অনিয়মে ডুবছে দর্শনার কেরু

সরকারের রাজস্ব ক্ষতি অর্ধশত কোটি টাকা

আল-আমিন
প্রকাশ : ০৩ আগস্ট ২০২৫, ১০: ০২

দেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত মদ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান দর্শনার কেরু অ্যান্ড কোং (বাংলাদেশ) লিমিটেড। বিভিন্ন অনিয়মে ডুবতে বসেছে প্রতিষ্ঠানটি। অভিযোগের তীর ব্যবস্থাপনা পরিচালক মীর রাব্বিক হাসান ও বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের চেয়ারম্যান ড. লিপিকা ভদ্রের বিরুদ্ধে। তাদের দুর্নীতি ও অনিয়মে গত অর্থবছরে সরকার রাজস্ব হারায় অর্ধশত কোটি টাকার বেশি। এসব কারণে গত ১৯ জুন লিপিকাকে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠায় সরকার। অন্যদিকে আওয়ামী সরকারের সময় সুবিধা পাওয়া রাব্বিক হাসান ভোল পাল্টে এখন তার বাড়ি বগুড়ায় এবং নিজেকে জাতীয়তাবাদী চেতনার বলে প্রচার করছেন। চালিয়ে যাচ্ছেন চার সদস্যের গোপন সিন্ডিকেট।

বিজ্ঞাপন

দুদক সূত্রে জানা গেছে, করপোরেশনের বিনা অনুমতিতে রাব্বিক হাসানের বিরুদ্ধে গত আখ মাড়াই মৌসুমে ৬২ জন শ্রমিককে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে। তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নেওযা হয়েছে। তার একচ্ছত্র দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে এবার কেরু ডিস্টিলারি হতে অর্ধশত কোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারিয়েছে সরকার। এ বিষয়ে কেরুর দুই কর্মকর্তা দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদকে) একটি অভিযোগ জমা দেন। অভিযোগটি তদন্তের শেষপর্যায়ে এনেছে সংস্থাটি।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কেরুর এমডি মীর রাব্বিক হাসান আমার দেশকে গত সোমবার সন্ধ্যায় জানান, আমার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ বানোয়াট। বিষয়টি নিয়ে শিল্প মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তারা বিষয়টি দেখছে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুদকের একজন পরিচালক জানান, কেরুর বিষয়টি তদন্ত শেষপর্যায়ে এসেছে। দ্রুত তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, কেরুর বাংলা মদ (সিএস) প্লাস্টিক বোতলজাত করার কারণে ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে ফরেন লিকার (এফএল)। অথচ বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প করপোরেশনের এ প্রতিষ্ঠান কেরু থেকে সরকার রাজস্ব পায় কয়েকশ কোটি টাকা, যার শতকরা ৯০ শতাংশ আসে ফরেন লিকার (এফএল) থেকে।

দুদক জানায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে যেখানে এফএল (ফরেন লিকার) বিক্রি হয়েছিল দুই লাখ ২৮ হাজার ৭৯৩ কেস, সেখানে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বিক্রি হয় দুই লাখ দুই হাজার ৬৯৮ কেস। এতে গত অর্থবছরে সরকার আয়বঞ্চিত হয় প্রায় ৪৬ কোটি ৯৭ লাখ ১০ হাজার টাকা। সিএসের ক্ষেত্রেও কেরু এমডির দুর্নীতি ও একগুঁয়ে সিদ্ধান্তে পরিবেশ অধিদপ্তরের মতামতের তোয়াক্কা না করে ও অ্যালকোহল বিধিমালা না মেনে প্লাস্টিকের বোতলে বাজারজাত করে। সেখানেও অবিক্রীত অবস্থায় সরকারের রাজস্ব ক্ষতি হয়েছে কোটি কোটি টাকা।

সূত্র জানায়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে যেখানে সিএস বিক্রি ২৮ লাখ ৪ হাজার ৯০৯ প্রুফ লিটার, সেখানে ২০২৪-২৫ এ বিক্রি ২৪ লাখ ১৭ হাজার ৭১৫ প্রুফ লিটার। গত বছরের তুলনায় সদ্য শেষ হওয়া অর্থবছরে বিক্রি কম তিন লাখ ৮৭ হাজার ১৯৪ প্রুফ লিটার।

দুদক সূত্রে জানা গেছে, গত এক বছর ধরে নিয়ম ভেঙে চলছে মদের বোতলজাতকরণ। কেরুতে মদের বোতলজাতকরণে ব্যবহৃত নতুন মেশিনের অনুমোদন ছিল শুধু পরীক্ষামূলক উৎপাদনের জন্য। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কেরুর উৎপাদিত ও বোতলজাত দেশি লিকারের বোতলের গায়ে এবং লেবেলের ওপর ট্রেডমার্ক, প্রুফ একক সুরাশক্তি মদের পরিমাণ, ব্যাচ নম্বর, উৎপাদনের তারিখ ও উৎপাদকের নাম-ঠিকানাসহ বেশ কয়েকটি নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু তাদের উৎপাদিত বোতলের গায়ে উৎপাদনের তারিখ কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখের বিষয়টি উল্লেখ নেই। প্লাস্টিকের প্রতিটি বোতল সাত টাকা দরের হলেও সেখানে দাম দেখানো হয়েছে ১৪ টাকা।

সূত্র জানায়, ইতঃপূর্বে কেরুর চিনিকলে ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে যারা ছিলেন, তারা মাঠপর্যায়ে গিয়ে চাষিদের সুবিধা-অসুবিধাসহ প্রয়োজনীয় অভিযোগ-অনুযোগ শুনতেন। অভিযোগ রয়েছে, বর্তমান এমডি সবার কথা শুনছেন না। এতে চাষিরা দিকভ্রান্ত হয়ে গেছেন।

দুদকে আসা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ভুক্তভোগী জানান, কেরুতে বড় ধরনের একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। দুর্নীতি বন্ধ না হলে শিগগির রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানটি ডুবতে বসবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত