শ্রম অভিবাসনের নামে মানবপাচার বাড়ছে

পীর জুবায়ের
প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০২৫, ০৯: ৫৯

ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি প্রবেশের চেষ্টাকারী দেশগুলোর তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে অন্তত ৯ হাজার ৭৩৫ জন বাংলাদেশি সাগরপথে ইতালি প্রবেশ করেছেন। ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি প্রবেশকালে লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দি অবস্থায় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে দেশে থাকা পরিবারের কাছ থেকে আদায় করা হয়েছে মোটা অঙ্কের অর্থ। অর্থ দেওয়ার পরও অনেকেই বন্দি অবস্থা থেকে মুক্তি পাননি। দিতে হয়েছে জীবন। তবে এত এত প্রাণহানির পরও থামছে না লিবিয়া হয়ে ইতালি প্রবেশের যাত্রা। ইউরোপে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর অন্তত ৭০ হাজার বাংলাদেশি গত এক যুগে ভূমধ্যসাগর পেরিয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেন।

বিজ্ঞাপন

তবে দুর্ঘটনার সংখ্যাও কম নয়। আট মাস আগে ভূমধ্যসাগরে নিখোঁজ হওয়া সায়াদ হোসেন সাজুর মা জাহানারা বেগম। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় সন্তানের নিখোঁজের সংবাদ প্রকাশ হলেও এখন পর্যন্ত তার কোনো সন্ধান না পেয়ে শয্যশায়ী হয়ে পড়েছেন তিনি। চিকিৎসক বলেছেন, চোখ দিয়ে যদি এভাবে পানি পড়তে থাকে, তাহলে অল্প সময়ের মধ্যেই চোখের জ্যোতি হারাবেন তিনি। নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের বাসিন্দা সাজু উন্নত জীবনের আশায় ইতালি যাওয়ার জন্য ২০২৪ সালে আমির নামে স্থানীয় এক দালালের সঙ্গে ১৫ লাখ টাকার চুক্তি করেন। সে অনুযায়ী ওই বছরের জুলাইয়ের শেষদিকে লিবিয়া পৌঁছান তিনি।

সাজুর ভাই জাহিদুল ইসলাম রাজু জানান, লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর দালাল আমির তার ভাইকে তিন-চার মাস বেনগাজির আশপাশের গেম ঘরে রাখে। গেম ঘরে থাকাবস্থায় সাজুকে ঠিকমতো খাবার এবং কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেওয়া হয়নি। ১৫-২০ দিন পর দুই-এক মিনিটের জন্য যোগাযোগ করতে দেওয়া হতো। তিনি বলেন, ১৯ নভেম্বর সাজু ভয়েস মেসেজ পাঠিয়ে জানায়, সাগরপথে ইতালি যাওয়ার জন্য লিবিয়া থেকে ২১ নভেম্বর বোটে তুলবে তাকে। এরপর থেকে আর কোনো খোঁজ নেই। পরবর্তী সময়ে দালাল আমিরের সঙ্গে যোগাযোগ করলেও সে ফোন রিসিভ করেনি।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম বলছে, এভাবে যারা ইউরোপে যাচ্ছে তাদের বেশিরভাগের বয়স ২৫ থেকে ৪০ বছর। মাদারীপুর, শরীয়তপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জসহ বাংলাদেশের অন্তত ১০-১২টি জেলার লোকজন এভাবে ইউরোপে যাওয়ার জন্য মরিয়া। এসব ক্ষেত্রে এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপ ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রতারিতরা বা নির্যাতনের শিকার লোকজন দেশে ফিরে মামলা করলেও মূল আসামিরা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবপাচার মামলাসংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৪ সালেই মানবপাচার আইনে এক হাজার ৩৪টি নতুন মামলা হয়েছে আর পুরোনো মামলা ধরলে প্রায় সাড়ে চার হাজার মামলা ঝুলে আছে। এরমধ্যে অন্তত তিন হাজার মামলা বিচারাধীন এবং এক হাজারেরও বেশি মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।

ভয়াবহ নির্যাতন লিবিয়ায়

বাংলাদেশ থেকে ইউরোপে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে যাদের লিবিয়া নেওয়া হয় তাদের সবাইকে ভালো চাকরির প্রলোভন দেখানো হলেও তারা চাকরি পান না। উল্টো বেশিরভাগকেই লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দি রেখে শারীরিকভাবে নির্যাতন করা হয়।

ইউরোপের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা ফ্রন্টেক্সের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশিরা লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে সবচেয়ে বেশি ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করে। এটি সেন্ট্রাল মেডিটেরিয়ান রুট হিসেবে পরিচিত। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত এই পথে অন্তত ৯২ হাজার ৪২৭ জন বাংলাদেশি ইউরোপে প্রবেশ করেছেন। এভাবে প্রবেশ করতে গিয়ে মাঝেমধ্যেই প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। সর্বশেষ চলতি বছরের জানুয়ারিতে লিবিয়ায় অন্তত ২৩ বাংলাদেশির গলিত লাশ উদ্ধার করা হয়, যারা লিবিয়া থেকে নৌযানে করে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পরে ভূমধ্যসাগরে সেটি ডুবে যায়।

যাত্রাপথ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঢাকা থেকে দুবাই-মিসর হয়ে লিবিয়া গেছেন সবচেয়ে বেশি মানুষ। এছাড়া ঢাকা থেকে ইস্তানবুল-দুবাই হয়ে লিবিয়া, ঢাকা থেকে কাতার হয়ে লিবিয়া, ঢাকা থেকে দুবাই-সিরিয়া হয়ে লিবিয়া এবং অল্প কিছু লোক ঢাকা থেকে সরাসরি লিবিয়া গেছেন। এভাবে লিবিয়া যাওয়ার পথে ৬৩ শতাংশই বন্দি হয়েছেন, যাদের ৯৩ শতাংশই ক্যাম্পে বন্দি ছিলেন এবং ৭৯ শতাংশই শারীরিক নির্যাতনের শিকার। এছাড়া লিবিয়ায় পৌঁছানোর পর ৬৮ শতাংশই মুক্তভাবে চলাচলের স্বাধীনতা হারিয়েছেন। ৫৪ শতাংশই বলেছেন, তারা কখনো তিনবেলা খাবার পাননি। অন্তত ২২ শতাংশ দিনে মাত্র একবেলা খাবার পেয়েছেন।

মানবপাচারের মামলা হলেও বিচার মিলছে না

২০২৪ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ, ভারত, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ড হয়ে পাচারের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় মাফিয়াদের হাতে তুলে দেওয়া হয় বরগুনার মোকামিয়া গ্রামের সাইদুর রহমানকে। প্রতিবেশী চাচা মাহফুজ মৃধার মাধ্যমে মানবপাচার চক্রের ফাঁদে পড়েন তিনি। পরবর্তীতে মোটা অঙ্কের টাকা এবং নির্যাতনের বিনিময়ে মুক্তি পান তিনি। সাইদুর জানান, এ নিয়ে চলতি বছরের মে মাসের ২৪ তারিখ বরগুনা মানবপাচার প্রতিরোধ দমন ট্রাইব্যুনালে দালাল মাহফুজ মৃধাসহ জড়িতদের বিরুদ্ধে মামলা করেন তিনি। সাইদুর জানান, আদালত থেকে থানা পুলিশকে আসামি গ্রেপ্তারের কথা বললেও প্রশাসন নীরব।

মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমনে ২০১২ সালে সরকার আইন করার পর থেকে মানব পাচার আইনে নিয়মিত মামলা হলেও অধিকাংশ মামলার বিচার শেষ হচ্ছে না। আবার যেগুলোর বিচার শেষ হচ্ছে, সেখানে আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মানবপাচার মামলাসংক্রান্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত চার হাজার ৩৬০টি মামলা ঝুলে আছে। এরমধ্যে এক হাজার ৩৪৬টি মামলা এখনো তদন্তাধীন আর তিন হাজার ১৪টি মামলা বিচারাধীন।

মানবপাচারের নতুন রুট ও কৌশল বাড়ছে

গত এক বছরে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগামের কাছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাচার ও নির্যাতনের শিকার, আটকে পড়া, জেল বা ডিপুটেশন ক্যাম্পে বন্দি ৩২৭ জন ভুক্তভোগীর পরিবার সহায়তা চেয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সহায়তায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৮১ বাংলাদেশিকে নিরাপদে ফিরিয়ে এনেছে। পাচারের শিকার ব্যক্তিদের উদ্ধার ও নিরাপদ প্রত্যাবাসনে কাজ করতে গিয়ে দেখা গেছে, মানবপাচারকারীরা এখন শুধু সাগরপথে নয়; ভিজিট ভিসা, কনফারেন্স ইনভাইটেশন, ওয়ার্ক পারমিট, এমনকি হজ ভিসাও ব্যবহার করছে। দুবাই-লিবিয়া হয়ে ইউরোপ আবার দুবাই-সার্বিয়া-স্লোভেনিয়া হয়ে ইতালি কিংবা সৌদি আরব হয়ে। নতুন করে যুক্ত হয়েছে রাশিয়া।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের তথ্যানুযায়ী, ইউরোপে পাঠানোর কথা বলে এখন বাংলাদেশিদের নেপালে নিয়ে আটকে রাখা হচ্ছে। যেহেতু নেপালে প্রবেশে ‘অন অ্যারাইভাল ভিসা’ আছে, সেক্ষেত্রে সহজে পাচারকারীরা কর্মীদের নেপালে নিয়ে যাচ্ছে। এছাড়াও মানবপাচারকারীরা বর্তমানে আলজেরিয়া, মৌরিতানিয়া, তিউনিসিয়া, রাশিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও সার্বিয়ার মতো দেশ ব্যবহার করছে।

ব্র্যাকের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান জানান, গত কয়েক বছর ধরে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার শীর্ষে বাংলাদেশিরা। এভাবে ইতালি যাওয়ার পথে অনেক প্রাণহানি ঘটে। এছাড়াও লিবিয়ায় অনেক মানুষ ভয়াবহ নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। পাচারকারীরা এখন তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করছে। সে তুলনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পিছিয়ে। পাচারের মামলাগুলোর বিচারও হচ্ছে না। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি উদ্বেগজনক।

মানবচাপার ও অবৈধ পথে বিদেশযাত্রা কেন থামছে না—এমন প্রশ্নে অভিবাসী বিশেষজ্ঞ আসিফ মুনির আমার দেশকে বলেন, বাংলাদেশ সরকার ভালো করে জানে এ কাজে কোন কোন রুট ব্যবহার করা হয়। সুতরাং এ বিষয়ে ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের নজরদারি জোরদার রাখতে হবে। তাছাড়া যেসব দেশে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী হিসেবে যায়, সেসব দেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কূটনৈতিক সুসম্পর্ক গড়ে তুলে মানবপাচার রোধে কাজ করতে হবে।

তিনি বলেন, পাচারের শিকার হওয়া সব মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পারলে দালালরা ভয় পাবে। এ নিয়ে সরকারকে যথেষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত