১৩ মিথ্যা মামলায় ২৯ দিন রিমান্ড

রকীবুল হক
প্রকাশ : ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯: ৫৭
আপডেট : ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১১: ৪১

চট্টগ্রামের হাটহাজারীর একটি মাদরাসায় শিক্ষকতার পাশাপাশি ধর্মীয় ইস্যুতে সোচ্চার থাকতেন মাওলানা জাকারিয়া নোমান ফয়জী। একইভাবে দেশ নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে লেখালেখিও করতেন তিনি। এতেই পতিত আওয়ামী সরকার ও ভারতীয় এজেন্টদের টার্গেটে পড়েন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের এই সহকারী মহাসচিব।

তার চলাফেরা ও কাজকর্মে নজরদারি করতে থাকে গোয়েন্দারা। একপর্যায়ে তার ওপর সরাসরি নির্যাতন শুরু হয়। তাকে ধরতে বাড়িতে, অফিসে চলে পুলিশের তল্লাশি ও লুটপাট। পরিবারকে করা হয় হেনস্তা।

বিজ্ঞাপন

একপর্যায়ে তাকে আটক করে একে একে ১৩টি বানোয়াট মামলা দেওয়া হয়। দফায় দফায় ২৯ দিন রিমান্ডে নিয়ে চালানো হয় ব্যাপক নির্যাতন। এতে নেতৃত্ব দেন তৎকালীন ডিবির ওসি কেশব কুমার। ১৪ মাস জেলে থাকা অবস্থায় তাকে পরিবার থেকে শুধু যোগাযোগ বিচ্ছিন্নই রাখা হয়নি, বরং পরিবারকেও নানাভাবে হেনস্তা করা হয়।

ছেলের চিন্তায় অসুস্থ হয়ে তিনবার হাসপাতালে ভর্তি হন তার মা। তার চাচার মৃত্যুতেও প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হয়নি। জেল থেকে জামিনে মুক্তির পরও স্বস্তিতে থাকতে পারেননি এই আলেম। নানা সতর্কতা আর গোয়েন্দা ও পুলিশের হয়রানি অব্যাহত ছিল তার ওপর।

নোমান ফয়জী জানান, ২০২১ সালে মোদিবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ২৬ মার্চ হাটহাজারী মাদরাসায় যে সংঘাতের ঘটনা ঘটে, সেদিন তিন কিলোমিটার দূরে নিজের মাদরাসায় একটি অনুষ্ঠানে ছিলেন তিনি। সেখান থেকেই ফোনে খবর পান যে ওসি রফিকের নির্দেশে চারজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এ ঘটনায় পরে বেশ কয়েকটি মামলা করে পুলিশ। তাতে হেফাজত নেতাকর্মীদের আসামি করা হয়। শুরু হয় ধরপাকড়।

গ্রেপ্তার অভিযানের অংশ হিসেবে ২০২১ সালের ২৩ এপ্রিল ৭০টি গাড়ি নিয়ে জাকারিয়া নোমান ফয়জীর বাড়ি ঘেরাও করে তল্লাশি ও সবকিছু তছনছ করে পুলিশ। তার অফিসেও লুটপাট চালানো হয়। এ সময় তাকে না পেয়ে গাড়িচালক মামুনকে ধরে নিয়ে যায়।

একে একে আটটি মামলা দেওয়া হয় তার বিরুদ্ধে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তিনি কক্সবাজারের চকরিয়ার নানাশ্বশুরের বাড়িতে অবস্থান করেন। কিন্তু সেই বাড়িতেও হানা দেয় পুলিশ। ৫ মে ওই বাড়ির আশপাশে আড়াই কিলোমিটার এলাকা কর্ডন করে গ্রেপ্তার করা হয় নোমান ফয়জীকে। সেখানে পুলিশ প্রায় ৬৫টি গাড়ি নিয়ে যায় তাকে ধরতে।

তিনি বলেন, আসরের সময় গ্রেপ্তার করে নেওয়া হয় ডিবি অফিসে। একে একে ১৩টি বানোয়াট মামলা দেওয়া হয় তার বিরুদ্ধে। এ সময় মিডিয়ায় নানা ধরনের অপপ্রচার চালানো হয়। তিনি তখন হেফাজতের প্রচার সম্পাদক ছিলেন। ডিবির ওসি কেশব কুমারের নেতৃত্বে এই গ্রেপ্তার অভিযান চালানো হয়। ডিবিতেও তার নেতৃত্বে চলে নানা ধরনের টর্চার ও অকথ্য ভাষায় গালাগাল।

এত আক্রোশের কারণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তিনি ভারতের বিরুদ্ধে লেখালেখি করতেন। তার একটি বইয়ের নাম ছিল ‘ভারতীয় আগ্রাসনের একাল-সেকাল’। আরেকটি আর্টিকেল ছিল ৫০ বছরে ভারত কী দিয়েছে, কী নিয়েছে। উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে শিরোনামে আরেকটি বই ছিল। এ জন্য তাকে জিজ্ঞাসাবাদের মূল বিষয় ছিল ভারতবিরোধিতা কেন?

ডিবিতে নির্যাতন প্রসঙ্গে মাওলানা নোমান ফয়জী বলেন, সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখা হতো। চরম খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে। কেশব কুমার চক্রবর্তী, এসআই আবদুল হান্নান ও আরেকজন এসআই মিলে চরম অশালীন আচরণ করে তার সঙ্গে।

ডিবিতে এক দিন রাখার পর আদালতে ওঠানো হয় তাকে। পুলিশের ওপর গুলি চালানোর মামলা দেওয়া হয় তার বিরুদ্ধে। সেই মামলায় আদালত তাকে পাঁচ দিনের রিমান্ড দেয়। তিনি বলেন, রিমান্ডে নামাজ ছাড়া কোনো সময় হ্যান্ডকাফ খুলে দেওয়া হয়নি।

হ্যান্ডকাফের কারণে পিঠটাও চুলকানো যেত না। এমনকি নামাজ পড়তে দাঁড়ালেও হিন্দু অফিসাররা নানাভাবে ব্যাঘাত ঘটাতেন। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদ প্রসঙ্গে নোমান ফয়জী বলেন, আমি কেন ভারতবিদ্বেষী, আমি কেন আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে কথা বলি, আমি কেন লেখালেখি করি। এ সময় তারা অশ্লীল ভাষায় গালি দিয়ে তারা বলেন, ‘লটকায়ে পিটালে ও গরম ডিম ঢোকালে’ সব বলে দেবে। এ সময় ক্রসফায়ারে দেওয়ারও হুমকি দেওয়া হয় তাকে।

তিনি বলেন, সবচেয়ে বেশি নির্যাতন করা হতো রাতের বেলায়, ডিবি থেকে এ সময় পাশের পাঁচলাইশ থানায় নেওয়া হতো। সেখানে সন্ত্রাসী, মাদকসেবকদের সঙ্গে একটি গারদে রাখা হয়। নামাজের জন্য জায়নামাজ চাইলেও তা দেয়নি। বাধ্য হয়ে স্যাঁতসেতে স্থানে নামাজ পড়তেন তিনি। এ সময় আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরীর বিরুদ্ধে নানা মিথ্যা কথা বলানোর চেষ্টা করে তারা।

তার পরিবারের ওপরও নির্যাতন চালানো হয়। তার দুই ভাইকে হাটহাজারী থানায় ডেকে নানাভাবে হেনস্তা করে। তার অফিসে গিয়ে তল্লাশি চালায়। এ সময় তার দুটি মোবাইল নিয়ে নেয়। সেই মোবাইলের নম্বর দেখে দেখে রিমান্ডে নানা প্রশ্ন করে। একপর্যায়ে তার ফেসবুক থেকে এক হাজার পৃষ্ঠা প্রিন্ট করে নিয়ে এসে পড়ে শোনায়। সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড় করিয়ে রাখা হতো।

নোমান ফয়জী বলেন, পাঁচ দিনের রিমান্ডের শেষপর্যায়ে একটি স্বীকারোক্তি নিতে চাইলেও আমি তা দিইনি। পরে ম্যাজিস্ট্রেট তার মতো করে জবানবন্দি লেখেন। রিমান্ড শেষে আরেকটি বানোয়াট মামলা দিয়ে কোর্টে তোলা হয় আমাকে। সেই মামলায় আবার তিন দিন রিমান্ডে নেওয়া হয়। এ সময়ও একইভাবে নানা অশ্লীল গালাগাল, জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

পরে বুঝতে পারি যে, আমাকে বড় একটি টার্গেট করে এ ধরনের নির্যাতন চালায়। মিডিয়ায় নানা বানোয়াট খবর প্রকাশ করায়। এমনকি একজন নারীকে প্রেশার দিয়ে একটি মামলা করানো হয়। যদিও সেটি পরে প্রত্যাহার করে নেন তিনি। এভাবে একের পর এক মামলায় ২৯ দিন রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন চালানো হয়।

তিনি বলেন, জেলখানায় ১৪ মাস ৯ দিন থাকাকালে আমার চিন্তায় আমার মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ সময় তিনবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। আমার ছোট ছেলেটাকে হিফজখানা থেকে তুলে নেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। একটা লাইব্রেরি ছিল, সেটা চার মাস খুলতে দেওয়া হয়নি। পারিবারিক মাদরাসাটি নিয়েও নানা ধরনের ষড়যন্ত্র করে পুলিশ।

মাওলানা নোমান ফয়জী বলেন, তার বিরুদ্ধে দুদুকের মামলা দেওয়া হয়েছে। এনবিআরের মামলা দেওয়া হয়েছে। অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করা হয়েছে। নানা ধরনের হুমকি-ধমকি দেওয়া হয়েছে। খুঁজে কিছু না পেয়ে টাকা কোথায় রেখেছি জিজ্ঞাসা করত। বলত পাকিস্তানে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি। সৌদি আরবে পাঠিয়েছি কি না।

জেলখানায় নেওয়ার পর তার কেস কার্ডে লাল দাগ দেওয়া ছিল। বলা হয়েছিলÑ হেফাজত নেতা হিসেবে তিনি নামাজ পড়াতে পারবেন না। মোবাইলে কথা বলাসহ সব সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়। ১৪ মাস ৯ দিন জেলজীবনে মোবাইলে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। এক দিন লুকিয়ে কথা বলতে গেলে গোয়েন্দারা ধরে ফেলে টাকা আদায় করে। আদালতেও কারো সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দেওয়া হয়নি। তবে কারা কর্তৃপক্ষের নিষেধ থাকলেও ওয়ার্ডবাসীর চাওয়া অনুযায়ী নামাজ পড়াতেন তিনি।

২০২২ সালের ৫ মে নোমান ফয়জীর চাচা মারা যান। তার জানাজায় অংশগ্রহণের জন্য নিয়মানুযায়ী প্যারোলে মুক্তির আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু মিথ্যা অজুহাতে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়নি।

তিনি বলেন, ছয় মাসের মাথায় সব মামলায় হাইকোর্টে জামিন হয়েছিল। আপিলে একে একে ১০টি মামলায় জামিনের আদেশ স্টে করে দেওয়া হয়। একপর্যায়ে সব মামলায় জামিন নিয়ে মুক্তি পান তিনি। এসব মামলা চালাতে প্রায় ৩৫ লাখ টাকা খরচ হয়েছে বলে জানান এই আলেম। তার নামে মোবাইল চুরির মামলা দেওয়ার হুমকি দেয় পুলিশ।

মুক্তির পরও নাজেহাল করা হয় এই আলেমকে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বারবার ফোন দিয়ে যোগাযোগ করত পুলিশ ও গোয়েন্দারা। কোন কোন কথা বলা যাবে না, লেখালেখি করা যাবে না ইত্যাদি বিষয় সতর্ক করা হয় তাকে। এনএসআই হেড অফিসে ডেকেও তাকে সতর্ক করা হয়েছিল। মামলায় হাজিরা দিতে ভোগান্তি পোহাতে হয়। তার পাসপোর্ট নবায়নেও বাধা দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, রিমান্ডে না দেওয়ার কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করত পুলিশ। প্রথম মামলার পর আর মামলা না দেওয়ার জন্য তার কাছে ২০ লাখ টাকা দাবি করেছিলেন হাটহাজারী থানার ওসি রফিক।

মাওলানা জাকারিয়া বলেন, সেই ওসি কেশব কুমার এখন কোথায় আছেনি, তা জানা নেই। তার বিরুদ্ধে হাটহাজারীর চার হত্যার ঘটনায় মামলা হয়েছে। যারা এসব জুলুম-নির্যাতনে জড়িত ছিল, সবার নামে আরও মামলা হবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত