দেড় হাজার কোটি টাকার কাজ ফেলে উধাও শতাধিক ঠিকাদার

ইমদাদ হোসাইন
প্রকাশ : ৩০ জুলাই ২০২৫, ০৯: ৪৫

সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থ তোলার পর কাজ না করে পালিয়ে গেছেন শতাধিক দেশি-বিদেশি ঠিকাদার। এতে স্থবির হয়ে পড়েছে চারটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের অন্তত ৬০টি প্রকল্প। প্রকল্পগুলোর বরাদ্দের টাকাও ব্যবহৃত হয়নি কাঙ্ক্ষিত কাজে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো বলছে, এ অনিয়মে অন্তত দেড় হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে রাষ্ট্রের।

সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ‘তিস্তা সেচ প্রকল্পে’ ৮০০ কোটি টাকার কাজ ফেলে পালিয়েছেন ১৬ ঠিকাদার। প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছিল রংপুর, নীলফামারী, গাইবান্ধা, দিনাজপুর, জয়পুরহাট ও বগুড়ার কৃষিজমিতে সেচ সুবিধা নিশ্চিত করতে। তিনটি সেক্টরে ভাগ করা এ প্রকল্পের একটি অংশ পুরোপুরি থমকে আছে ঠিকাদারদের অনুপস্থিতিতে। বাকি দুই সেক্টরের কার্যক্রম চলমান থাকলেও সামগ্রিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

একই রকম অচলাবস্থায় পড়েছে ‘আশুগঞ্জ থেকে আখাউড়া পর্যন্ত চার লেন মহাসড়ক নির্মাণ প্রকল্প’। ভারতীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এফকনস ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে ছিল। কিন্তু তারা দেশে ফিরে যাওয়ায় পাঁচ হাজার ৭৯১ কোটি টাকার এ প্রকল্পের কাজ এক বছর ধরে সম্পূর্ণ বন্ধ আছে।

এ দুটি প্রকল্প ছাড়াও স্থানীয় সরকার, গৃহায়ন ও গণপূর্ত, সড়ক ও জনপথ এবং রেলপথ—এ চার মন্ত্রণালয়ের অধীন আরো অন্তত ৬০টি প্রকল্পে একই ধরনের অনিয়ম পাওয়া গেছে। কাজ শুরু না করেই অনেক ঠিকাদার কোটি কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের ১০টি প্রকল্পে ৩৩০ কোটি টাকা, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের ১৪টি প্রকল্পে ৩২৯ কোটি ২৩ লাখ টাকা, সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকল্পে ৬৭১ কোটি ৫২ লাখ টাকা এবং রেলপথ বিভাগের প্রকল্পে ১৬১ কোটি ২১ লাখ টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। ঠিকাদাররা এসব প্রকল্পের কোনো কাজ সম্পন্ন না করেই নিরুদ্দেশ হয়ে গেছেন।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগে এসব অপেশাদার ও প্রভাবশালী ঠিকাদার প্রকল্প এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। এর মধ্যে অনেকেই আগের সরকারের ঘনিষ্ঠ বলে জানা গেছে। বিদেশি ঠিকাদারদের মধ্যে ভারতের প্রতিষ্ঠানগুলোর পালিয়ে যাওয়ার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। অন্যদিকে দেশি ঠিকাদারদের মধ্যে আওয়ামীপন্থি ব্যবসায়ীদের প্রভাবই বেশি ছিল এসব প্রকল্পে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, সাবেক সরকার প্রকল্প বাস্তবায়নে পেশাদারদের বাদ দিয়ে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টদের অগ্রাধিকার দিয়েছিল। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, বিগত সরকার অনেক অপেশাদার ব্যক্তির হাতে প্রকল্প তুলে দিয়েছে। দেখা গেছে, তারা প্রকল্প গ্রহণ করে পরে তা অর্থের বিনিময়ে অন্যের কাছে বিক্রি করেছে।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, অনেক প্রকল্পের ঠিকাদারই খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি থেমে গেছে।

স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন অনুবিভাগের মহাপরিচালক মাহমুদুল হাসান জানান, শুরুতে ঠিকাদারদের পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে কিছু ফিরলেও অনেকে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত। যাদের একেবারেই পাওয়া যাচ্ছে না, তাদের বাদ দিয়ে নতুন করে টেন্ডার দেওয়া হয়েছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) জানায়, এ অনিয়ম শুধু চার মন্ত্রণালয়েই সীমাবদ্ধ নয়। শেখ হাসিনা সরকারের সময় হাতেগোনা কয়েকজন ঠিকাদার প্রায় সব মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প দখলে নিয়েছিলেন। বিশেষ করে সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রায় সব বড় প্রকল্প যায় চার-পাঁচটি প্রতিষ্ঠানের হাতে। একই দৃশ্য স্থানীয় সরকার, রেলপথ এবং আইসিটি মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পেও দেখা গেছে। আইএমইডির কর্মকর্তারা জানান, অনেক রাজনৈতিক পরিচয়ধারী ব্যক্তি ঠিকাদার প্রকল্প বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন। তারা একাধিক প্রকল্প হাতে নেন, আবার ওই প্রকল্প অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করে দেন।

বর্তমানে দেশে প্রায় দুই লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার সরকারি প্রকল্প চলমান। এর মধ্যে অন্তত ১০টি মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পে অনিয়ম ধরা পড়েছে। তবে চারটি মন্ত্রণালয়ের ৬০টির বেশি প্রকল্পে কাজ না করেই প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন ঠিকাদাররা। তাদের অনুপস্থিতিতে এসব প্রকল্প কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। একদিকে সরকারের বিপুল অর্থ অপচয় হচ্ছে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষ প্রকল্পের সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

এ পরিস্থিতিতে বিষয়টিকে গুরুত্বসহকারে নিয়েছে সরকার। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের শুরু থেকে যাতে বন্ধ হওয়া প্রকল্পগুলোর কাজ শুরু করা যায়, সেজন্য উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় দেশের ৫৮টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে চিঠি দিয়েছে। এতে আগামী ১০ কার্যদিবসের মধ্যে পালিয়ে যাওয়া ঠিকাদার ও প্রকল্প পরিচালকদের তথ্য পাঠাতে বলা হয়েছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের আইএমইডি সচিব মো. কামাল উদ্দিন আমার দেশকে বলেন, নিয়মিত পরিদর্শনের অংশ হিসেবে এসব অনিয়ম ধরা পড়েছে। চারটি মন্ত্রণালয়ের বেশকিছু প্রকল্পে ঠিকাদারদের কাজ ফেলে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। বাকি প্রকল্পগুলোর তথ্য সংগ্রহ করে দ্রুত মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।

পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ গত রোববার একনেক সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে বলেন, প্রধান উপদেষ্টা প্রতিটি প্রকল্প নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন। সে নির্দেশ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই দেশজুড়ে কতগুলো প্রকল্পে এখন ঠিকাদার নেই, তার একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র সংগ্রহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

তবে বিশ্লেষকরা মনে করছেন, যতক্ষণ পর্যন্ত টেন্ডারব্যবস্থায় স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং পেশাদারিত্ব নিশ্চিত না করা হবে, ততদিন এ ধরনের অনিয়ম ও অর্থ অপচয় বন্ধ হবে না। নতুন করে টেন্ডার ডাকার পর প্রকল্পগুলোর কাজ কখন শুরু হবে এবং কবে শেষ হবে, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত