বিদ্যুতের আইএ বিধান বাতিলে উদ্বেগ উদ্যোক্তাদের

এম এ নোমান
প্রকাশ : ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪: ১১

বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি প্রকল্প বাস্তবায়নের নীতি থেকে ইমপ্লিমেন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট (আইএ) বা ‘বাস্তবায়ন চুক্তি’-এর শর্ত বাতিল করেছে সরাকর। সম্প্রতি ১০ সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য আহ্বান করা দরপত্রে এ বিধান বাতিল করা হয়। সরকারের এ সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিদ্যুৎ বিভাগের সচিবকে চিঠি দিয়েছেন বেসরকারি উদ্যোক্তারা।

বিজ্ঞাপন

বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মতে বিদ্যুৎ খাতের নীতি পরিবর্তনে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা নিরুৎসাহিত হবেন। পাশাপাশি বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ বাড়ার সঙ্গে গ্রাহক পর্যায়ে দামও বাড়বে। এ ছাড়া বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) লোকসানও বেড়ে যাবে। পিডিবির বর্তমান দেনা ৩০ হাজার কোটি টাকা। এটা দিন দিন আরও বাড়তে থাকবে বলেও আশঙ্কা বেসরকারি উদ্যোক্তাদের।

তবে পিডিবির দাবি নীতির পরিবর্তন হলে বিনিয়োগ আরও সহজ হবে। বাস্তবায়ন চুক্তি (আইএ) বাদ দেওয়া হলেও বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির (পিপিএ) মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করা অর্থের পূর্ণ নিশ্চয়তা দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন পিডিবির কর্মকর্তারা।

বিদ্যুৎ খাতের আইএ

বিদ্যুৎ খাতে ‘ইমপ্লিমেন্ট অ্যাগ্রিমেন্ট (আইএ) বা বাস্তবায়ন চুক্তি হচ্ছে, বিনিয়োগের ঝুঁকি মোকাবিলায় গ্যারান্টি ক্লজ। এটি বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির (পিপিএ) সম্পূরক চুক্তি হিসেবে দেখেন বিদ্যুৎ খাতের বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, আইএ বিধানের কারণে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে নিশ্চয়তা পেয়ে থাকেন। বাস্তবায়নকারী কোম্পানি স্বল্প সুদে ঋণসহ দাতা সংস্থা থেকে বিভিন্ন সুবিধা পেয়ে আসছেন আইএর মাধ্যমে।

বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ৫ ডিসেম্বর আইএ বিধান ছাড়া ৩২৩ মেগাওয়াট ক্ষমতার ১২টি নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ প্রকল্পের জন্য উন্মুক্ত দরপত্র আহ্বান করে। গত ৪ জানুয়ারি ৫০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরও ১০টি সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের দরপত্র আহ্বান করে।

দরপত্র অনুযায়ী, প্রকল্প বাস্তবায়ন ও চালু হওয়ার পর সরকার ২০ বছরের জন্য একটি নির্দিষ্ট দামে বিদ্যুৎ কিনতে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) স্বাক্ষর করবে। প্রকল্প বাস্তবায়নের বিষয়ে সরকার কোনো চুক্তি করবে না।

বিপাসহ উদ্যোক্তাদের উদ্বেগ

বিদ্যুৎ খাত থেকে আইএ বিধান বাতিলের বিষয়ে সরকারের সিদ্ধান্তে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এই খাতের বেসরকারি উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী এবং বিশেষজ্ঞরা। গত ৭ জানুয়ারি বিদ্যুৎ বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে এই উদ্বেগ জানান তারা।

বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা আমার দেশকে জানান, আইএ বিধান বাতিল করায় অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ খাতে নেওয়া প্রকল্পগুলোর জন্য ডাকা দরপত্রে দেশি-বিদেশি কোম্পানি ও বিনিয়োগকারীর সংখ্যা কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

একই বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে বাংলাদেশ ইন্ডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসার অ্যাসোসিয়েশনের (বিপা) সভাপতি কে এম রেজাউল হাসনাত বিদ্যুৎ সচিবকে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে বলা হয়েছে, আইএ বিধান বাদ দেওয়ার কারণে দরপত্রে অংশ নেওয়ার সময়ই বিনিয়োগকারীরা ব্যয় বেশি দেখাবে। এতে বিপাকে পড়বে পিডিবি। বেশি দাম দিয়ে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে বিক্রি করতে হবে। ফলে লোকসানের পাশাপাশি ভর্তুকিও বাড়বে পিডিবির।

বিপার চিঠিতে পিডিবির গত তিন অর্থবছরে ধারাবাহিক লোকসানের বিবরণ তুলে ধরে বলা হয়েছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮ হাজার ৭৬৪ কোটি টাকা, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১১ হাজার ৭৬৫ কোটি টাকা এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩ হাজার ২৩২ কোটি টাকা লোকসান করেছে। বর্তমানে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের পিডিবির কাছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা পাওনা বকেয়া পড়েছে। পিডিবির আর্থিক সংকটের কারণে তাদের এই টাকা পরিশোধ করতে পারছে না।

বিদ্যুৎ বিভাগের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন এমন একজন উদ্যোক্তা আমার দেশকে জানান, জ্বালানি খাতেও সরকারের কিছু ভুল নীতির কারণে বঙ্গোপসাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে অনেক ঘটা করে দরপত্র আহ্বান করে কোনো ভালো ফল আসেনি। সাতটি কোম্পানি দরপত্রের ডেটা কিনেও শেষ পর্যন্ত কেউ জমা দেয়নি। এটা হয়েছে ভুল নীতির কারণে। এখন বিদ্যুৎ খাতে একই ভুল করলে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলেও জানান তিনি।

বিদ্যুৎ খাত সংশ্লিষ্ট অপর একজন উদ্যোক্তা আমার দেশকে জানান, আইএ বিধান বাতিল হওয়ার কারণে সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাধাগ্রস্ত হবে এবং বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। তারা এ খাতে বিনিয়োগকে ঝুঁকি মনে করবেন। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলোও সক্ষমতা বিবেচনায় ঋণ সহায়তা দেওয়ার বিষয়ে আগ্রহী হবে না।

আইএ বিধান বাতিলের বিষয়ে বিপা সভাপতি কেএম রেজাউল হাসনাত আমার দেশকে বলেন, আমরা জানি সরকার নিশ্চয় দেশের কল্যাণেই কাজ করছে। আমরাও সবাই চাই দেশের অগ্রগতি ও উন্নতি চাই। ফলে বিদ্যুৎ খাতে যে কোনো উদ্যোগ নেওয়ার আগে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনা ও বিশেষজ্ঞদের মতামত নিলে তাতে ভালো ফল আসে।

পিপিএতে বিনিয়োগের নিশ্চয়তার কথা বলছে পিডিবি

বিদ্যুৎ খাত থেকে আই এ শর্ত বাতিলের বিষয়ে পিডিবির চেয়ারম্যান মো. রেজাউল করিম আমার দেশকে বলেছেন, এতে বিদ্যুৎ খাতের লাভ লোকসান কিংবা অন্য কোনো বিষয় যুক্ত নয়। বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে পিডিবির সম্পাদিত চুক্তির শর্তের মধ্যে বিনিয়োগের নিরাপত্তা বিধানের বিষয়টি যুক্ত থাকবে। আমরা যাদের সঙ্গে ২৫-৩০ বছরের বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি করব, তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করাও সরকারের অন্যতম দায়িত্ব। পিডিবি সেটা নিশ্চিতভাবে করবে।

যা বলছেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা

বিদ্যুৎ খাতের আইএ বিধানের বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন আমার দেশকে বলেন, আমি সরকারের উপদেষ্টা পর্যায়ে এ বিষয়ে কথা বলে যেটা বুঝতে পেরেছি, তা হলো সরকার চলমান বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলোর বিষয়ে বিশেষ বিধান শিথিল রাখবে। সামনে যেসব বিদ্যুৎ প্রকল্প হবে সেগুলোর বিষয়ে বিশেষ বিধান বাতিল থাকবে। আর সোলার পাওয়ার প্লান্টের বিষয়ে টেন্ডারিংয়ের বিষয়টি আমার কাছে এখনও পরিষ্কার নয়। কারণ যিনি সোলার প্লান্টের উদ্যোক্তা জমি তার নিজস্ব হলে এতে তার বিনিয়োগের নিরাপত্তার প্রয়োজন আছে। আর জায়গা যদি সরকারের হয়, তাহলে সেক্ষেত্রে নিরাপত্তার বিষয়টি টেন্ডারিংয়ের মাধ্যমেই নিশ্চিত করা যেতে পারে। তবে পুরো বিষয়টি স্বচ্ছ হওয়া উচিত, যাতে বিনিয়োগকারীরা আস্থা পায়।

এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ইজাজ হোসেন আমার দেশকে বলেন, বিগত সময়ে বিদ্যুৎ খাতে কোনো উদ্যোক্তা অনিয়ম করে থাকলে সেটাও জবাবদিহির আওতায় আনা জরুরি। যে কোনো উন্নত দেশেও এমনটাই হয়ে থাকে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত