আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

বালুমহালের নিয়ন্ত্রণ চায় দুই মন্ত্রণালয়

বেলাল হোসেন

বালুমহালের নিয়ন্ত্রণ চায় দুই মন্ত্রণালয়
ফাইল ছবি

দেশের বালুমহালগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিবাদে জড়িয়েছে সরকারের দুই বিভাগ। বালু উত্তোলন ও বিক্রির এখতিয়ারের জন্য দ্বন্দ্ব বেধে গেছে ভূমি ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের মধ্যে। সম্প্রতি তিন জেলা প্রশাসক (ডিসি) অভিযোগ দেওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে বিতর্ক চরমে পৌঁছায়। দীর্ঘদিনের বিরোধ মেটাতে বৈঠকের উদ্যোগ নেওয়া হয়, সমস্যা সমাধানে করা হয় যৌথ আলোচনা। কিন্তু দুই দফা বৈঠকেও সমাধান আসেনি।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের দাবি, সারা দেশের বালুমহালের মালিক তারা। বালু উত্তোলনের অনুমতিও তারা দেবে। অপরদিকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) দাবি, বালুমহালগুলোর মালিকানা তাদের। বালু উত্তোলনের অনুমতি দেওয়ার একমাত্র এখতিয়ারও তাদের।

বিজ্ঞাপন

নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের তৎকালীন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান (বর্তমানে কারাগারে) অঘোষিতভাবে দেশের বালুমহালগুলো নিয়ন্ত্রণ করতেন। একপর্যায়ে তিনি বালুখেকো মন্ত্রী হিসেবে পরিচিতও পান। মন্ত্রী থাকাকালে শাজাহান খান ছিলেন প্রভাবশালী ও অপ্রতিরোধ্য। তিনি বিআইডব্লিউটিএর ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন। মন্ত্রিত্ব হারানোর পরও তার সিন্ডিকেট কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছিল। বিআইডব্লিউটিএর সব খাতে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী গড়ে তোলেন শাজাহান। তিনি বন্দরসহ বিভিন্ন খাতে টেন্ডার বাণিজ্যও করতেন। তার প্রভাবে সবাই ভীত থাকতেন। এমনকি টেন্ডারের ভাগের টাকা গণভবনে যেত বলেও অভিযোগ আছে।

সম্প্রতি বালু উত্তোলনের অনুমতি দেওয়া নিয়ে কক্সবাজার, সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজারের ডিসি এবং বিআইডব্লিউটিএর মধ্যে জটিলতা দেখা দেয়। এসব ঘটনায় বিআইডব্লিউটিএর বিরুদ্ধে মন্ত্রণালয়ে অভিযোগ দেন সংশ্লিষ্ট ডিসিরা।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২৫ তৈরি হয়েছে। বিধি অনুযায়ী বালুমহাল ইজারা দেওয়ার জন্য একটি কমিটি গঠন করবেন ডিসি। কমিটিতে সদস্য হিসেবে থাকবেন বিআইডব্লিউটিএর একজন প্রতিনিধি। কিন্তু ডিসিকে না জানিয়ে পুরো বালুমহালের ইজারার কাজ তারা তদারক করছেন। এ কারণে দেশের বেশকিছু জায়গায় সমস্যা তৈরি হচ্ছে।

তৈরি হওয়া জটিলতা নিরসনে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ নির্দেশনা দেয়। বিষয়টি নিয়ে গত ৩০ নভেম্বর ও চলতি মাসে ভূমি মন্ত্রণালয়ে দুটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়। তবে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি ভূমি মন্ত্রণালয়।

সরকারি বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইনে বলা আছে, কোনো চর বা স্থল এলাকা থেকে বালু, মাটি বিক্রির অনুমোদন বা ইজারা দেওয়া যাবে। এক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রকল্প থেকে উত্তোলিত বালু বা মাটি বিপণনের প্রয়োজন হলে একক কর্তৃপক্ষ হিসেবে থাকবে ভূমি মন্ত্রণালয়। জেলাপর্যায়ে মন্ত্রণালয়ের ক্ষমতা বাস্তবায়ন করবেন ডিসিরা। তারা একটি কমিটি করে ইজারার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।

যে বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব

ভূমি মন্ত্রণালয়ে বৈঠকের বিষয়ে জানা গেছে, মৌলভীবাজারের জেলা প্রশাসক চলতি বছরের আগস্টে অভিযোগ আকারে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়কে জানান, বালু উত্তোলনে বিআইডব্লিউটিএ অনুমতি দেওয়ার আগে জেলা প্রশাসক এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকে জানায়নি। যদিও বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১০ (সংশোধন, ২০২৩) ও বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২৫-এ ব্যক্তিপর্যায়ের প্রয়োজনে বালু উত্তোলনের কোনো সুযোগ নেই। এরপরও বিআইডব্লিউটিএ নিজস্ব বিবেচনায় বালু উত্তোলনের অনুমতি দিয়েছে।

সুনামগঞ্জের ডিসি জানান, সুনামগঞ্জ সদর ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার গোপাজান নদীর অক্ষয়নগর, উত্তর রামপুর ও রতারগাঁও মৌজা থেকে বালু তুলতে বিআইডব্লিউটিএ ইজারাদারকে অনুমতি দেয়। কিন্তু বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানানো হয়নি।

অপরদিকে কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের অভিযোগে উঠে আসে, বিআইডব্লিউটিএ মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পের (সওজ অংশ) আওতায় মাতারবাড়ী পোর্ট এক্সেস রোড নির্মাণের জন্য কক্সবাজার (কস্তুরাঘাট) নদীবন্দর সীমানা উল্লেখ করে মহেশখালী চ্যানেলের হামিদারদিয়া ও ঠাকুরতলা মৌজায় বালু তুলতে ঠিকাদার নিয়োগ দেয়। চুক্তিতে উল্লিখিত স্থানের বাইরে কক্সবাজার সদর উপজেলার বাঁকখালী নদীর মোহনা থেকে বালু উত্তোলন করা হয়।

তবে জাতীয় বালুমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটি আইনের ধারা ১২-এর উদ্দেশ্য পূরণে নিম্নবর্ণিত সদস্যদের সমন্বয়ে জাতীয় কমিটি গঠন করা হবে। এখানে মন্ত্রী বা ক্ষেত্রমত উপদেষ্টা, ভূমি মন্ত্রণালয়, যিনি তার সভাপতিও হবেন; প্রতিমন্ত্রী, ভূমি মন্ত্রণালয়; সিনিয়র সচিব বা ক্ষেত্রমত সচিব, ভূমি মন্ত্রণালয় ছাড়াও বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিব ও বিভাগের চেয়ারম্যান ২৩ জন মিলে জাতীয় কমিটি গঠন করা হবে। উপবিধি (১)-এ যা কিছুই থাকুক না কেন, ভূমি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে কেবল প্রতিমন্ত্রী থাকলে তিনি জাতীয় কমিটির সভাপতি হবেন। জাতীয় কমিটির ন্যূনতম সাত সদস্যের উপস্থিতিতে সভার কোরাম গঠন হবে।

জেলা বালুমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠনের বিষয়ে আরো বলা হয়েছে, জেলা প্রশাসককে সহায়তা করার জন্য আইনের ধারা ১০-এর উদ্দেশ্য পূরণে সব জেলায় নিম্নবর্ণিত সদস্য সমন্বয়ে জেলা বালুমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটি গঠন করা হবে। এতে জেলা প্রশাসক, যিনি কমিটির সভাপতিও হবেন; বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তাদের নিয়ে মোট ১৫ সদস্যের জেলা কমিটি গঠন করা হয়। জেলা কমিটির ন্যূনতম সাত সদস্যের উপস্থিতিতে কমিটির সভার কোরাম গঠন হবে।

বিআইডব্লিউটিএর চেয়ারম্যান কমডোর আরিফ আহমেদ মোস্তফা আমার দেশকে বলেন, বিআইডব্লিউটিএ অর্ডিন্যান্স, ১৯৫৮-এর ১৫(৪) ধারায় দেওয়া ক্ষমতাবলে খননসংক্রান্ত কাজ করে। ফলে এসব নদীবন্দরের নিয়ন্ত্রণাধীন নৌপথ এবং নদীবন্দর সীমানার মধ্যে নাব্য সংরক্ষণ এবং সুষ্ঠু নৌ চলাচল নিশ্চিত করাই সংরক্ষক হিসেবে বিআইডব্লিউটিএর অন্যতম প্রধান কাজ।

বর্তমান বিধিমালায় আপত্তি জানিয়ে কমডোর আরিফ বলেন, নৌ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ঘোষিত নদীবন্দর সীমানা এবং সরকার ঘোষিত বিআইডব্লিউটিএর সংরক্ষিত নৌপথ ও বালুমহাল ঘোষণার বহির্ভূত হতে হবে।

ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব সালেহ আহমেদ আমার দেশকে বলেন, জাতীয় নির্বাহী কমিটির আদেশে এটা নিয়ে কাজ করছি। সরকারের সম্পদ রক্ষার দায়িত্ব একটি জেলায় বেসিক্যালি ডিসিদের ওপর বর্তায়। বিষয়টি নিয়ে আমরা সামনে একটি মিটিং করব এবং এখানে বিআইডব্লিউটিএ, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, খনিজ ও জ্বালানি বিভাগসহ আরো অনেকে থাকবে আলোচনায়। এখানে যদি নতুন বালুমহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২৫-এ কোনো সমস্যা মনে হয়, সেক্ষেত্রে আমরা প্রয়োজনে আবার বিধিমালা পরিবর্তন করতে পারি।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর

খুঁজুন