আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

নিশিরাতের ভোটের কুশীলবরা এখনো বিমানের হর্তাকর্তা

কবিতা
নিশিরাতের ভোটের কুশীলবরা এখনো বিমানের হর্তাকর্তা

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। তবে এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্পর্শকাতর সংস্থা বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে ফ্যাসিবাদের দোসররা এখনো বহালতবিয়তে।

সেখানে সংস্কারের বিন্দুমাত্রা ছাপ পড়েনি। বিমানের সার্বিক অবস্থা দেখভালের নেই কেউ। নেই তেমন কোনো জবাবদিহিও। এসব কারণে আওয়ামী সুবিধাভোগীসহ নিশিরাতের ভোটের কুশীলবরা এখনো ছড়ি ঘোরাচ্ছেন সাধারণ কর্মী ও একসময়ের আওয়ামীবিরোধীদের ওপর।

বিজ্ঞাপন

বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হাসান আরিফ মারা যাওয়ার পর থেকে মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার পদটি এখনো শূন্য। ফলে মন্ত্রণালয় থেকে শুরু করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে চলছে ধীরগতি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিমানে এখনো স্বৈরাচারের দোসরদের জুলুমের শিকার হচ্ছেন সাধারণ কর্মীরা। শেখ হাসিনার নিশিরাতের ভোটের মাস্টারমাইন্ডরা বিমানের পরিচালকের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে আসীন রয়েছেন।

তাদের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও একসময়ের দিনাজপুরের ডিসি মাহমুদুল আলম বর্তমানে বিমানের পরিচালক (প্রকিউরমেন্ট অ্যান্ড লজিস্টিক সাপোর্ট) হিসেবে কর্মরত। তিনি শেখ হাসিনার সময় ‘প্রাইজ পোস্টিং’ হিসেবে বিমানে পদায়ন লাভ করেন। ২০১৮ সালের নৈশভোটের অন্যতম কুশীলব তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ডিসি হায়াত উল্লাহ খান ২০২৪ সালের এপ্রিলে ‘প্রাইজ পোস্টিং’ হিসেবে বিমানের পরিচালক (গ্রাহকসেবা) হিসেবে যোগদান করেন। তিনিও বহাল রয়েছেন এই পদে।

গোপালগঞ্জে বাড়ি বিমানের কেবিন ক্রু মনির খান শেখ সেলিমের আত্মীয় পরিচয়ের সুবাদে ব্যতিক্রম ৪ থেকে ৩ ধাপ ডিঙিয়ে ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার (প্রকিউরমেন্ট) হিসেবে পদোন্নতি পান। বর্তমানে তাকে ডিজিএম থেকে জিএম বানানোর পাঁয়তারা চলছে। কেবিন ক্রু সোমা বড়ুয়া আওয়ামী লীগের তৎকালীন কেন্দ্রীয় কমিটির দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়ার স্ত্রী।

তিনিও আছেন দাপটের সঙ্গে। ক্যাপ্টেন শুমাইলা ডেপুটি চিফ অব টেকনিক্যাল বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। এ জন্য তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। হাসিনার সুপারিশে পরিচালক (ফ্লাইট অপারেশন) ক্যাপ্টেন তাসমিন দোজা নিয়োগ পান। এখনো তিনি পদে বহাল।

তাহেরা খন্দকার ছাত্রলীগ নেতা শফি আহমেদের স্ত্রী। তিনি বর্তমানে জেনারেল ম্যানেজার (বিক্রয় ও প্রকাশনী)। বিমান শ্রমিক লীগের সভাপতি মশিকুর রহমানকে হাসিনার সময় টরন্টোতে পোস্টিং দেওয়া হয়। কাজের চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও তিনি সেখানেই রয়ে গেছেন। গত ১৫ বছর ধরে বিভিন্ন অপকর্মের সঙ্গে জড়িত ছিলেন সিবিএর সাবেক এই নেতা। বর্তমান সরকারের আমলেও তিনি বড় পদ বাগিয়ে নিয়েছেন। ফলে বিমানের সাধারণ কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ বাড়ছে।

সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগের তৎকালীন নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের ভাগ্নিজামাই পাইলট এনাম। তিনি একের পর এক অনিয়ম করে গেলেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তিনি চিফ অব শিডিউলিং।

সম্প্রতি বিমানের বিজি ২০২ ফ্লাইটে আইডি না থাকায় লন্ডন বিমানবন্দরে আটকে দেওয়া হয় এই সিনিয়র পাইলটকে। বাধ্য হয়ে চরম ঝুঁকি নিয়ে এক পাইলট ও এক ফাস্ট অফিসার দিয়ে ওই ফ্লাইটকে ঢাকায় ফিরতে হয়েছে। জানা গেছে, পাইলটের এই স্বেচ্ছাচারিতা ও খামখেয়ালির কারণে বিমানকে মোটা অঙ্কের টাকা জরিমানা গুনতে হয়েছে।

এ ঘটনায় বিমান কর্তৃপক্ষ এখন পর্যন্ত কোনো তদন্ত কমিটি বা পাইলটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সেফটি বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তা হয়েও ক্যাপ্টেন এনাম সেফটির বিষয়ে বিমানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন।

সূত্র জানায়, ফেসবুকে বেগম খালেদা জিয়াকে নিয়ে কুরুচিপূর্ণ, নোংরা বক্তব্য দেওয়া ক্যাপ্টেন তাপস বিমানে এখনো বহাল। তিনি আবার বিমানের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ও প্রধান নির্বাহী মো. সাফিকুর রহমানের আত্মীয়। সাফিকুর রহমান আবার গোপালগঞ্জের লোক। কোনো বিজ্ঞাপন ছাড়াই তাকে এমডি পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

৫ মাস পার হয়ে গেলেও এমডি পদের জন্য এখনো কোনো বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়নি। সূত্র বলছে, সাফিকুর রহমান বর্তমান চেয়ারম্যান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর বিশেষ আশীর্বাদপুষ্ট। তাই নতুন করে আর এমডি নিয়োগের কথা ভাবছেন না তিনি।

মুয়ীদ চৌধুরী বিমানের চেয়ারম্যান হওয়ার পর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে আশার আলো সঞ্চারিত হয়েছিল। তিনি জাতীয় পর্যায়ে জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের প্রধান হয়ে সংস্কার করলেও বিমানের ফ্যাসিবাদী দোসরদের এখনো সংস্কার করতে পারেননি।

গত ৫ মাসে নারিতা ও ম্যানচেস্টার রুটে ৫০০ কোটি টাকা লোকসান হলেও তা বন্ধের কোনো উদ্যোগ নেয়নি বিমান। সচেতন মহলের প্রশ্ন- কার স্বার্থে বিমান এখনো এই রুটগুলো পরিচালনা করছে। অন্যদিকে বিগত ১৬ বছরেও বিমানকর্মীদের কোনো ভাতা বাড়েনি। এমনকি পেনশনভোগীরাও তাদের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত। এতে ভুক্তভোগীদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে।

সূত্র জানায়, বিমানের ৬ হাজারের মধ্যে ৩ হাজার হচ্ছেন ‘ক্যাজুয়াল কর্মী’। এদের মধ্যে অনেকের চাকরির মেয়াদ ১৬ থেকে ১৮ বছর হলেও তাদের এখনো স্থায়ী করা হয়নি। আবার চুক্তিভিত্তিক কর্মরতদের মাঝেও রয়েছে বেতনবৈষম্য। এসব ক্যাজুয়াল ও চুক্তিভিত্তিক ‘জি’ নম্বরধারী কর্মচারীরা বিমানের প্রধান চালিকাশক্তি। তারা দিনরাত মাঠে কাজ করে বিমানকে সহায়তা করছেন। এগুলো সমাধান না করে আবার নতুন নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে। এতে বিমানে অসন্তোষ বাড়ছে। অন্যদিকে বিমান সিবিএ শ্রমিক লীগের সক্রিয় নেতাদের পদোন্নতি ও ফ্রন্ট পোস্টিং দিয়ে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে।

অভিযোগ রয়েছে, বাংলাদেশ এয়ারলাইন পাইলটস অ্যাসোসিয়েশনের (বাপা) সাবেক সভাপতি ক্যাপ্টেন মাহবুবকে আওয়ামীবিরোধী মতাদর্শী হওয়ায় চাকরিচ্যুত করা হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, ভিন্ন মতাদর্শের হওয়ার কারণে এই চাকরিচ্যুতি ছিল সম্পূর্ণ অন্যায়, অযৌক্তিক ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

ক্যাপ্টেন মাহবুব আমার দেশকে বলেন, ‘আমি সাত বছর ধরে বাপার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছি। এ সময়ে শুধু পাইলটদের অধিকার রক্ষা করিনি বরং বিমানের ভেতরে চলা নানান অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বরাবরই সোচ্চার ছিলাম। আমার এই সাহসিকতা ও প্রতিবাদী ভূমিকার কারণে তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকারের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিলাম। পুনর্বহালের প্রত্যাশা ও সমাধানের পথ নিয়ে ক্যাপ্টেন মাহবুব বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে কাজে পুনর্বহাল এবং বকেয়া বেতন পরিশোধ করে কেবল ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করবে না, বরং প্রশাসনের প্রতি জনসাধারণের আস্থা বাড়াবে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বিমান কর্তৃপক্ষ যদি ক্যাপ্টেন মাহবুবের মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়, তাহলে বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হবে না। এছাড়া তাকে পুনর্বহাল করলে বৈদেশিক পাইলটদের ওপর নির্ভরতা কমবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।

সার্বিক বিষয়ে অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম আমার দেশকে বলেন, লাভজনক করতে হলে বিমানকে রাজনৈতিক ও আমলাতন্ত্রমুক্ত করতে হবে। ৮০-এর দশকজুড়ে বিমান লাভজনক প্রতিষ্ঠান ছিল। তখন এখানে পেশাদার লোক ছিল।

কিন্তু পরবর্তী সময়ে বোর্ডের পরিচালক পদে আমলাদের নেওয়া হয়। ২০০৭-০৮ সালে বিমানকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি করা হলেও কোনো লাভ হয়নি। পরে যখন রাজনৈতিক সরকার আসে, তখন তার প্রভাব পড়ে বিমানে। এককথায় সরকারি প্রভাবমুক্ত করে বাণিজ্যিকভাবে বিমানকে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে।

সংস্কারের বিষয়ে জানতে চাইলে বিমানের জনসংযোগ বিভাগের জেনারেল ম্যানেজার বুশরা ইসলাম আমার দেশকে বলেন, এখন পর্যন্ত সংস্কারের কোনো কথা আমি জানি না। হয়তো ভেতরে ভেতরে করার প্রক্রিয়া চলতেও পারে।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন