা হচ্ছে। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে ভোলা পৌরসভার পৌরনবীপুর এলাকার রিপনচন্দ্র মজুমদার ৪৫ হাজার টাকা, আর ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে ভোলা পৌরসভার তিনখাম্বা এলাকার সেলিনা বেগম ও আবদুর রহিম শিকদার যথাক্রমে ৬৮ হাজার ও ৫৮ হাজার টাকার কৃষিঋণ পেয়েছেন। জানা গেছে, এদের কেউই কৃষক নন। এ ধরনের অনেকের তথ্য এ প্রতিবেদকের সংগ্রহে রয়েছে।

নির্ধারিত এলাকার বাইরে ঋণ বিতরণ

অগ্রণী ব্যাংক ভোলা আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক গণেশ চন্দ্র দেবনাথ স্বাক্ষরিত বরাদ্দপত্র অনুযায়ী, কালীনাথ রায়ের বাজার শাখার ঋণ বিতরণ এলাকা হচ্ছে বাপ্তা, ভেদুরিয়া ও ভেলুমিয়া ইউনিয়ন। কিন্তু নির্ধারিত এলাকায় ঋণ না দিয়ে ভোলা পৌরসভাসহ অন্যান্য এলাকাতেও ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। যার বেশ কিছু তথ্য এই প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত রয়েছে।

দুর্নীতি ঢাকতে একাধিক ঋণ ফাইল নিখোঁজ

২০২৪ সালের ২৮ জুলাই ভোলা জোনাল অফিসের পরিদর্শন প্রতিবেদনে দেখা যায়, এই শাখার আওতাধীন বাপ্তা ইউনিয়নের ১৯টি কৃষিঋণের ফাইল নিখোঁজ। স্থানীয়ভাবে অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, ভেদুরিয়া ও বাপ্তা ইউনিয়নের মোট প্রায় ১৫০টি ফাইল হারিয়ে গেছে। অভিযোগ আছে- দালালদের সহযোগিতায় অনিয়মের তথ্য গোপন করতে এসব ফাইল সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

অনিয়ম-দুর্নীতির সীমাহীন অভিযোগ

তিন বছর ধরে এভাবেই ঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন শাখা ব্যবস্থাপক খায়রুল বাশার পাভেল। বিনিময়ে ১০ শতাংশ কমিশন নিয়ে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন তিনি। জোনাল অফিসের সহকারী ব্যবস্থাপক গণেশ চন্দ্র দেবনাথকে ম্যানেজ করে খায়রুল বাশার বিগত তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে অবাধে দুর্নীতি চালিয়ে যাচ্ছেন।

এছাড়া বরিশাল সার্কেল অফিসে তার নিজস্ব লোকজন রয়েছে- যারা কৃষি ঋণের উৎকোচের টাকা মাসিক হিসাবে ভাগ পান। ফলে তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান করেন বলে জানিয়েছেন কালিনাথ বাজারের একাধিক ব্যবসায়ী। তারা বলেন, শুধু গত আগস্টেই ভেদুরিয়াতে ১০ লাখ ও বাপ্তাতে ৯ লাখ টাকা ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। ঋণগুলো বিতরণে শুরু থেকে শেষ অবধি দুজন মাঠকর্মী ম্যানেজারের নির্দেশে দালালদের সহযোগিতা করেন।

সংশ্লিষ্টদের প্রতিক্রিয়া

অভিযোগ প্রসঙ্গে অগ্রণী ব্যাংক কালীনাথ রায়ের বাজার শাখা ব্যবস্থাপক খায়রুল বাশার পাভেল বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ তিন বছর আগের, বাংলাদেশ ব্যাংক তদন্ত করে ব্যবস্থা নিয়েছিল। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর কোনো অনিয়ম হয়নি।’ একই ব্যক্তির একাধিক লোন বা এ জাতীয় অভিযোগ সম্পূর্ণ বানোয়াট। তবে গরিব কৃষক লোন পরিশোধ করতে না পারলে তাকে ওই ঋণই পুনরায় ঘুরিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলে জানান খায়রুল বাশার পাভেল।

অগ্রণী ব্যাংকের ভোলা আঞ্চলিক কার্যালয়ের সহকারী ব্যবস্থাপক গণেশ চন্দ্র দেবনাথ এ ব্যাপারে জানান, এ জাতীয় অভিযোগ এখনো পাইনি। পেলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি স্বীকার করেন, নির্ধারিত এলাকার বাইরে কৃষিঋণ বিতরণের সুযোগ নেই।

চাহিদার অতিরিক্ত ঋণ বিতরণ সম্পর্কে তিনি বলেন, আগের ঋণসহ ৫২ কোটি টাকা স্থিতি রয়েছে এই শাখার। বাংলাদেশ ব্যাংকের দেওয়া টার্গেট পূরণ করতে এমনটি করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

বরিশাল সার্কেলের জেনারেল ম্যানেজার জাহিদ ইকবাল এ ব্যাপারে বলেন, ভোলার কালীনাথ রায়ের বাজার শাখার ব্যবস্থাপকের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত শেষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত