দেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর আয়কে করের আওতায় আনার প্রস্তাব করেছে আয়কর আইন সংশোধনের গঠিত টাস্কফোর্স কমিটি। বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলোর সব ধরনের আয়করমুক্ত সুবিধার আওতায় রয়েছে।
অর্থাৎ দলগুলোর আয় করযোগ্য হলেও কোনো ধরনের কর দিতে হয় না। আয়কর অব্যাহতির সুযোগের কারণে জনগণের কাছে রাজনৈতিক দলগুলোর জবাবদিহির পথ রুদ্ধ হয়েছে বলে মনে করছে টাস্কফোর্স কমিটি। অন্যদিকে বৈষম্য কমাতে প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী, সংসদ সদস্য, প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের আয়ের ক্ষেত্রে বিদ্যমান কর অব্যাহতির সুবিধা কমানোর সুপারিশ করেছে আয়কর সংস্কারে গঠিত টাস্কফোর্স কমিটি।
২০১১ সালের অক্টোবর মাসে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সব আয়কে শর্তহীনভাবে আয়কর থেকে অব্যাহতি দিয়ে একটি এসআরও জারি করে এনবিআর। সে এসআরও রহিত করার পক্ষে মত দিয়েছে টাস্কফোর্স।
অর্থনীতিবিদরা জানান, কোনো প্রতিষ্ঠানকে আয়কর অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণত তিনটি বিষয় বিবেচনায় নেওয়া হয়। কর্মসংস্থান তৈরিতে বড় ধরনের ভূমিকা, অর্থনৈতিক অবদান ও গুরুত্ব বিবেচনার পাশাপাশি কোনো দুর্যোগ পরিস্থিতির কারণে উদ্ভূত প্রতিকূল অবস্থা উত্তরণে সহায়তা হিসেবে আয়কর সুবিধা দেওয়া যায়। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো এর কোনো শর্তই পূরণ করে না। সেজন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে আয়কর সুবিধা দেওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
টাস্কফোর্স রাজনৈতিক দলগুলোর আয়কর সুবিধা বাতিলের পক্ষে চারটি যৌক্তিকতা তুলে ধরেছে। প্রথম দুটি কারণ হিসাবে বলা হয়েছেÑ আয়কর সুবিধার কারণে জনগণের কাছে রাজনৈতিক দলের জবাবদিহির পথ রুদ্ধ হয়েছে এবং নির্দিষ্ট শ্রেণির করদাতাদের কর সুবিধা দেওয়ার জন্য এ সুবিধা দেওয়া হয়েছে। তবে বাকি যে দুটি কারণে আয়কর সুবিধা বাতিল করা দরকার বলে মনে করছে টাস্কফোর্স সেগুলো হচ্ছেÑ অর্থ পাচার ও কালোটাকা সাদা করার সুযোগ তৈরি হওয়া ও দুর্নীতির অভিযোগ।
এ বিষয়ে টাস্কফোর্সের একজন সদস্য আমার দেশকে বলেন, আয়কর অব্যাহতি দেওয়ার কারণে রাজনৈতিক দলগুলোর আয়কর রিটার্ন জমা দিলেও সেগুলো যাচাই করার কোনো সুযোগ নেই। যেহেতু তাদের কোনো ধরনের আয়কর দিতে হয় না, সে জন্য আয়কর রিটার্নের তথ্যগুলো সঠিক কি না, সেটা যাচাইয়ের বাধ্যবাধকতা থাকে না। কিন্ত আয়কর অব্যাহতি না থাকলে সেটা এনবিআরের যাচাই-বাচাই করার সুযোগ তৈরি হবে।
ফলে রাজনৈতিক দলগুলোকে কারা অর্থায়ন করছে, অর্থের উৎস এসব তথ্য যাচাই করা যাবে। এতে রাজনৈতিক দলগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি তৈরি হবে। তিনি আরো বলেন, বর্তমানে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশনে যে আয়-ব্যয়ের তথ্য জমা দেয় এনবিআরের কাছে একই তথ্য দিয়ে রিটার্ন দাখিল করে। কিন্তু সেসব তথ্যের যথার্থতা যাচাই করে দেখা হয় না।
উল্লেখ্য, গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বর আয়কর আইন, ২০২৩ সংস্কারসংক্রান্ত সাত সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। আইনটির মূল ধারা, সংশ্লিষ্ট বিধি, প্রজ্ঞাপন ইত্যাদি অধিকতর ব্যবসা ও জনবান্ধব এবং মাঠপর্যায়ে প্রয়োগ সহজতর করার লক্ষ্যে টাক্সফোর্স গঠন করা হয়।
কর অঞ্চল-৬-এর কর কমিশনার ইখতিয়ার উদ্দিন মোহাম্মদ মামুনকে টাস্কফোর্সের আহ্বায়ক এবং কর অঞ্চল-১৪-এর পরিদর্শী রেঞ্জের যুগ্ম কর কমিশনার অমিত কুমার দাসকে সদস্য সচিব করা হয়। অন্য সদস্যরা হলেন- এনবিআরের প্রথম সচিব (করবিধি) এম এম জিল্লুর রহমান, কর অঞ্চল-১৯-এর কর কমিশনার (চলতি দায়িত্ব) ড. লুৎফুর নাহার বেগম, বিসিএস কর একাডেমির পরিচালক হাফিজ আল আসাদ, কর আপিল অঞ্চল-২-এর যুগ্ম কর কমিশনার তাপস কুমার চন্দ এবং কর অঞ্চল-১৪-এর পরিদর্শী রেঞ্জের যুগ্ম কর কমিশনার মহিদুল ইসলাম চৌধুরী। টাস্কফোর্স ইতোমধ্যে তাদের প্রস্তাব সুপারিশ আকারে এনবিআরের চেয়ারম্যানের কাছে জমা দিয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি বছর নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো তাদের আয়-ব্যয়ের নিরীক্ষিত হিসাব নির্বাচন কমিশনে জমা দিতে হয়। এই বিধানে আয়-ব্যয়ের খাতও উল্লেখ করতে হয়। নিয়মের মধ্যে থাকলেও আয়-ব্যয়ের হিসাব সাধারণত নির্বাচন কমিশন খতিয়ে দেখে না।
নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রতি বছরের ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে আগের পঞ্জিকা বছরের আয়-ব্যয়ের হিসাব ইসিতে জমা দিতে হয়। এ ছাড়া নির্বাচনের জন্য প্রার্থী মনোনয়নকারী প্রত্যেক রাজনৈতিক দলকে সব নির্বাচনি এলাকার নির্বাচন সমাপ্ত হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে প্রার্থীদের নির্বাচনসংক্রান্ত সব ব্যয় বা অনুমোদিত ব্যয়ের হিসাব কমিশনে দাখিল করতে হয়।
জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আমার দেশকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে কে অনুদান দিচ্ছে, কত অনুদান দিচ্ছে তার কোনো স্বচ্ছতা নেই। রাজনৈতিক দলগুলো সুশাসন, জবাবদিহির কথা বলে। সে কারণে দলগুলোর আয়-ব্যয়ের মধ্যে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা জরুরি।
পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাশরুর রিয়াজ বলেন, দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠার একটা প্রয়াস দেখা যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো যেহেতু সরকার গঠন করে সেজন্য তাদের মধ্যে স্বচ্ছতা থাকা জরুরি। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে রাজনৈতিক দলগুলোকেও জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো সারা বছরই নানা ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে। কিন্তু এর সঠিক হিসাব তারা প্রকাশ করে না। ফলে এখানে কালোটাকার একটা প্রভাব থেকে যায়। তারা যে হিসাব নির্বাচন কমিশনে জমা দেয় তার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। গণতন্ত্রের স্বচ্ছতা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। আবার ক্ষমতার পালাবদলে রাজনৈতিক হয়রানির শিকার হওয়ার একটা আশঙ্কা থাকার কারণে অনেকেই রাজনৈতিক দলগুলোকে তহবিল জোগান দেওয়ার বিষয়টি গোপন রাখতে চান। এ ধরনের সংস্কৃতির পরিবর্তন হওয়া জরুরি বলে তারা মনে করেন।
তবে রাজনৈতিক দলগুলোতে যারা ফান্ডিং করে থাকে তাদের বিষয়টি কখনো জনসম্মুখে প্রকাশ করা হয় না। ফলে এ নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনা রয়েছে। অনেকের ধারণা, রাজনৈতিক দলগুলোকে দেওয়া ফান্ডের একটি বড় অংশই জোগান দেয় কালোটাকার মালিকরা। দলগুলো আয়ের উৎস হিসেবে সদস্যদের চাঁদা এবং শুভানুধ্যায়ীদের অনুদানকেই আয়ের খাত হিসেবে দেখিয়ে থাকে। এ ছাড়া সম্পদ, প্রকাশনাসহ নানা খাত থেকে আয় করে থাকে দলগুলো।
বাংলাদেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল এখন ৫৪টি। এর মধ্যে ১০টি নিবন্ধন পেয়েছে ২০২৩, ২০২৪ ও ২০২৫ সালে। তবে এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ২০১৩ সালের আগস্টে জামায়াতের প্রতীক এবং নিবন্ধন বাতিল করে। ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন কশিমন এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
ফলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেলেও জামায়াতের কোনো নিবন্ধন নেই। নিবন্ধন ও প্রতীক বাতিলের বিরুদ্ধে জামায়াত আপিল করেছে। ঈদের পর আপিল বিভাগে শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। এদিকে আগামী ২০ এপ্রিল নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের শেষ সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এবার নতুন দল হিসেবে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) নিবন্ধনের বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী, বিচারকদের কর অব্যাহতি সুবিধা কমানোর প্রস্তাব
প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রী, ডেপুটি স্পিকার, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, সংসদ সদস্যদের মূল বেতন ও সম্মানী ব্যতীত সব সুবিধার ওপর কর অব্যাহতি সুবিধা দেওয়া হয়েছে। ২০১১ সালের জুলাই মাসে এসআরও জারির মাধ্যমে এ সুবিধা দেওয়া হয়। মূল বেতন ও সম্মানীর পাশাপাশি উৎসব ভাতাকেও আয়করের আওতায় আনার সুপারিশ করেছে টাস্কফোর্স। এতে করসাম্য প্রতিষ্ঠা হবে বলে মনে করছে তারা।
প্রধান বিচারপতি, সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের মূল বেতন ব্যতীত সব সুবিধার ওপর কর অব্যাহতি সুবিধা রয়েছে। করসাম্য প্রতিষ্ঠায় মূল বেতন, সম্মানী ও উৎসব ভাতাকে করযোগ্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে আয়কর সংস্কারে।

