বিটিআরসিতে নজিরবিহীন দুর্নীতি-অনিয়ম, থমকে তদন্ত

আবু সুফিয়ান
প্রকাশ : ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ০৮: ৪৯

বাংলাদেশের টেলিকম খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে (বিটিআরসি) নজিরবিহীন নিয়োগ, দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। বিগত সরকারের আমলে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ২০১৬-১৭ ও ২০১৯-২০ সালে কোনো স্বচ্ছ প্রক্রিয়া ছাড়াই ২৯ কর্মকর্তাকে নিয়োগের ঘটনা ঘটে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা পর্যায়ে একসঙ্গে এত বড় অবৈধ নিয়োগ অনেকটাই বিরল ঘটনা।

সম্প্রতি টেলিযোগাযোগ, বিজ্ঞান, তথ্য এবং প্রযুক্তি (পিটিএসটি) অডিট অধিদপ্তর কর্তৃক পরিচালিত একটি অডিট রিপোর্টে এ নিয়োগ দুর্নীতির বিষয়টি ধরা পড়ে। প্রতিবেদনটি আমার দেশ-এর হাতে এসেছে।

বিজ্ঞাপন

এ ঘটনা তদন্তে সম্প্রতি বিটিআরসির মহাপরিচালক (এলএল) আশিষ কুমারকে কুন্ডুকে সভাপতি করে সাত সদস্যবিশিষ্ট একটি অভ্যন্তরীণ কমিটি করা হয়েছে। ৬০ দিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে হবে এ কমিটিকে।

গত ২০ এপ্রিল একটি টাস্কফোর্সও গঠন করেছে সরকার। টেলিকম সেক্টরে জনবল নিয়োগ, পদোন্নতি, প্রকল্প বাস্তবায়ন, লাইসেন্স ব্যবস্থাপনা, পরামর্শক নিয়োগ, নীতিগত বৈষম্য ও সামাজিক দায়বদ্ধতা তহবিল ব্যবস্থাপনাসহ সম্ভাব্য অনিয়ম ও দুর্নীতির দিকগুলো পর্যালোচনা করবে এ টাস্কফোর্স। এর আহ্বায়ক করা হয়েছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের অধ্যাপক ড. কামরুল হাসানকে। অন্য সদস্যরা হলেন— ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইইই বিভাগের অধ্যাপক ড. মোসাব্বের উদ্দিন আহমেদ, অর্থনীতিবিদ ড. নিয়াজ আসাদুল্লাহ, বুয়েটের ইইই বিভাগের অধ্যাপক ড. লুতফা আক্তার, টেলিযোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বিডিরেনের চিফ টেকনিক্যাল অফিসার (সিটিও) এখলাস উদ্দিন আহমেদ এবং প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ও সূর্যমুখী লিমিডেটের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফিদা হক। গবেষণা সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের আজহার উদ্দিন।

অডিট অধিদপ্তরের ওই প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৬-১৭ ও ২০১৯-২০ সালে নিয়োগবিধি উপেক্ষা করে ২৯ জুনিয়র পরামর্শককে রাজস্ব খাতের বিভিন্ন পদে নিয়োগের বিষয়ে আপত্তি জানায় অডিট অধদপ্তর। এ বিষয়ে জবাবও চাওয়া হয়। তবে বিটিআরসি যে জবাব দিয়েছে, তা আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য যথেষ্ট নয়।

অডিট অধিদপ্তর থেকে বলা হয়েছে, জবাব আপত্তি নিষ্পত্তির সহায়ক নয়। কারণ প্রকল্পে নিযুক্ত পদসমূহে কর্মরত ব্যক্তিদের বিভাগীয় প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করে রাজস্ব খাতে নিয়োগ করার কোনো বিধান নেই। তাই আপত্তিতে বর্ণিত পদের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ আপত্তিকৃত পরিশোধিত বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য সমুদয় অর্থ আদায়পূর্বক কমিশনের তহবিলে জমা দিয়ে নিরীক্ষাকে জানানোর জন্য অনুরোধ করা হলো।

অর্থাৎ এই নিয়োগ সম্পূর্ণ অবৈধ এবং নিয়োগপ্রাপ্তদের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে ইতোমধ্যে ২০২৩ সালেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে কিন্তু কমিশনের পক্ষ থেকে শাস্তিমূলক কোনোরূপ ব্যবস্থাই গ্রহণ করা হয়নি।

এর বাইরেও ৫০-এর অধিক কর্মকর্তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। একইভাবে সেসব বিষয়েও অডিট অধিদপ্তরের আপত্তি থাকলেও পরে বিভিন্নভাবে সেগুলোর নিষ্পত্তি করা হয়।

কোন পদে আছেন তারা

আমার দেশের হাতে আসা তালিকার কর্মকর্তাদের প্রায় সবাই এখন উপপরিচালক পদে বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত। অর্থাৎ অবৈধভাবে সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগপ্রাপ্ত এ কর্মকর্তারা শুধু নিয়োগই পাননি, চাকরীজীবনে পেয়েছেন একাধিক পদোন্নতি। যদিও এসব কর্মকর্তাদের চাকরি অবসান করে আর্থিক সুবিধা ফেরত নেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে।

বেশির ভাগ নিয়োগই ছিল রাজনৈতিক

বিটিআরসিতে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতাদের আত্মীয়স্বজন ও ঘনিষ্ঠজনদের অনিয়মতান্ত্রিকভাবে নিয়োগ ও পদোন্নতির বিস্তৃত চিত্র মিলেছে। পরিচালক এম এ তালেব হোসেন এইচটি ইমামের ভাতিজা, তৌহিদুন নাহার নিয়োগ পান তারিক সিদ্দিকের সুপারিশে, সামিরা তাবাসসুমের নিয়োগে ছিল সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের ভূমিকা। একইভাবে মিরাজুল ইসলাম, মাহরীন আহসান, খালেদ ফয়সাল রহমান, শারমিন সুলতানা, সনজীব কুমার সিংহ ও নাফিসা মল্লিকসহ একাধিক কর্মকর্তা রাজনৈতিক পরিচয়, বয়স ও শিক্ষাগত যোগ্যতা জালিয়াতির মাধ্যমে নিয়োগ ও পদোন্নতি পেয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এসব নিয়োগে সরকারি নিয়ম ভঙ্গ হলেও কর্তৃপক্ষ কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। অডিট প্রতিবেদন ও অভ্যন্তরীণ তদন্তে অনিয়ম প্রমাণিত হলেও একটি গোপন সিন্ডিকেট দীর্ঘদিন ধরে কমিশনকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে।

এখন অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্তদের যুক্তি, কমিশন জেনেশুনেই তাদের নিয়োগ দিয়েছে। ফলে এখানে তাদের দায় নেই।

নিরীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কয়েকজন জানান, কমিশনের যেসব কর্তাব্যক্তি দুর্নীতি ও আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে এসব নিয়োগ দিয়েছেন অবশ্য তারা শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন। কিন্তু একই সঙ্গে যারা নিয়োগ পেয়েছেন, তারাও সমানভাবে দায়ী। নানাভাবে রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি খাটিয়ে নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের ওপর চাপ সৃষ্টি করে তারা নিয়োগ নিশ্চিত করেছেন।

নিষ্ক্রিয় ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের কমিটি

ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় থেকে সরকার পতনের পরই অতিরিক্ত সচিব জানে আলমের নেতৃত্বে অবৈধ নিয়োগ ও পদোন্নতিসংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে তথ্য অনুসন্ধান ও যাচাইয়ে কমিটি করা হয়। কমিটিকে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য ২১ দিন সময় বেঁধে দেওয়া হয়। কিন্তু কমিটি এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিবেদন না দিয়ে নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।

বিধিবহির্ভূতভাবে নিয়োগ পাওয়া একজন নিজের পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে বলেন, ২৯ কর্মকর্তা বিভিন্ন ক্যাটাগরির সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগের আবেদন করেন। পরে যথাযথ প্রক্রিয়ায় নিয়োগ দেওয়া হয়। ২৯ জনের মধ্যে কোনো কর্মকর্তা সরাসরি নিয়োগপ্রাপ্ত হননি।

তদন্তের অগ্রগতি কতদূরÑ সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় অভ্যন্তরীণ কমিটির সদস্য সচিব মোহাম্মদ রুহুল আমিনের কাছে। এ বিষয়ে তিনি কোনো মন্তব্য না করে কমিটির সভাপতির সঙ্গে যোগাযোগের অনুরোধ করেন।

এ বিষয়ে অভ্যন্তরীণ কমিটির সভাপতি আশিষ কুমার কুন্ডুকে কল করা হলে সেটি রিসিভ হয়নি। বার্তা দেওয়া হলেও কোনো সাড়া মেলেনি।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত