জাহাজবাড়ী হত্যায় নেতৃত্ব দেওয়া মাসুদ এখন রংপুরে

আবু সুফিয়ান, রংপুর থেকে ফিরে
প্রকাশ : ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮: ২৭
আপডেট : ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮: ৫৫

রাজধানীর কল্যাণপুরের জাহাজবাড়ীর হত্যাযজ্ঞে নেতৃত্বদানকারী সেই পুলিশ কর্মকর্তা মিরপুর পুলিশের উপকমিশনার মাসুদ আহম্মেদ এখন রংপুর রেঞ্জে চাকরি করছেন। পুলিশের নথিপত্রে তার নেতৃত্বে অভিযানের কথা বলা হলেও তার দাবি, এই জঙ্গি অভিযান ও হত্যাযজ্ঞের কিছুই তিনি জানেন না। নিজেকে নির্দোষ দাবি করে তিনি হত্যাযজ্ঞের দায় চাপিয়েছেন ডিবি পুলিশ, সোয়াট এবং কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের ওপর।

তিনি বলেন, অভিযানের পর মনিরুল স্যার, মারুফ স্যার, বাতেন স্যার, কৃষ্ণ স্যার - এক কথায় সব সিনিয়র অফিসার ঘটনাস্থলে ছিলেন। মিরপুর জোনের ডিসি হওয়ায় আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে তাকে ঘটনাস্থলে যেতে হয়েছিল। তাকে অন্ধকারে রেখে পুরো অভিযান চালানো হয়েছে।

বিজ্ঞাপন

জাহাজবাড়ীর জঙ্গি নাটক ও ক্রসফায়ারে হত্যার ঘটনা অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা তার বক্তব্য রেকর্ড করি। অভিযানে নেতৃত্বদানকারী এই পুলিশ কর্মকর্তা মাসুদ আহম্মেদ দীর্ঘদিন ধরে আড়ালে ছিলেন। অনুসন্ধান করে তাকে রংপুরের কর্মস্থলে পাওয়া যায়।

গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর একের পর এক মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি নিজেকে আড়াল করে রেখেছিলেন। রংপুর রেঞ্জে তিনি অ্যাডিশনাল ডিআইজি হিসেবে বর্তমানে সংযুক্ত আছেন।

২১ জানুয়ারি সকালে তার অফিসে সরেজমিনে গিয়ে জাহাজবাড়ীর সেই ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি প্রথমে নার্ভাস হয়ে যান। পরে নিজেকে সামলে নিয়ে বলেন, ওই ঘটনায় আমার সম্পৃক্ততা নেই। দায়িত্বে থাকার কারণে সেদিনের অভিযানের নেতৃত্বদানকারী হিসেবে আমার নাম এসেছে। কী ঘটনা ঘটেছে, কেন জঙ্গি বিরোধী অভিযান, কারা জঙ্গি, হত্যার শিকার কারা, কীভাবে হত্যাকাণ্ড হয়েছে – সবকিছুই বলতে পারবে ডিবি, সোয়াট এবং কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের কর্মকর্তা ও সদস্যরা।

কারণ, সোয়াট, ডিবি বা কাউন্টার টেরোরিজম যখন কোনো স্থানকে ‘জঙ্গি সাইট’ ঘোষণা করে তখন উপ-পুলিশ কমিশনারই নয়, আইজিপি বা কমিশনারেরও কিছু করার থাকে না। কারণ, এটি ডিজাইনড অ্যান্ড ডেডিকেটেড বাই সিটিটিসি। এখানে বাকি কারও কোনো কথা বলার অধিকার নাই।

তিনি বলেন, ‘আমার তো ডিরেক্ট কোনো এনগেজমেন্ট নেই। কারণ উনারা পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (পিওএন) থেকে ফোর্স নিয়ে এসেছিল। আমাদের অ্যাডিশনাল কমিশনার মারুফ (হোসেন সরদার) স্যার সেখানে উপস্থিত ছিলেন। উনি (নিজেই) এনাফ টু অর্গানাইজ টু ডু অল থিংকস। তারপরে আমরা সকালের দিকে গেলাম। সকালে গিয়ে দেখি যে আইজি স্যার আসলেন আমাদের আগে। তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বললেন।’

গত ২৩ ডিসেম্বর আমার দেশ-এ ‘ডিবি থেকে নিয়ে ৯ তরুণ খুন’ শীর্ষক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। এতে ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই রাজধানীর কল্যাণপুরে তথাকথিত জঙ্গিবিরোধী অভিযানের নামে সাজানো বন্দুকযুদ্ধের নামে ৯ তরুণকে হত্যার নেপথ্যের চিত্র তুলে ধরা হয়।

সাজানো সেই অভিযানের পর মামলার সব নথিপত্রে ‘মাসুদ আহম্মেদের নেতৃত্বে’ অভিযান পরিচালিত হয়েছিল বলে উল্লেখ করা হয়। জাহাজবাড়ী হত্যাকাণ্ডকে বৈধতা দিতে ইসলামিক স্টেট (আইএস) এবং নব্য জেএমবির সঙ্গে তাদের জড়িত থাকার গল্প বানিয়েছিল পুলিশ।

নিহত তরুণদের সম্পর্কে তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘নিহতদের চেহারা ও বেশভূষা দেখে ‘উচ্চশিক্ষিত’ বলে মনে হয়েছে।’ অথচ নিহতদের মধ্যে সাতজনই ছিলেন অতি সাধারণ পরিবারের সদস্য। হাসিনা সরকারের পুলিশের নির্মমতার বিরুদ্ধে প্রশ্ন করার সাহস সেসব পরিবারের ছিল না।

জাহাজবাড়ীর ঘটনায় নিজের সম্পৃক্ততা অস্বীকার এবং এ বিষয়ে কিছুই অবহিত নন জানানোর মধ্য দিয়ে মিরপুরের সেই ডিসি মাসুদ আহম্মেদই প্রমাণ করেন যে, ঘটনাটি ছিলো সাজানো, একটি জঙ্গি নাটক মাত্র।

অথচ এর জন্য পুলিশের সম্মানজনক পদক ‘বাংলাদেশ পুলিশ পদক (বিপিএম)’ পেয়েছিলেন বলে আমার দেশ’র কাছে স্বীকার করেন তিনি।

‘জাহাজবাড়ী’ হিসেবে পরিচিত তাজ মঞ্জিলে মাসুদ আহম্মেদের ‘নেতৃত্বে’ পুলিশের ‘অভিযান’ চালানো হয়। সেই তরুণদের হত্যার পর বরাবরের মতোই পুলিশের দাবি ছিল— ‘দরজা নক করলে … গুলি ও গ্রেনেড ছুড়তে থাকে... আত্মরক্ষার্থে ...।’

অথচ এখন মাসুদ আহম্মেদ বলছেন ভিন্ন কথা। তিনি বলেন, ‘বৃষ্টির রাত ছিল। আমি ১২টা-১টার দিকে বাসায় আসি। বাসায় আসার পর অনেক কল আসে। আমাকে পাচ্ছে না। সম্ভবত বৃহস্পতিবার ছিল। আমাকে ফোনে জানাল মিরপুরে ব্লক রেইডে ঝামেলা হইছে। সিনিয়র স্যারেরা আসছে। আমাকে ডিবি এবং সিটিটিসি থেকেও কিছু বলেনি।’

মামলার নথিতে তার নাম থাকার পরও তথাকথিত সেই অভিযানে দায় অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘এখন আপনি কাগজপত্রে যে কথাগুলো পাচ্ছেন, উনার নেতৃত্বে ব্লক রেইড পরিচালনা করা হয়েছে। কিন্তু তাদেরকে (৯ তরুণ) লোকাল থানা পুলিশ আগে অ্যারেস্ট করেনি, আটকও করেনি। পরে ডিবি, সোয়াট দিয়ে মূল অভিযান করছে।

সেখানে তো আমাদের কারো (মিরপুর ডিভিশন) কিছু করার নেই। কারণ আমার তো যাওয়ারই কথা না সেখানে। কারণ এই কাজগুলো তখন ডিবি, সোয়াট, বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট করত। মানে জঙ্গি অভিযানের ফর্মুলাটাই হচ্ছে এইটা।’

তিনি বলেন, ‘সিটিটিসি তখনও পূর্ণোদ্যমে কার্যকর হয়নি। ডিবি ও সোয়াট জয়েন্টলি কাজটা করত। সোয়াট অপারেশনাল কাজও করে। যতগুলো অভিযান হয়েছে একই ধরন। এখানে লোকাল পুলিশ উপস্থিত থাকবেন। নর্মালি তারা (সোয়াট) যখনই কোনো অভিযানে যায়, তারা স্পেশাল ফোর্স আনায়।’

মাসুদ আহম্মেদ বলেন, ‘অ্যাডিশনাল কমিশনার (সেই রাতে) আসার আগেই স্পেশাল ফোর্স থানা থেকে আনে। আমাকে বলেও নাই। কোথা থেকে ফোর্স আসছে, কী আসছে... বলেও নাই। র‍্যাব কখন আসছে না আসছে তাও জানি না। এর পরে সিনিয়রদের সিদ্ধান্তে সোয়াট অভিযান চালায়। এই হচ্ছে মূলত বিষয়।’

তিনি আরও বলেন, ‘৯ তরুণকে কোথা থেকে এনেছে এটা আমাদের জানার কথাও না। একেবারে আপনাকে অনেস্টলি বলছি এটা আমাদের জানার কথাও না। এটা ওই তিন ইউনিট জানে। ডিবি, সোয়াট ও বোম্ব ডিসপোজাল ইউনিট। কে জঙ্গি, কে জঙ্গি না… আমরা তো জানি না... আমার লোকের সঙ্গে তো আমার দেখাই হয় নাই (ঘটনাস্থলে)।’

পুরো বিষয়টাতেই অন্ধকারে ছিলেন বলে দাবি করে তিনি বলেন, ‘আমি খবর পাইছি রাত দুইটা-আড়াইটার দিকে। সিনিয়র একজনও কল করে নাই। যা করছে আমার ডিভিশনেরই লোকজন।’

তিনি বলেন, ‘এই সমস্ত বিষয়গুলো তো সিক্রেটলি করা হয়। জঙ্গি অভিযান কারা করবে… ডিবি কোথায় অভিযান করবে আমাদের সঙ্গে শেয়ার করে নাই। সোয়াট ... ইফ দে ওয়ান্ট মাই প্রেজেন্স দেয়ার, তাহলে একটা কথা।’

ওই খানে কোন কোন টিম ছিল? আপনার লোকেরা কী জানিয়েছিল? - এমন প্রশ্নের জবাবে মাসুদ বলেন, ‘ওইখানে ডিবি ও সোয়াটের টিম ছিল। যখনই বিষয়টা শুনলাম জঙ্গি রিলেটেড... ন্যাচারালি সিনিয়ররা ... দে ডোন্ট ওয়ান্ট টু গো উইথ দেম। মানে আছে না ‘অচ্ছুৎ’ ... আমি চাচ্ছি না আপনি এখানে আসেন। ইউ নো ম্যানি থিংকস। বাট আমি চাচ্ছি না ইউ কাম অন দ্য সাইট। কারণ আমার তো কোনো অ্যাসিস্টেন্স এখানে চাচ্ছে না তারা।’

‘আপনার লোক কি ভবনটির উপরে উঠেছিল? তারা প্রথমে কী শনাক্ত করেছিল?’ এমন প্রশ্নের জবাবে মাসুদ আহম্মেদ বলেন, ‘না না। আমাদের লোক তো উপরেই উঠতে পারে নাই। ওরা শুধু বলছে, স্যার উপরে চিল্লাচিল্লি হচ্ছে। অনেক রাতের ঘটনা। প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল সেদিন। আমার খেয়াল আছে। বাসায় গিয়া সেট সাইলেন্স কইরা ঘুমানোর প্রস্তুতি নেই। রেডিও বন্ধ। মোবাইল শুধু সাইলেন্ট। কেউ কিন্তু আমাকে ফোনও করে নাই।’

‘আপনার এলাকায় অভিযান আর আপনাকে কেউ কিছুই জানাবে না?’ – এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তাতে কী? এটা কোনো ডিসি জানে না। শুধু আমিই না। কোনো ডিসি জানে না।’

‘এই ঘটনার পরদিন আপনার শীর্ষ অফিসারদের সঙ্গে কী কথা হয়েছিল’? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এইগুলা নিয়া আমাদের কথা বলার কিছুই নাই। কারণ, এর আগে… অনেক জায়গায় ঘটনাগুলো ঘটছে না? আমরা জানি উত্তরাতেও এমন একটা ‘সাইট’ হয়েছিল। বাট এইটা লোকাল অফিসাররাও জানে না। কারণ এইগুলা তো শেয়ার করে না গোয়েন্দারা। কে, কীভাবে জঙ্গি হইছে, কীভাবে এখানে আসছে আমরা তো এগুলার কিছুই জানি না।”

জাহাজবাড়ীর এজাহারেই তো আপনার সব কর্মকাণ্ড উল্লেখ রয়েছে? - আমার দেশের এমন প্রশ্নের জবাবে মাসুদ আহম্মেদ বলেন, ‘ওইটা তো সরকারি কথাবার্তা বলতে হবে আর কী। আর এইটাকে কেন্দ্র করে আমি একটি বিপিএম পেয়েছি ... । আমার এলাকায় এই অভিযান হয়েছে বলে আমি বিপিএম পেয়েছিলাম’

‘এই ঘটনায় আর কে কে পদক পেয়েছিলেন?’ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘খোঁজ নিলে জানা যাবে। তথ্যগুলো জানা নাই।’

‘আপনি পরে ডিবি, সোয়াটের সঙ্গে (জাহাজবাড়ীর ঘটনা নিয়ে) কথা বলেন নাই?’ প্রশ্নের জবাবে মাসুদ আহম্মেদ বলেন, ‘পরের পার্ট সবাই যা দেখছে, আমিও দেখছি। বর্ডার লাইনের বাইরে অনেকেই কিছু জানতে চাইতে পারি না। যে কথাটা তারা অফিসিয়ালি বলছে সেটাই আমরা জানি। জেনুইনলি আমাদের জানারও সুযোগ ছিল না। কারণ আমরা তো ওদেরকে আটকও করি নাই।’

তিনি বলেন, ‘মনিরুল স্যার, মারুফ স্যার, বাতেন স্যার, কৃষ্ণ স্যার - এক কথায় সব সিনিয়র অফিসার ঘটনাস্থলে পরদিন ছিলেন।’

মাসুদ আহম্মেদ বলেন, ‘ডিবি, সোয়াট সেদিন কারও সাপোর্ট চায় নাই। আমরাও যেচে কিছু বলি নাই। কারণ একটা কনফিডেনশিয়াল বিষয় থাকে। তাদের মনেও ভয় আছে। কারণ তারা তো আমাকেও ট্রাস্ট করে না। আমি সেখানে গেলাম। দুই-চারটা এভিডেন্স রাখলাম। পরবর্তী সময়ে আমি এভিডেন্স প্রোভাইড করলাম। হতে পারে না এটা? কারণ দে কান্ট ট্রাস্ট মি। এই জাতীয় অভিযানকে ইনফ্লয়েন্স করা কারও পক্ষেই পসিবল না। আদার দেন সিটি, সোয়াট, ডিবি। যদিও তখন সিটি পুরোদমে কাজ শুরু করেনি।’

‘আপনার মনে সেদিন প্রশ্নের সৃষ্টি হয় নাই যে এত বড় সাজানো জঙ্গি নাটকের ঘটনা কিভাবে ঘটল?’ – এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অফিসিয়ালি তারা যে স্টেটমেন্ট দিয়েছে, ওর বাইরে আমরা চিন্তা করতে পারি না আসলে। প্রফেশনাল কারণেই এমনটা হয়। অফিসিয়াল স্টেটমেন্টের পক্ষেই আমাদের চিন্তা-চেতনা থাকে।’

দায় এড়ানোর চেষ্টা

আমার দেশ-এর অনুসন্ধানে জানা গেছে, শেখ হাসিনার জমানায় জাহাজবাড়ীর মতো দেশের বিভিন্ন এলাকায় এভাবেই জঙ্গি নাটক মঞ্চস্থ করে অনেক তরুণকে হত্যা করেছে পুলিশ। সাজানো এসব জঙ্গি নাটক মঞ্চস্থের পর মাসুদ আহম্মেদের মতো পুলিশের শীর্ষ কর্মকর্তারা পদক ও প্রমোশন পেলেও এখন আর দায় নিতে রাজি নন।

জুলাই বিপ্লবের পর এসব পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। মূল কুশীলবদের অধিকাংশ ভারতসহ অন্যান্য দেশে পালিয়ে গেছেন। আর যেসব কর্মকর্তা এখনও নজরদারিতে রয়েছেন তারা বেমালুম অস্বীকার করছেন সবকিছু, যদিও তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য-প্রমাণ রয়েছে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত