হত্যার শিকার ৯, গায়েবি মামলায় ১১ হাজার নেতাকর্মীকে হয়রানি

আকরাম হোসেন, মানিকগঞ্জ
প্রকাশ : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১: ০৭
আপডেট : ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৬: ২৫

স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে মানিকগঞ্জ জেলাটি বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। ২০০৮ সাল থেকে জেলার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ চলে যায় আওয়ামী লীগের হাতে। এরপর থেকেই ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে বিরোধী দল তথা বিএনপি ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নেতাকর্মীদের ওপর শুরু হয় অমানুষিক নির্যাতন। গত সাড়ে ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও দলীয় পুলিশের হাতে হত্যার শিকার হন অন্তত নয়জন। এছাড়া আহত হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। আহতদের মধ্যে অনেকেই পঙ্গুত্ব বরণ করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এই সময়ে জেলার মোট ২৫১টি রাজনৈতিক গায়েবি মামলায় হয়রানির শিকার হন বিএনপি-জামায়াতের প্রায় ১১ হাজার নেতাকর্মী।

বিজ্ঞাপন

মামলার ঘানি টেনে অনেকেই নিঃস্ব। অনেকেই বাড়িতে ঘুমাতে পারতেন না। জাতীয় নির্বাচনের সময়টাতে বিএনপি-জামায়াতের পরিবারগুলো হয়ে পড়ত পুরুষশূন্য। এছাড়া জেলাজুড়ে আওয়ামী নেতাকর্মীদের লুটপাট, গ্রুপভিত্তিক চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, বালুমহালের নিয়ন্ত্রণসহ পরিবহন সেক্টরের ব্যাপক চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ ছিল সব শ্রেণি-পেশার মানুষ। কিন্তু এত নির্যাতন-নিপীড়নের স্বীকার হলেও মানুষের ছিল না বাক ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের বিরুদ্ধে কথা বললেই নেমে আসত হামলা-মামলার খড়্গ।

আওয়ামী দুঃশাসনে জেলায় ৯ জনকে খুন

২০১৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি হেফাজত ইসলামসহ সমমনা দলের হরতালের সমর্থনে মানিকগঞ্জ-সিঙ্গাইর-হেমায়েতপুর সড়কের গোবিন্দল নতুন বাজার এলাকায় মিছিল বের হয়। এ সময় পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ছোড়া গুলিতে নিহত হন নাজিম উদ্দিন মোল্লা, গোবিন্দল গ্রামের নাসির উদ্দিন, আলমগীর হোসেন ও শাহ আলম। এই ঘটনায় আরো ৩৬ জন গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন। তাদের অনেকেই এখন পঙ্গুত্ব বরণে করে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।

গোবিন্দলে পুলিশের গুলিতে নিহত আলমগীর হোসেনের চাচাতো ভাই আইনজীবী সোলাইমান কবির বলেন, ২০১৩ সালে গ্রামবাসীর ওপরে আওয়ামী লীগ ও তাদের দোসর পুলিশ বাহিনী বিনা উসকানিতে গুলি চালায়। এতে চারজন নিহত হওয়ার পরে থানায় তো কোনো মামলা-মোকদ্দমা নেয়ইনি, উল্টো গোবিন্দলবাসীর ওপরে ছয়টা মামলা দায়ের করে আওয়ামী লীগ।

বিশেষ করে সিংগাইর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়্যারম্যান মুসফিকুর রহমান খান হান্নান, সিংগাইর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মাজেদ, সায়েদুর, শহীদসহ আওয়ামী লীগের নেতারা মামলাগুলো দায়ের করেন। এর মধ্যে দুটি হত্যা-মামলা দেওয়া হয় গোবিন্দলবাসীর ওপরে। সেই মামলায় ইউনিয়ন পরিষদের ৯ জন সাবেক সদস্যসহ অনেকেই ৭৮ দিন জেল খাটেন। এই মামলায় প্রায় ২০০ থেকে ২৫০ জনকে আসামি করা হয়।

এছাড়া গত বছরের জুলাই-আগস্টের আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন মানিকগঞ্জের আরো পাঁচজন। তারা হলেন শিবালয় উপজেলার উলাইল ইউনিয়নের রুপসা গ্রামের মো. রফিকুল ইসলাম, সিংগাইর উপজেলার ধল্লা খানপাড়ার সাদ মাহমুদ খান, হরিরামপুর উপজেলার চালারকৌড়ী গ্রামের মহিউদ্দিন মোল্লা, সাটুরিয়া উপজেলার দরগ্রামের সন্তান আফিকুল ইসলাম সাদ ও মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার শফিক উদ্দিন আহমেদ।

পুলিশের গুলিতে নিহত ইউনিয়ন যুবদলের কর্মী রফিকুল ইসলামের আয়েই চলত তাদের সংসার। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বৃদ্ধ বাবা মো. রহিজ উদ্দিন (৬৫) এখন দিন পার করছেন অতি কষ্টে।

কেমন আছেন জানতে চাইলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে রহিজ উদ্দিন বলেন, ‘যেসব বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ উঠেছে তারাই শুধু বলতে পারবে এই অনুভূতি। এটা কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছি না। এই বয়সে নিজেরই চলাফেরা করা কষ্টের, তার ওপর পরিবারের খরচ বহন করা এখন খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে।

গায়েবি মামলা-হামলায় জর্জরিত আওয়ামী বিরোধী শিবির

শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনের সাড়ে ১৬ বছরে ২৫১টি মামলায় আসামি করা হয় বিএনপি ও জামায়াতের প্রায় ১১ হাজার নেতাকর্মীকে। অনেকেই নির্যাতনের শিকার হয়ে গুরুতর আহত হয়েছেন। আবার সাবেক ছাত্রনেতাদের গুমের চেষ্টাও হয়েছে একাধিকবার। সভা-সমাবেশ, মিছিল-মিটিংয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অতি উৎসাহী সদস্যদের পাশাপাশি আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের বাধা-বিপত্তি ও হামলা ছিল সাধারণ ঘটনা। বিএনপি ও জামায়াতের অনেকে ঠিকমত বাড়িতে ঘুমাতে পারেননি। সারা বছরই এসব দলের কোনো না কোনো নেতাকে জেলহাজতে থাকতে হয়েছে গায়েবি কিংবা ভুয়া নাশকতার মামলায়।

এছাড়া বড় রাজনৈতিক হামলার ঘটনা ঘটে ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। তিনটি আসনের বিএনপির প্রার্থীদের ওপর হামলা করা হয় তখন। নির্বাচনি প্রচারণায় মানিকগঞ্জ-৩ আসনের প্রার্থী আফরোজা খানম রিতা সাটুরিয়া গেলে তার ওপর যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সশস্ত্র গুণ্ডা-পাণ্ডারা হামলা চালায়। তার বহরে থাকা মোটরসাইকেল ও তার গাড়ি ভাঙচুর করে তারা। একই চিত্র ছিল মানিকগঞ্জ ১ ও ২ আসনের প্রার্থীদের ক্ষেত্রেও। পাশাপাশি গায়েবি মামলার সংখ্যাও বাড়তে থাকে তখন। আওয়ামী লীগের হামলা ও পুলিশি বাধায় কোণঠাসা হয়ে পড়েন বিএনপির প্রার্থীরা।

বিরোধীদলের রাজনীতি করতে গিয়ে হামলা-মামলার শিকার হয়েছে অনেকেই। তাদের মধ্যে মানিকগঞ্জ জেলা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি ও জেলা যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক মাসুদ পারভেজ অন্যতম। ৪৬টা মামলার আসামি হয়ে ৩৫ বার কারাবরণ করেন তিনি। ৩৫ বারই তাকে রিমান্ডের মুখোমুখি হতে হয়। একাধিকবার তাকে গুম করার চেষ্টাও করা হয়েছে বলে জানান তিনি। মাসুদ পারভেজ বলেন, বিগত ফ্যাসিস্ট সরকারের সেই ভয়াবহতার কথা মনে হলে এখনো গা শিউরে ওঠে। তারপরও তাদের জুলুম-অত্যাচারে আমরা দমে যাইনি।

আওয়ামী লীগ সরকার আমলে নয়টি মামলার আসামি ছিলেন মানিকগঞ্জ পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মুরাদ হোসেন। হামলা মামলায় জর্জরিত হয়ে প্রায় সর্বশান্ত হয়ে পড়েন তিনি। মুরাদ হোসেন বলেন, গত বছরের ১৭ জুন ঈদের আগের রাত সাড়ে ৯টার দিকে পৌর শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক হাসমত আলীর নেতৃত্বে ৪০ থেকে ৫০ জন গুণ্ডাবাহিনী আমার বাড়িতে ঢুকে আমাকেসহ আমার চার বছরের বাচ্চা থেকে শুরু করে ৬৫ বছরের বৃদ্ধ মায়ের ওপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে বর্বর হামলা চালায়। তখন আমরা কোনো আইনি সহযোগিতাও পাইনি।

আওয়ামী ফ্যাসিবাদের শিকার আরো কয়েকশ নেতাকর্মী গুরুতর আহত হয়ে তাদের অনেকেই এখনো মানবেতর জীবনযাপন করছেন। ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতন ঘটলেও এখনো অনেকেই মামলা-হামলার দুঃসহ সেই স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন।

আওয়ামী আমলের এমপি-মন্ত্রীদের দৌরাত্ম্য

জেলার ঘিওর-দৌলতপুর-শিবালয় উপজেলা নিয়ে সংসদীয় ১ আসনে ২০০৮ সালের পাতানো নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী বিজয়ী হন এ বি এম আনোয়ারুল হক। এরপর নৌকার টিকিটে এই আসনটি এক রকম নিয়ন্ত্রণে নেন সাবেক ক্রিকেটার এ এম নাঈমুর রহমান দুর্জয়। এখানকার একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে দুর্জয়ের লোকজন। এতে অন্যতম ভূমিকা ছিল দুর্জয়ের চাচা ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক তায়েবুর রহমান টিপু ও দুর্জয়ের মা জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি নীনা রহমান।

চাকরি-বাণিজ্য, দখল-বাণিজ্য, বালু-মাটির রমরমা ব্যবসা করে তারা হাতিয়ে নেন শত কোটি টাকা। তাদের ইশারায় চলত এখানকার সবকিছু।

মানিকগঞ্জ-২ আসনে ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার আমলের প্রথমবারে শরিক দল জাতীয় পার্টি থেকে এই আসনে নির্বাচিত হন এস এম মান্নান। পরেরবার আসনটির নেতৃত্ব চলে যায় মমতাজ বেগমের হাতে। ভাগনে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ভিপি শহীদ ও সৎ ছেলে সিংগাইর পৌরসভার মেয়র আবু নাঈম বাশারকে নিয়ে চাঁদাবাজি, জমি দখল, টেন্ডারবাজি, বালুমহালের নিয়ন্ত্রণসহ নানা অপকর্ম করে থাকেন মমতাজ। এক সময়ের দারিদ্র্যপীড়িত মমতাজ ক্ষমতার ছড়ি হাতে পেয়ে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন।

সিংগাইর ও হরিরামপুর উপজেলার বালুমহালও তার নিয়ন্ত্রণে। মমতাজের নামে-বেনামে রয়েছে ঢাকাসহ মানিকগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় একাধিক বাড়ি, হাসপাতাল, রেস্টুরেন্ট, কোল্ড স্টোরেজ ও স্থায়ী মেলার মঞ্চ। মানিকগঞ্জে তার ৫০০ শতাংশ জমির ওপর রয়েছে একটি বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়ি।

মানিকগঞ্জ-৩ আসনে হাসিনা আমলের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এই আসনের নিয়ন্ত্রণ থাকে জাহিদ মালেকের হাতে। সংসদীয় এলাকায় ফিল্মি স্টাইলে শুরু হয় তার রামরাজত্ব। আইনের কোনো তোয়াক্কা না করে নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ করতেন তিনি। সংসদ সদস্য (এমপি) থেকে প্রথমে স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী এবং পরে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হন জাহিদ মালেক। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।

মন্ত্রীর ফুফাতো ভাই ও আওয়ামী লীগ নেতা ইসরাফিল হোসেন, গড়পাড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আওয়ামী নেতা আফসার উদ্দিন সরকার, জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সুলতানুল আজম খান আপেল, পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম ছিলেন মালেক বাহিনীর অপরাধ জগতের প্রধান চার খলিফা। জেলায় এমন কোনো অপকর্ম নেই, যেখানে তাদের ইশারা ছিল না।

স্থানীয় বাসিন্দা ও গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, গড়পাড়া ঘোষের বাজার এলাকায় জমি দখল করে বিশাল বাগানবাড়ি করেন জাহিদ মালেক। মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে ১০ তলা বাণিজ্যিক ভবন, নিজ এলাকায় ছেলের নামে শুভ্র সেন্টার, বনানীতে ১৪ তলা বিটিএ টাওয়ার, ঢাকায় একাধিক ফ্ল্যাট, প্লটসহ নামে-বেনামে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন জাহিদ মালেক।

হলফনামায় দেখা গেছে, ২০০৮ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকা পর্যন্ত জাহিদ মালেকের সম্পদ বেড়েছে প্রায় ১১ গুণ। বালুমহাল নিয়ন্ত্রণে আফসার সরকার, পরিবহন সেক্টরে জাহিদুল ইসলাম, টেন্ডারবাজি ও চাঁদাবাজিতে আপেল শত কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় করেন জাহিদ মালেক। একই সঙ্গে তার খলিফারাও অর্ধশত কোটি টাকার মালিক বনে যান।

জাহিদ মালেকের ক্ষমতার দাপটে তার স্ত্রী শাবানা মালেকও হয়ে ওঠেন অর্থলোভী। মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় তিনি নিজেই গড়ে তোলেন পরিবহন চাঁদাবাজির এক শক্তিশালী সিন্ডিকেট। প্রথমে মানিকগঞ্জ জেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি বাবুল সরকারকে চাঁদা তোলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রতিদিন পরিবহন সেক্টর থেকে তাকে ১ লাখ টাকা চাঁদা দিতে হতো। পরে বাবুল সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হলে পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলামকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়। অভিযোগ আছে, শাবানা মালেক ক্ষমতার প্রভাবে একাধিক স্কুলের সভাপতির পদও বাগিয়ে নেন।

মন্ত্রীপুত্র রাহাতের সন্ত্রাসী বাহিনী ও লুটপাটের সাম্রাজ্য

বাবার প্রতাপে রাহাত মালেক শুভ্র গড়ে তোলেন এক বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী। জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সিফাত কৌরাইশি সুমন ও ইরাদ কৌরাইশি ইমন্ত—এই দুই ভাইয়ের মাধ্যমে রাহাত জেলায় তার আধিপত্য বিস্তার করেন। তিনি দখল করে নেন এলাকার অবৈধ বালু ব্যবসা ও সাধারণ মানুষের শত শত বিঘা জমি। এমনকি সরকারি হাসপাতালে চাকরির বাণিজ্যও শুরু করেন রাহাত।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী থাকাকালে জাহিদ মালেক মানিকগঞ্জে জাগির ইউনিয়নের উকিয়ারায় সরকারি ওষুধ উৎপাদক প্রতিষ্ঠান এসেনশিয়াল ড্রাগসের কারখানা স্থাপনের উদ্যোগ নেয়। এই উদ্যোগের আগেই জাহিদ মালেক উকিয়ারায় নিজের, স্বজনদের ও অনুসারীদের নামে ৩১ একর নিচু জমি কিনে নেন। পরে সেই জমির কিছুটা ভরাট করে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে জমির দাম কয়েকগুণ বাড়ানোর পাঁয়তারা করেন।

কিন্তু মানিকগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসক (ডিসি) আব্দুল লতিফ এ বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়ে জানান, এই স্থানে কারখানা স্থাপন করলে সরকারের প্রায় ১০০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হবে। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে জাহিদ মালেক তার লোকজন দিয়ে ডিসির অপসারণের দাবিতে বিক্ষোভ সমাবেশ করান। তবে এতে কাজ হয়নি।

এই প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের সময় অনেকের জমি জোরপূর্বক দখলে নেওয়ার অভিযোগও পাওয়া যায়। সেই ভুক্তভোগীদের একজন আব্দুল করিম। ভাতিজা গফুর বলেন, ‘আমার চাচার ১২ শতাংশ জমি দখল করে নেয় সাবেক মন্ত্রীর লোকজন। দলিল করে না দিলেও তিনি মাটি ফেলে ভরাট করে দখলে নেন। ভয়ে তখন আমরা মুখ খোলারও সাহস পাইনি।’

এছাড়া সাটুরিয়ার ধানকোড়া ইউনিয়নের কামতা মৌজায় নিজের ১৫ বিঘা জমি ভরাট করার সময় পাশের আরেকজনের ৭৮ শতাংশ জমিও ভরাট করে দখলে নেন তিনি। জমির মালিক খাদেমুল ইসলাম পিনু এ ব্যাপারে মামলাও করেন।

জাহিদ মালেকের নিজের গ্রাম গড়পাড়ার বাড়ির পাশেই মীর আলমের বাড়ি জোরপূর্বক দখল করে তাদের উচ্ছেদ করে ৩১ শতাংশ জমি এখনো দখল করে রেখেছে। ক্ষমতার দাপটে তখন কেউ মুখ না খুললেও এখন ঠিকই বেরিয়ে আসছে থলের বিড়াল।

মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের পাশে লাবু মিয়া নামের এক ব্যক্তির জমি দখল করে গড়ে তোলে দশ তলা আলিশান ভবন। সেই শোকে স্ট্রোক করে বিছানায় পড়ে কাতরাচ্ছেন লাবু মিয়া। লাবুর পাশেই মানিকগঞ্জ জজ কোর্টের আইনজীবী নজরুল ইসলাম বাদশার জমি। সেখানে দোতলাবিশিষ্ট মার্কেট করে ভাড়া দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু সেখানেও চোখ পড়ে মন্ত্রীর ছায়াতলে বেড়ে ওঠা আওয়ামী লীগের গুণ্ডা-পাণ্ডাদের। ভাড়ার কথা বলে দখল করে গড়ে তোলে দলীয় কার্যালয়।

সচেতনমহল ও রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) মানিকগঞ্জের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম বিশ্বাস বলেন, ক্ষমতায় আসার পর জাহিদ মালেক তার দলের পছন্দের নেতাকর্মীদের নিয়ে একটি শক্তিশালী বলয় তৈরি করেন। পরে তারাই বালুমহাল, পরিবহন খাত, টেন্ডারবাজিসহ সব খাত নিয়ন্ত্রণ করে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেন। এই অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে দ্রুত আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান তিনি।

জানতে চাইলে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও মানিকগঞ্জ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আফরোজা খান রিতা বলেন, আমাদের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে গায়েবি ১৭২টি মামলা দেওয়া হয়। এসব মামলায় প্রায় ১০ হাজার নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়।

সিংগাইরের গবিন্দলে হরতাল পালনকালে স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা নাজিম উদ্দিন মোল্লা ও ছাত্র-জনতার আন্দোলনে যুবদল নেতা রফিকুল ইসলাম খুন হন। এ ধরনের মামলার মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট হাসিনার একমাত্র লক্ষ্য ছিল—বিরোধী দলকে দমন করা, গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে স্তব্ধ করা এবং জনগণের কণ্ঠস্বর রোধ করা। আওয়ামী লীগ সরকার গায়েবি মামলা দিয়ে বিএনপির তৃণমূল নেতাকর্মীদের ঘরে ঘরে আতঙ্ক তৈরি করেছে। এভাবে তারা গণতন্ত্রকে হত্যা করছে এবং একদলীয় শাসন কায়েমের নীলনকশা বাস্তবায়ন করেছে।

জেলা জামায়াতে ইসলামীর আমির মাওলানা কামরুল ইসলাম বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার আমাদের বিরুদ্ধে ৭৯টি মামলা করে। এতে প্রায় ১ হাজারের মতো নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছিল। এছাড়া অসংখ্য নেতাকর্মীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। সিংগাইরে ২০১৩ সালে আওয়ামী লীগ যে হত্যাকাণ্ড ঘটায় সেখানেও আমাদের ইউনিয়ন জামায়াতের সভাপতি নাছির উদ্দিন শহীদ হন। এ ছাড়া আমার নামেও ২১ মামলা হয়েছিল এবং চারবার কারাবরণ করতে হয়েছে আমাকে।

অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের বহন করা সেই প্রিজন ভ্যানে কী আছে

অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তাদের নেয়া হয়েছে ক্যান্টনমেন্টের অস্থায়ী কারাগারে

গাজায় স্বাস্থ্য সংকট কয়েক প্রজন্ম থাকবে: বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা

সেনা কর্মকর্তারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল: আসামিপক্ষের আইনজীবী

দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানে মুসলিম বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান এরদোয়ানের

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত