গুম প্রতিরোধ দিবস আজ

দুই শতাধিক ব্যক্তির খোঁজ এখনো মেলেনি

আবু সুফিয়ান
প্রকাশ : ৩০ আগস্ট ২০২৫, ০৮: ৩৫
আপডেট : ৩০ আগস্ট ২০২৫, ০৮: ৩৬

আজ ৩০ আগস্ট। গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস। বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। ২০১০ সালের ডিসেম্বরে ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেশন ফর প্রোটেকশন অব অল পারসনস অ্যাগেইনস্ট এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়ারেন্স’ সম্মেলনে যে আন্তর্জাতিক সনদ কার্যকর হয়, তাতে ৩০ আগস্টকে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য দিনটি কেবল স্মরণ নয়, গভীর এক বেদনার প্রতীক। শত শত পরিবার এখনো জানে না তাদের প্রিয়জন বেঁচে আছেন নাকি মৃত। প্রতিটি সকাল তাদের জন্য নতুন শূন্যতা, প্রতিটি রাত নতুন অপেক্ষা।

বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলীর পরিবার এখনো নিশ্চিত নয় ইলিয়াস আলী বেঁচে আছেন কি না। ইলিয়াস আলীর জন্য এখনো তারা অপেক্ষায় আছেন।

বিজ্ঞাপন

ফারজানা আক্তারের চোখ কান্নায় ঝাপসা হয়ে যায় যখন তিনি বলেন, “আমার মেয়েটি এখন ভালো খাবার দেখলেই কাঁদে। বলে, ‘বাবা তো ভালো খাবার খেতে পারে না।’ ফ্যান চালু থাকলে বন্ধ করে দেয়। বলে, ‘বাবা তো বাতাসে ঘুমায় না।’ যত বই আছে, প্রতিটি পাতায় শুধু বাবার নাম লিখে রেখেছে।”

তার স্বামী বংশাল থানা ছাত্রদল নেতা মো. পারভেজ হোসেনকে ২০১৩ সালের ২ ডিসেম্বর সাদা পোশাকধারীরা তুলে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তিনি নিখোঁজ। বড় মেয়ে আদিবা এখন অষ্টম শ্রেণিতে আর ছোট ছেলে আরাফ চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। বাবাহারা সন্তানদের মানুষ করাই ফারজানার জীবনের লড়াই।

একই দিন শাহবাগ থেকে তুলে নেওয়া হয় ছাত্রদলের আরেক নেতা মো. সোহেলকে, যাকে এলাকার মানুষ ‘চাচা সোহেল’ হিসেবে চিনতেন। তার মেয়ে সাদিকা সরকার সাফার বয়স তখন দেড় মাস। আজ সাফা পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী। বাবার সাদা-কালো ছবিই তার সম্বল। মা শিল্পী বলেন, ‘মেয়েটি সারাক্ষণ বাবার কথা ভাবে। সে চায় তার বাবার গুমের বিচার হোক।’

একই বেদনার গল্প আঁকেন সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন আফরোজা ইসলাম আঁখি। তিনি আমার দেশকে বলেন, “সুমনের বড় মেয়ে হাফসা ইসলাম রায়তা নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ছোট মেয়ে আরোয়া পড়ে পঞ্চম শ্রেণিতে। বাবা গুম হওয়ার সময় আরোয়ার বয়স ছিল মাত্র দেড় বছর। বড় মেয়ে রায়তা বাবার স্মৃতিতেই বেঁচে আছে। একদিন রিকশায় বসে সে আমাকে বলেছিল, ‘বাবা চলার পথে কত মানুষকে সালাম দিত, কথা বলত। এখন আমার বুক ব্যথা করছে, আমি আর যেতে চাই না’।”

আফরোজা ইসলাম আঁখি বলেন, “আমার ভাই গুম হওয়ার পর তার স্ত্রী নাছিমা আক্তার র‌্যাব-১-এর তৎকালীন অধিনায়ক কিসমত হায়াতের পা জড়িয়ে ধরে স্বামীকে ফেরত চেয়েছিলেন। দুই মেয়ের দিকে তাকিয়ে অনুরোধ করেছিলেনÑ‘আমি এতিম, মা-বাবা নেই। সুমন ছাড়া আমার কোনো ভরসা নেই। দয়া করে ওকে ফিরিয়ে দিন।’ কিন্তু সেই আর্তি শোনা হয়নি। দীর্ঘ অপেক্ষায় ক্লান্ত নাছিমা এখন নানান রোগে ভুগছেন।”

বাংলাদেশের গুম কমিশনের তথ্যমতে, রাজনৈতিক কারণে এখনো অন্তত ২১১ জন নিখোঁজ। গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের গড়া সংগঠন ‘মায়ের ডাক’-এর অন্যতম সংগঠক আফরোজা ইসলাম আঁখি বলেন, এ সংখ্যা ৩৫০ জনেরও বেশি।

গুম হওয়াদের বেশিরভাগই বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং ইসলামপন্থি অন্যান্য দলের নেতাকর্মী। অথচ একটি ঘটনারও রহস্য উদ্ঘাটিত হয়নি।

জাতিসংঘ, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলছে, গুম আন্তর্জাতিক আইনে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ও লাতিন আমেরিকার মতো বাংলাদেশও শেখ হাসিনার আমলে সেই কালো মানচিত্রে যুক্ত হয়েছে।

তবুও আশা জাগানিয়া একটি খবর এসেছে ২৮ আগস্ট। উপদেষ্টা পরিষদের ৪০তম বৈঠকে ‘গুম প্রতিরোধ, প্রতিকার ও সুরক্ষা অধ্যাদেশ, ২০২৫’-এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। বৃহস্পতিবার প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে সভায় এ অনুমোদন দেওয়া হয়।

প্রস্তাবিত আইনটি কার্যকর হলে গুমের বিচার হবে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে। প্রতিটি জেলায় ট্রাইব্যুনাল হবে। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলে মৃত্যুদণ্ডসহ সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে এ আইনে। ১২০ দিনে মামলা নিষ্পত্তি করতে হবে ট্রাইব্যুনালকে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত