জাতীয় পার্টির একাংশের চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও জাতীয় পার্টির (জেপি) চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বে নতুন জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। গতকাল সোমবার রাজধানীর একটি পার্টি সেন্টারে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের কয়েক সঙ্গী মিলে ‘জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট (এনডিএফ)’ নামের নতুন এ জোটের ঘোষণা দেওয়া হয়।
তবে জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের পরিবার এই জোটের বাইরে রয়েছে। এরশাদের ভাই গোলাম মোহাম্মদ কাদেরের (জিএম কাদের) নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি এবং স্ত্রী রওশন এরশাদের নেতৃত্বাধীন অংশের কেউই এই জোটে নেই। নতুন এ জোটে জাতীয় পার্টি ছাড়া অন্য দলগুলোর প্রায় সবই নামসর্বস্ব।
নতুন এই জোটের চেয়ারম্যান হয়েছেন ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মুখপাত্র এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুকে প্রধান উপদেষ্টা করা হয়েছে। জোট গঠনের সময় লিখিত কাগজে ২০টি দল যুক্ত হওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা হলেও তারা মুখে বলেছে ১৮টি দল। তবে, যে ১৮টি দলকে জোটের অন্তর্ভুক্ত বলে প্রচার করা হয়েছে তার অন্তত দুটি জোটের সঙ্গে নেই বলে আমার দেশকে নিশ্চিত করেছে।
জোটে থাকা দলগুলো হলো—জাতীয় পার্টি, জাতীয় পার্টি (জেপি), জনতা পার্টি বাংলাদেশ, তৃণমূল বিএনপি, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম), বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, জাতীয় সংস্কার জোট, স্বাধীন পার্টি, জাতীয় স্বাধীনতা পার্টি, বাংলাদেশ সর্বজনীন দল, অ্যাপ্লায়েড ডেমোক্রেটিক পার্টি, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলন, ডেমোক্রেটিক পার্টি, জাসদ (শাহজাহান সিরাজ), ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক পার্টি, জাতীয় গণতান্ত্রিক লীগ ও গণফ্রন্ট। এর মধ্যে বাংলাদেশ মুসলিম লীগ ও গণফ্রন্ট জানিয়েছে তাদের দল নতুন জোটে যোগ দেয়নি। এই দল দুটির পক্ষ থেকে প্রতিবাদ জানিয়ে বলা হয়েছে, নতুন জোট গঠন প্রক্রিয়ার সঙ্গে ফ্যাসিস্টরা জড়িত। তাদের সঙ্গে জোট করার প্রশ্নই ওঠে না।
এদিকে জোট ঘোষণার সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেওয়ার কথা থাকলেও ছিল না বেশ কয়েকটি দল। সাংবাদিকদের কাছে সরবরাহ করা তালিকায় থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য থেকেও সংবাদ সম্মেলনে বেশ কয়েকটি দলের প্রতিনিধি ছিল না। দলগুলো হলো— বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, বাংলাদেশ মানবাধিকার পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় লীগ ও বাংলাদেশ জনকল্যাণ পার্টি। এর মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি ও বাংলাদেশ লেবার পার্টি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে তারা নতুন এ জোটে যুক্ত হয়নি।
নতুন এই জোটে জাতীয় পার্টি (জেপি) ছাড়া মুক্তিজোট, তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএমের নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধন রয়েছে। এর মধ্যে তিনটি দলই নিবন্ধন পেয়েছে শেখ হাসিনার সরকারের সময়ে। বিএনএমের নিবন্ধন প্রক্রিয়া নিয়ে ওই সময় ব্যাপক বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। এছাড়া তৃণমূল বিএনপি নিয়েও বড় ধরনের বিতর্ক হয়। অভিযোগ রয়েছে, হাসিনার আমলে বিএনপিকে বিভক্ত করতে দলটির এক সময়কার নেতা নাজমুল হুদাকে সামনে রেখে তৃণমূল বিএনপি গঠন করা হয়েছিল। দলটি গঠনের পেছনে সরকারের একটি সংস্থার বিশেষ ভূমিকা ছিল বলেও কথিত রয়েছে।
এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিও এই জোট গঠনের প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত জাতীয় পার্টির দুটি অংশই ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকারের দোসর ছিল। আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি (জেপি) ছিল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সক্রিয় সদস্য। ২০১৪ সালে বিনাভোটে এমপি নির্বাচিত হয়ে হাসিনা সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য হন এই আনোয়ার হোসেন। ২০১৮ সালেও তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট ও পরবর্তী ৩টি ‘অবৈধ’ সংসদ নির্বাচনে নির্বাচিত হন। জাতীয় পার্টি ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়ে শেখ হাসিনার সরকারকে বৈধতা দিয়েছিল। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ২০১৪ সালে সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য হন। সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদে নির্বাচিত হয়ে আনিসুল ইসলাম বিরোধী দলীয় উপনেতা মনোনীত হন।
এছাড়া এই জোটের সঙ্গে সম্পৃক্ত জাতীয় পার্টির (আনিস) নেতা মুজিবুল হক চুন্নু শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি ২০২৪ সালের নির্বাচনের পোস্টারে ‘জাতীয় পার্টি মনোনীত ও আওয়ামী লীগ সমর্থিত’ প্রার্থী হিসেবে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন। ওই নির্বাচনে জয়ের পর তিনি বিরোধী দলের চিফ হুইপ মনোনীত হন। এছাড়া জোটের মুখপাত্র এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদার ও তার স্ত্রী নাসরিন জাহান রত্নাসহ দলটির বেশ কয়েকজন নেতা হাসিনার সময়ে সংসদ সদস্য ছিলেন।
সংবাদ সম্মেলনে নতুন জোটের চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, এই জোট কেবল নির্বাচনি জোট নয়, এটি রাজনৈতিক জোট। আমাদের জোটে অংশগ্রহণকারীরা এতে সম্মতি দিয়েই অংশগ্রহণ করছে। দেশ যে বিভাজনের মাঝে আছে আমরা সে বিভাজন দূর করে একটি ঐক্যবদ্ধ রাজনীতি উপহার দেব।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা এখন পর্যন্ত বলিনি আওয়ামী লীগের কোনো নেতা বা কোনো ব্যক্তি ক্লিন ইমেজের হলে তাকে নির্বাচনে মনোনয়ন দেব। তবে আমরা এ বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।
জোট কোন প্রতীকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমাদের লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে এখনো মামলা চলমান। আমরা আশাবাদী আমরা লাঙ্গল প্রতীক পাব। তবে যদি কোনো কারণে প্রতীকটি না পাই, তবে আলোচনাসাপেক্ষে আমাদের সঙ্গে থাকা নিবন্ধিত অন্য দলগুলোর যে কোনো একটির প্রতীকে আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করব।
ইসিতে নিবন্ধিত জাতীয় পার্টির প্রতীক লাঙ্গল। বর্তমানে জিএম কাদেরের নেতৃত্বাধীন অংশের অনুকূলে প্রতীকটি সংরক্ষিত রয়েছে।
নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়ে আনিসুল ইসলাম মাহমুদ বলেন, সরকার এখনো নির্বাচনি পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি। নির্বাচন যদি আমরা ঠিকভাবে না করতে পারি, অতীতের নির্বাচনগুলোর ভুল থেকে যদি শিক্ষা নিতে না পারি, তাহলে কীভাবে সম্ভব? বর্তমান যে অবস্থা চলছে সে অবস্থা থাকলে এটি প্রকৃত একটি মব কালচারের নির্বাচন হবে। আর নির্বাচনে যদি অংশগ্রহণের মতো পরিবেশ না থাকে তাহলে আমরা হয়তো অংশগ্রহণই করব না।
তিনি আরো বলেন, আমরা আশা করি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক করে নির্বাচনকে সঠিকভাবে আয়োজন করা হবে। যাতে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হয়।
আনিসুল ইসলাম আরো বলেন, আমরা অনেক ভুল করেছি। আমরা দলীয়ভাবে সেই ভুলের জন্য ক্ষমাও চেয়েছি। কিন্তু একটা সরকারকে পালিয়ে যেতে হয় সেটি আমরা চাই না। একটা রাজনৈতিক দলকে নির্যাতিত হতে হয়, এটি আমরা চাই না।
জোট গঠন অনুষ্ঠানে তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব মেজর এসকে হাবিবুর রহমান, জাতীয় পার্টির (আনিস) নির্বাহী চেয়ারম্যান মুজিবুল হক চুন্নু, কো-চেয়ারম্যান শহীদুর রহমান টেপা, জাতীয় স্বাধীনতা পার্টির চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মিজু, বাংলাদেশ সার্বজনীন দলের সভাপতি নূর মোহাম্মদ, তৃণমূল বিএনপির দপ্তর সম্পাদক রহমান বাচ্চু আকন্দ, মুক্তিজোটের চেয়ারম্যান আবু লায়েস মুন্না, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের চেয়ারম্যান এআরএম জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ইউনাইটেড ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নারায়ণ কুমার দাস, ডেমোক্রেটিক পার্টি চেয়ারম্যান এস এম আশিক বিল্লাহ, এপ্লাইড ডেমোক্রেটিক পার্টির চেয়ারম্যান এম আর করিম, জাসদের (শাহজাহান সিরাজ) চেয়ারম্যান মোয়াজ্জেম হোসেন খান মজলিস, নুরুল ইসলাম ওমর প্রমুখ বক্তব্য দেন।
জোট ঘোষণার সময় ৭টি দাবি উত্থাপন করা হয়। দাবিগুলো হচ্ছে— অন্তর্বর্তী সরকারকে আগামী দুই মাসে নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকারে রূপান্তর; হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার; অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন; সংস্কার বাস্তবায়ন; জনগণের সম্মতিমূলক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন; আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ; মূল্যস্ফীতি; স্বনির্ভর অর্থনীতি, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান এবং দুর্নীতিমুক্ত, বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা।
এদিকে গণফ্রন্ট নতুন এই জোটের সঙ্গে নেই বলে আমার দেশকে নিশ্চিত করেছে। গণফ্রন্টের কার্যকরী সভাপতি আজমল হোসেন গতকাল আমার দেশকে বলেন, আমরা ওই জোটের সঙ্গে নেই। তাদের সঙ্গে নীতিগতভাবে আমরা একমত হলেও আমরা জোটভুক্ত হব না। বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (মতিন) মহাসচিব জাফর আহমেদ জয়ও একই কথা বলেন। তিনি জানান, তাদের দল ওই জোটে যুক্ত হয়নি।
বাংলাদেশ মুসলিম লীগের মহাসচিব কাজী আবুল খায়ের জোটে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করে আমার দেশকে দেওয়া এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, যারা এই জোট গঠন করেছে তাদের বেশিরভাগই ফ্যাসিস্টদের সুবিধাভোগী। তাদের অংশও ছিল। আমরা ফ্যাসিস্ট বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম। কাজেই ফ্যাসিস্টদের কোনো জোটে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। জোটের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে তাদের দলের নেতা মহসিন রশীদের যোগদানের প্রশ্নে দলটির মহাসচিব বলেন, দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে তিনি ওই অনুষ্ঠানে গিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। তার দল সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে বিষয়টির প্রতিবাদ জানিয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

