দেড় কোটি প্রবাসীর ভোট দেওয়ার স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে

গাজী শাহনেওয়াজ
প্রকাশ : ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১১: ৫৬

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে থাকা দেড় কোটির বেশি প্রবাসী বাংলাদেশির ভোট দেওয়ার স্বপ্ন পূরণের সম্ভাবনা জেগেছে। ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছরের বেশি সময় আগে উপায় বের করতে যাওয়ায় এই সম্ভাবনা জেগেছে। মূলত জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভান্ডারের সঙ্গে ভিপিএন সংযুক্ত থাকা ৭টি দেশকে টার্গেট ধরে প্রবাসীদের ভোটদানের ব্যবস্থা রাখতে সক্রিয় হচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)।

দেশগুলো হচ্ছে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, মালয়েশিয়া, যুক্তরাজ্য ও ইতালি। এর মধ্যে রাজতন্ত্র রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের এমন চারটি দেশ নিয়ে শঙ্কায় রয়েছে ইসি। সব ঠিকঠাক থাকলে ভোটার ভেরিয়েবল প্যাড (ভিভিপ্যাড)-এর সহায়তায় স্বপ্ন পূরণ হবে প্রবাসীদের।

বিজ্ঞাপন

এদিকে, প্রাথমিক তালিকায় থাকা ৭টি দেশের বাইরে আরও ৪০টি দেশকে চিঠি পাঠানোর বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইসি। এ সংক্রান্ত খসড়া চিঠিও প্রস্তুত করা হয়েছে। চলতি সপ্তাহের যেকোনো দিন সংশ্লিষ্ট দেশের বাংলাদেশি মিশনগুলোতে তা পাঠানো হতে পারে।

সেখানে তাদের ভোটার করার প্রক্রিয়া কী; সংশ্লিষ্ট দেশের নীতি-পলিসি কী; অন্য কোনো দেশ তাদের নাগরিকদের ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তকরণ কীভাবে করেছেন কিংবা করেন; বসবাসকারী দেশের আইন ও নীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিকতা রয়েছে কি না এবং ভোটদানের ক্ষেত্রে কী ধরনের প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ভোটাধিকার প্রয়োগের সুযোগ রাখেন এসব নানা জটিলতার বিষয়টি তুলে ধরে পত্র পাঠাতে যাচ্ছে।

উল্লেখযোগ্য দেশগুলোর মধ্যে সৌদি আরবে ৪০ লাখ ৪৯ হাজার ৫৮৮ জন, সংযুক্ত আরক আমিরাতে ২০ লাখ ৭১ হাজার ৫৪৫ জন, অস্ট্রেলিয়ায় ৪০ হাজার, ওমানে ১৫ লাখ ৮৭০ জন, সিঙ্গাপুরে সাত লাখ ৮২ হাজার ৬৫৭ জন, কানাডায় তিন লাখ ৫৪ হাজার ৫৯৫ জন, নিউজিল্যান্ড, জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ৮০ হাজার, যুক্তরাজ্যে ১০ হাজার ১০৭ জন, ফ্রান্সে ১২ হাজার, জার্মানিতে ২০ হাজার ও দক্ষিণ অফ্রিকায় ১০ হাজার। স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি)-এর হিসাবে ৪০টি দেশে অবস্থানরত প্রবাসীর সংখ্যা এক কোটি ৪০ লাখ ৪৬ হাজার ৫৩৪ জন।

পরীক্ষামূলক প্রকল্প হিসেবে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন থেকে ভোটদানের ব্যবস্থা করবে ইসি। এই প্রক্রিয়ায় অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে আগামীতে অন্যান্য দেশে কার্যক্রম প্রসারিত করা হবে। দেশে সাধারণ নির্বাচনে ছয় থেকে সাত লাখ লোক যুক্ত থাকেন। প্রবাসীদের আদলে তারাও যাতে কর্মস্থলে থেকে ভোট দিতে পারেন সে চিন্তাও করছে কমিশন।

প্রথাগত পোস্টাল ব্যালট সিস্টেম, না ইলেকট্রনিক ভোটিং পদ্ধতি (ই-ভোটিং) কোন পথে এগোলে উদ্যোগটির সফলতা আসবে তা নিয়ে বিশ্লেষণে নেমেছে ইসি। সূত্রগুলো জানিয়েছে, ই-ভোটিংয়ের বিষয়ে আগ্রহ থেকে তারা এ চিন্তা নিয়ে এগোচ্ছে। ধারণা পাওয়া গেছে, পদ্ধতি নির্ধারণের কিছু উপায় বের করেছেন তারা। ই-ভোটিংকে সেখানে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে।

এগুলোর মধ্যে রয়েছে ভোটদানের স্থান দূতাবাস নাকি অন্য কোথাও, ভোটদানে ইচ্ছুকদের প্রি-নিবন্ধন লাগবে কি না, দেশের নাম চিহ্নিত করা, ই-ভোটিং না পোস্টাল তা নির্ধারণ, বুথ, স্বচ্ছ ব্যালট বাক্স ও ভোটগ্রহণ কর্মকর্তা নিয়োগ এবং অনলাইনে ভোট হলে সুরক্ষার ব্যবস্থা।

প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটি চলমান রয়েছে। বাংলাদেশি অধ্যুষিত ওই সাতটি দেশে এই কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়। সেখানে অবস্থানরত ১০ হাজার ১০৬ জন জাতীয় পরিচয়পত্র নম্বর পেয়েছেন। এই প্রক্রিয়ার কারণে প্রবাসীদের ভোট প্রদানের বিষয়টিতে একধাপ এগিয়ে রয়েছে ইসি।

এদিকে দেশে ছয় থেকে সাত লাখ লোক নির্বাচনের কাজে যুক্ত থাকেন। প্রবাসীদের আদলে তাদেরও ভোটদানের বিষয়টি চিন্তা-ভাবনা করছে কমিশন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিথ্যা মিথ তৈরি করে এতদিন তাদের আশায় রেখে শেষ মুহূর্তে পারছি না, এমন অজুহাতে প্রবাসীদের ভোটদান থেকে বঞ্চিত রেখেছিল বিগত কমিশনগুলো।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশে (আরপিও) পোস্টাল ব্যালটে ভোটদানের বিধান থাকায় নামকাওয়াস্তে দায়সারা উদ্যোগ নিলেও সেটা বাস্তবায়নের জন্য থাকত না চেষ্টা। এ নিয়ে প্রবাসীদের ক্ষোভ-অসন্তোষ বহুদিনের। অথচ এই প্রবাসী যোদ্ধাদের ঘামে ঝরানো শ্রমের বিনিময়ে উপার্জিত অর্থের (রেমিট্যান্স) পুরোটা দেশে পাঠিয়ে অর্থনীতির চাকাকে রেখেছেন সচল। অনেক এমপি-মন্ত্রী তাদের টাকায় বিলাসী জীবনযাপন করেন।

অথচ প্রতিটি সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর কমিশন থেকে খোঁড়া অজুহাত দাঁড় করিয়ে বলা হতো, ৩০০ আসনে ভোট হয় একদিনে, ফলাফলও তাৎক্ষণিক ঘোষণা হয়ে যায়। এর পরই নতুন সরকার শপথ নেন। ফলে ওই ভোটের আর কোনো গুরুত্ব থাকে না। ইসির এমন নেতিবাচক ধারণার কারণে ভোটাধিকার বঞ্চিত প্রবাসীরা।

এদিকে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পরিবর্তিত বাংলাদেশে নবগঠিত সরকার ও কমিশন উভয়ই প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রদানের বিষয়ে সূর অভিন্ন থাকায় সম্ভাবনার মাত্রা বহুগুণ বেড়েছে। নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লার সম্মতি নিয়ে এনআইডি উইং এ সংক্রান্ত খসড়া প্রস্তাবনা তৈরির কাজ শুরু করেছে। ওই প্রস্তাবনায় ই-ভোটিংয়ের ইস্যুটিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। তবে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

ইসি সূত্র বলছে, বিশ্বের শতাধিক দেশে কম-বেশি বাংলাদেশি রয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, যুক্তরাজ্য, ইতালি ও মালয়েশিয়ায়। ই-ভোর্টিংয়ে ভোট নেওয়ার ক্ষেত্রে এসব দেশকে বেছে নিয়েছে কমিশন। ত্রয়োদশ সংসদে পাইলটিং প্রকল্পের অংশ হিসেবে ভোটদান প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই দেশগুলো এনআইডির ভোটার তথ্যভান্ডারের সঙ্গে ভিপিএন সংযোগ যুক্ত রয়েছে।

সবচেয়ে বড় সমস্যা মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। এসব দেশে রাজতন্ত্র থাকায় ভোটাধিকার নেই। সেখানে প্রবাসীদের চাকরি সুরক্ষা করে কাজটি সম্পন্ন করার পক্ষে কমিশন। ভোটার ভেরিফায়েড প্যাড (ভিভিপ্যাড) পদ্ধতি রাখতে চায়।

এদিকে, সম্প্রতি বিভিন্ন দেশে বসবাস করা দেড় কোটি বাংলাদেশি নাগরিকের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে গ্লোবাল বাংলাদেশিজ অ্যালায়েন্স ফর হিউম্যান রাইটস (জিবিএএইচআর)। তাদের ভোটিং পদ্ধতির নাম সিকিউর অনলাইন ভোটিং মেথড (এসওভিএম)। অনলাইন ভোটিং পদ্ধতির মাধ্যমে এটি করা সম্ভব।

সংস্থাটি বলেছে, দেড় কোটি প্রবাসীকে ভোটাধিকার বঞ্চিত করে একটি দেশ এগুতে পারে না। তাই দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার প্রদানের ব্যবস্থা করতে হবে। এর পর কমিশন আরও সক্রিয়ভাবে এ কাজে নেমেছে।

এনআইডি উইংয়ের ডিজি এএসএম হুমায়ুন কবীর আমার দেশকে বলেন, প্রবাসীদের অনেক প্রত্যাশার মধ্যে একটি হলো ভোটাধিকার। দুর্ভাগ্যক্রমে আমরা এই কাজগুলো করতে পারিনি। এখন পরিবেশ অনুকূলে, সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করব। ইতোমধ্যে প্রধান উপদেষ্টা ইচ্ছা পোষণ করেছেন। আমরা সম্ভাব্য উপায়গুলো নিয়ে কাজ করছি।

প্রবাসীদের ভোটদানের বিষয়ে জানতে চাইলে এনআইডির উপ-পরিচালক আবদুল মমিন সরকার আমার দেশকে বলেন, কমিশন থেকে নির্দেশনা পেয়ে আমরা একটা প্রস্তাব তৈরি করছি। সেখানে অনেকগুলো সম্ভাব্য উপায় নিয়ে ভাবা হচ্ছে। বিশেষ করে রাজতন্ত্র রয়েছে এমন দেশগুলোতে সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। ভোটিং পদ্ধতির সুরক্ষা ব্যবস্থা থাকবে, যেমন কেউ ই-ভোটিংয়ে ভোট দিলে তার একটি প্রিন্টকপি সুরক্ষিত বক্সে সংরক্ষণ করা হবে।

প্রবাসীদের ভোটার নিবন্ধন

ভোটার হওয়ার জন্য সাতটি দেশের ৩৭ হাজার ৩১৯ জন আবেদন করেন। এদের মধ্যে বাংলাদেশ মিশনে উপস্থিত হয়ে বায়োমেট্রিক দেন ২৫ হাজার ৩০৯ জন। তাদের মধ্যে তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে ১৫ হাজার ৫০২ জনের। তথ্য সঠিক না দেওয়ায় আবেদন বাতিল হয়েছে ৩ হাজার ১৯৬ জনের, উপজেলা পর্যায়ে তদন্তাধীন ১৮ হাজার ৬৯৮ জনের, তথ্যসার্ভারে আপলোড ১৩ হাজার ৩০২ জনের এবং চূড়ান্ত প্রক্রিয়াসহ প্রিন্ট হয়েছে ১০ হাজার ১০৬টি।

সবচেয়ে বেশি আবেদন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। সেখানে আবেদন করেন ১৭ হাজার ৬০৪ জন, সৌদি আরবে দুই হাজার ৪৪৮ জন, যুক্তরাজ্যে ছয় হাজার ৭৩৩ জন, ইতালিতে পাঁচ হাজার ৩৭১ জন, কুয়েতে তিন হাজার ৪৫ জন, কাতারে দুই হাজার ১১৮ জন ও মালয়েশিয়ায় ৬৬৯ জন।

এসব দেশের নাগরিকরা ইসির উদ্যোগ সফল হলে ই-ভোটিংয়ে ভোট দেওয়ার সুযোগ পাবেন। প্রাথমিক অবস্থায় পাইলটিং পদ্ধতিতে শুরু করলেও এর সফলতার আলোকে ধাপে ধাপে অন্যান্য দেশকে এনআইডি সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত করে ক্ষেত্র বাড়ানো হবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত