রাজধানীর খিলগাঁও থানা
আবু সুফিয়ান
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের তালিকায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) এক পরিদর্শকের নাম রয়েছে, যিনি ১৯ জুলাই বনশ্রী এলাকায় নিহত হয়েছিলেন। সরকারি গেজেটে এই পুলিশ সদস্যের নাম অন্তর্ভুক্ত করার দীর্ঘদিন পর তার পেশাগত পরিচয় প্রকাশ হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গেজেটে নাম ঢুকানোর আগেই নিহত পুলিশ সদস্যের স্ত্রী জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া সহস্রাধিক ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে রাজধানীর খিলগাঁও থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
মামলাটিতে ‘পুলিশ হত্যা’র জন্য বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের ‘দুষ্কৃতকারী’ এবং তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের অভিযোগও করা হয়েছে ওই মামলায়। মামলাটিতে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরসহ আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ‘পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যা’র অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলাটির অনুলিপি আমার দেশের হাতে এসেছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে রাজধানীর রামপুরায় আন্দোলনকারীদের দমন করতে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে অনেক ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে। জনতাও গড়ে তুলেছিল পাহাড়সহ প্রতিরোধ। সে সময়ই ক্রুদ্ধ জনতার প্রতিরোধে নিহত হয়েছিলেন এ পুলিশ সদস্য। যদিও তখন তিনি ছুটিতে ছিলেন বলে জানিয়েছে পরিবারের সদস্যরা।
আইনজ্ঞরা বলছেন, এই মামলাটি ভবিষ্যতে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে।
প্রথমে মামলা, পরে গেজেটে অন্তর্ভুক্তি
জুলাই গণঅভ্যুত্থান ২০২৪-এ শহীদদের তালিকা গত ১৫ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেট অধিশাখা এক প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করে। উপসচিব (গেজেট) হরিদাশ ঠাকুর স্বাক্ষরিত সেই গেজেটে ৮৩৪ জন শহীদের তালিকা প্রকাশ করা হয়। ওই গেজেটে ‘মেডিকেল কেস আইডি’, শহীদদের নাম, বাবার নাম, বর্তমান ঠিকানা, স্থায়ী ঠিকানা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে কে কোথায় এবং কোন তারিখে শহীদ হন, তা গেজেটে উল্লেখ করা হয়নি।
সেই তালিকার ৪৫৬ নম্বরে রয়েছে মাসুদ পারভেজ ভূঁইয়ার (বিপি ৭৩৯৮০০৯৯৩২) নাম। কেস আইডি নম্বর- ২২৫১৩। বাবার নাম মৃত আব্দুল জব্বার ভুঁইয়া। গেজেটে তার বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা উল্লেখ করা হয়েছে।
গেজেটে নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অনেক আগেই নিহতের স্ত্রী মেরিনা আক্তার বিনা ২০২৪ সালের ২৩ জুলাই খিলগাঁও থানায় মামলা করেন (নম্বর ৪২) করেন। মামলায় বলা হয়, ‘… আমার স্বামী বাংলাদেশ পুলিশের পিবিআই নারায়ণগঞ্জ জেলায় পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গত ১৯/০৭/২০২৪ খিলগাঁও থানাধীন রামপুরা বনশ্রীর মেইন রোডে জরুরি ওষুধ আনতে যান।
তখন কোটাবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিএনপি-জামায়াত-শিবির ও তাদের সহযোগী অঙ্গ সংগঠনের অজ্ঞাতনামা ১০০০-১২০০ জন দুর্বৃত্তসহ আন্দোলনরত দুষ্কৃতকারীরা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঘটানোর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালায়। …বিএনপি, জামায়াত-শিবির ও তাদের সহযোগী সংগঠনের অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তসহ আন্দোলনরত দুষ্কৃতকারীদের নাশকতার সময় হত্যার উদ্দেশ্যে পূর্বপরিকল্পিতভাবে আমার স্বামীকে পুলিশ জেনে দেশীয় ধারালো অস্ত্র, লোহার রড এবং এসএস পাইপ দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে…। ’
এ বিষয়ে নিহতের শ্যালক সাব্বির আহমেদ আমার দেশকে বলেন, ‘আমার ভগ্নীপতি নিহত হওয়ার ঘটনায় আমার বোন (নিহতের স্ত্রী) খিলগাঁও থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় ১০০০-১২০০ জনকে আসামি করা হয়।’ তিনি বলেন, ‘আমার দুলাভাই মাসুদ পারভেজ ভূঁইয়া পিবিআইয়ের ইন্সপেক্টর ছিলেন। ওনার পোস্টিং ছিল নারায়ণগঞ্জে। ঘটনার সময় তিনি ছুটিতে ছিলেন। বনশ্রী এলাকায় তিনি জনতার পিটুনিতে নিহত হন। বনশ্রী মেইন রোডে অবস্থিত ফরাজী হাসপাতালের সামনে তার লাশ পাওয়া যায়।’
ঘটনার সঙ্গে জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের অভিযুক্ত করে তিনি বলেন, ‘আন্দোলনকারীরা আমার দুলাভাইকে হত্যা করেছে। পিবিআইয়ের কাছে সব ডকুমেন্ট আছে। সিসিটিভি ফুটেজ সব আছে।’
মামলা অপপ্রয়োগের আশঙ্কা
জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সারাদেশে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে শত শত নারী-পুরুষ-শিশু নিহত হয়। সরকারি গেজেটে শহীদের তালিকায় সেই সব মানুষের নামের পাশাপাশি পুলিশের নাম থাকায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন আইনজীবীরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শেখ ওমর আমার দেশকে বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত বছরের (২০২৪) অক্টোবরেই বিবৃতি দিয়ে নিশ্চিত করেছিল যে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত জুলাই গণঅভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট ঘটনার জন্য কোনো মামলা, গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা হবে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই বিবৃতির পরও আন্দোলনে পুলিশ হত্যার ঘটনায় এ ধরনের ফৌজদারি মামলা চলমান থাকা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।’
আইনজীবী শেখ ওমর আরো বলেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে স্বৈরাচারের দালাল চক্র যে এখনো সক্রিয়, সেটা এই মামলার ঘটনায় আবারও স্পষ্ট হলো। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দ্রুত এই মামলা প্রত্যাহার করতে হবে এবং এই ধরনের আরো কোনো মামলা আছে কি না, সে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে।’
গেজেটে প্রকাশিত শহীদ সদস্যদের পরিবারের বর্তমান অবস্থা নিয়ে গবেষণা করা ‘জুলাই স্মৃতি সংরক্ষণ’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আহ্বায়ক নাহিদ হাসান আমার দেশকে বলেন, ‘এটি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, তার নাম ইচ্ছাকৃতভাবে তালিকায় রাখা হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে আন্দোলনকারীদের ওপর মামলা চাপানো যায়। বিষয়টি নিয়ে তদন্তে জানা যায়, এই নামটি ভুলবশত নয়, বরং পরিকল্পিতভাবে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে অনেকে সন্দেহ করছেন।’
নাম বাতিলের আবেদন আন্দোলকারীদের
গেজেটে শহীদের তালিকায় পুলিশের নাম বাতিলের জন্য গত ১৮ জানুয়ারি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে একটি চিঠি দিয়েছিলেন স্থানীয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী সাকিবুজ্জামান। সম্প্রতি তিনি আমার দেশকে বলেন, ‘স্থানীয় প্রশাসন প্রাথমিকভাবে ঈশ্বরগঞ্জে শহীদদের যে তালিকা করেছিল, তার এক নম্বরে ছিল এই পুলিশ সদস্যের নাম। পরে জেলা প্রশাসক মফিজুল আলম নামফলক উদ্বোধন করেন। আমরা স্থানীয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে এর প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। পরে স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতিবাদের পর তা স্কচটেপ দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়।’
সাকিবুজ্জামান আরো বলেন, ‘আমরা গেজেট থেকে এই নাম বাতিল করার জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর প্রথমে একটা আবেদন করেছিলাম। পরে সেই কার্যালয় থেকে আমাদের জানানো হয়, সেই আবেদনের কপি হারিয়ে গেছে। পরবর্তী সময়ে আমরা আবার আবেদন করি। কিন্তু এর কোনো অগ্রগতি নেই।’
তিনি বলেন, ‘ঈশ্বরগঞ্জে আন্দোলনে নিহত শহীদ শেখ শাহরিয়ার বিন মতিনের (তালিকায় ৭৬১ নম্বর) বাবা মোহাম্মদ আব্দুল মতিন গেজেট থেকে সেই পুলিশ সদস্যের নাম বাতিল করতে ঢাকায় আবেদন করেছেন।’
এ বিষয়ে জুলাই গণহত্যায় শহীদ হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে প্রতিষ্ঠিত সংস্থা জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে জানান, ‘লিখিত আকারে এই অভিযোগটা অনেকদিন আগে পেয়েছি আমরা। তবে অজানা কোনো এক চাপের কারণে আমরা কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারিনি এখনো।’
২০২৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সমাজসেবা অধিদপ্তর সংস্থাটির কার্যকরি পরিষদের অনুমোদন দেয়। সংস্থাটির লক্ষ্য জুলাই গণহত্যায় শহীদ ও আহতদের পরিবারকে অবিলম্বে স্বাস্থ্যসেবা, আর্থিক সহায়তা ও দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা দেওয়া।
শহীদের তালিকায় পুলিশ সদস্যের নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়ে হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ, অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত ও শহীদবিষয়ক সেল সম্পাদক হাসান এনামের কাছে জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু তারা কেউ সেটির জবাব দেননি।
মামলার বর্তমান অবস্থা
পুলিশ ইন্সপেক্টর নিহতের ঘটনায় মামলাকালে খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছিলেন সালাহউদ্দীন মিয়া। তিনি মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছিলেন সাব-ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) সৈয়দ রুহুল আমিনকে। হাসিনার পতন ও পলায়নের পর খিলগাঁও থানার নতুন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে যোগ দেন দাউদ হোসেন। সম্প্রতি তিনি আমার দেশকে বলেন, ‘সেই মামলাটি পিবিআইকে হস্তান্তর করা হয়েছে। এটা তারা তদন্ত করছে।’
এ বিষয়ে মামলাটির তদন্তে যুক্ত পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হান্নানকে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। বার্তা পাঠানো হলেও কোনো জবাব দেননি।
উল্লেখ্য, সরকারের গণঅভ্যুত্থানসংক্রান্ত বিশেষ সেল ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ‘শহীদ’ ও আহতদের প্রথম ধাপের খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছিল ২০২৪ সালের ২১ ডিসেম্বর। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর জুলাই-আগস্টে নিহত এবং আহতদের তালিকা তৈরি করতে গত ১৫ আগস্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে। যাচাই-বাছাই শেষে ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ সালে শহীদদের নাম প্রকাশ করে প্রথম গেজেট প্রকাশ হয়।
জুলাই গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০২৪ সালের ১৯ আগস্ট পলাতক শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তিনটি ‘গণহত্যা’ মামলার তদন্ত শুরু করে, যার মধ্যে অভ্যুত্থানের সময় ৪৫০ বিক্ষোভকারী হত্যার অভিযোগ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে শহীদদের তালিকায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) এক পরিদর্শকের নাম রয়েছে, যিনি ১৯ জুলাই বনশ্রী এলাকায় নিহত হয়েছিলেন। সরকারি গেজেটে এই পুলিশ সদস্যের নাম অন্তর্ভুক্ত করার দীর্ঘদিন পর তার পেশাগত পরিচয় প্রকাশ হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, গেজেটে নাম ঢুকানোর আগেই নিহত পুলিশ সদস্যের স্ত্রী জুলাই আন্দোলনে অংশ নেওয়া সহস্রাধিক ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে রাজধানীর খিলগাঁও থানায় একটি হত্যা মামলা করেন।
মামলাটিতে ‘পুলিশ হত্যা’র জন্য বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্রশিবিরকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকারীদের ‘দুষ্কৃতকারী’ এবং তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের অভিযোগও করা হয়েছে ওই মামলায়। মামলাটিতে বিএনপি-জামায়াত-শিবিরসহ আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ‘পূর্বপরিকল্পিতভাবে হত্যা’র অভিযোগ আনা হয়েছে। মামলাটির অনুলিপি আমার দেশের হাতে এসেছে।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে রাজধানীর রামপুরায় আন্দোলনকারীদের দমন করতে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালিয়ে অনেক ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে। জনতাও গড়ে তুলেছিল পাহাড়সহ প্রতিরোধ। সে সময়ই ক্রুদ্ধ জনতার প্রতিরোধে নিহত হয়েছিলেন এ পুলিশ সদস্য। যদিও তখন তিনি ছুটিতে ছিলেন বলে জানিয়েছে পরিবারের সদস্যরা।
আইনজ্ঞরা বলছেন, এই মামলাটি ভবিষ্যতে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবহারের আশঙ্কা রয়েছে।
প্রথমে মামলা, পরে গেজেটে অন্তর্ভুক্তি
জুলাই গণঅভ্যুত্থান ২০২৪-এ শহীদদের তালিকা গত ১৫ জানুয়ারি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেট অধিশাখা এক প্রজ্ঞাপন আকারে প্রকাশ করে। উপসচিব (গেজেট) হরিদাশ ঠাকুর স্বাক্ষরিত সেই গেজেটে ৮৩৪ জন শহীদের তালিকা প্রকাশ করা হয়। ওই গেজেটে ‘মেডিকেল কেস আইডি’, শহীদদের নাম, বাবার নাম, বর্তমান ঠিকানা, স্থায়ী ঠিকানা অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে কে কোথায় এবং কোন তারিখে শহীদ হন, তা গেজেটে উল্লেখ করা হয়নি।
সেই তালিকার ৪৫৬ নম্বরে রয়েছে মাসুদ পারভেজ ভূঁইয়ার (বিপি ৭৩৯৮০০৯৯৩২) নাম। কেস আইডি নম্বর- ২২৫১৩। বাবার নাম মৃত আব্দুল জব্বার ভুঁইয়া। গেজেটে তার বর্তমান ও স্থায়ী ঠিকানা ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা উল্লেখ করা হয়েছে।
গেজেটে নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার অনেক আগেই নিহতের স্ত্রী মেরিনা আক্তার বিনা ২০২৪ সালের ২৩ জুলাই খিলগাঁও থানায় মামলা করেন (নম্বর ৪২) করেন। মামলায় বলা হয়, ‘… আমার স্বামী বাংলাদেশ পুলিশের পিবিআই নারায়ণগঞ্জ জেলায় পুলিশ পরিদর্শক (নিরস্ত্র) হিসেবে কর্মরত ছিলেন। গত ১৯/০৭/২০২৪ খিলগাঁও থানাধীন রামপুরা বনশ্রীর মেইন রোডে জরুরি ওষুধ আনতে যান।
তখন কোটাবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে বিএনপি-জামায়াত-শিবির ও তাদের সহযোগী অঙ্গ সংগঠনের অজ্ঞাতনামা ১০০০-১২০০ জন দুর্বৃত্তসহ আন্দোলনরত দুষ্কৃতকারীরা নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঘটানোর উদ্দেশ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুর চালায়। …বিএনপি, জামায়াত-শিবির ও তাদের সহযোগী সংগঠনের অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তসহ আন্দোলনরত দুষ্কৃতকারীদের নাশকতার সময় হত্যার উদ্দেশ্যে পূর্বপরিকল্পিতভাবে আমার স্বামীকে পুলিশ জেনে দেশীয় ধারালো অস্ত্র, লোহার রড এবং এসএস পাইপ দিয়ে আঘাত করে হত্যা করে…। ’
এ বিষয়ে নিহতের শ্যালক সাব্বির আহমেদ আমার দেশকে বলেন, ‘আমার ভগ্নীপতি নিহত হওয়ার ঘটনায় আমার বোন (নিহতের স্ত্রী) খিলগাঁও থানায় মামলা দায়ের করেন। মামলায় ১০০০-১২০০ জনকে আসামি করা হয়।’ তিনি বলেন, ‘আমার দুলাভাই মাসুদ পারভেজ ভূঁইয়া পিবিআইয়ের ইন্সপেক্টর ছিলেন। ওনার পোস্টিং ছিল নারায়ণগঞ্জে। ঘটনার সময় তিনি ছুটিতে ছিলেন। বনশ্রী এলাকায় তিনি জনতার পিটুনিতে নিহত হন। বনশ্রী মেইন রোডে অবস্থিত ফরাজী হাসপাতালের সামনে তার লাশ পাওয়া যায়।’
ঘটনার সঙ্গে জুলাই অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের অভিযুক্ত করে তিনি বলেন, ‘আন্দোলনকারীরা আমার দুলাভাইকে হত্যা করেছে। পিবিআইয়ের কাছে সব ডকুমেন্ট আছে। সিসিটিভি ফুটেজ সব আছে।’
মামলা অপপ্রয়োগের আশঙ্কা
জুলাই অভ্যুত্থানের সময় সারাদেশে পুলিশের নির্বিচার গুলিতে শত শত নারী-পুরুষ-শিশু নিহত হয়। সরকারি গেজেটে শহীদের তালিকায় সেই সব মানুষের নামের পাশাপাশি পুলিশের নাম থাকায় বিস্ময় প্রকাশ করেছেন আইনজীবীরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শেখ ওমর আমার দেশকে বলেন, ‘স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত বছরের (২০২৪) অক্টোবরেই বিবৃতি দিয়ে নিশ্চিত করেছিল যে, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে ১৫ জুলাই থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত জুলাই গণঅভ্যুত্থান সংশ্লিষ্ট ঘটনার জন্য কোনো মামলা, গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা হবে না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই বিবৃতির পরও আন্দোলনে পুলিশ হত্যার ঘটনায় এ ধরনের ফৌজদারি মামলা চলমান থাকা অত্যন্ত উদ্বেগজনক।’
আইনজীবী শেখ ওমর আরো বলেন, ‘ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে অর্জিত অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে স্বৈরাচারের দালাল চক্র যে এখনো সক্রিয়, সেটা এই মামলার ঘটনায় আবারও স্পষ্ট হলো। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে দ্রুত এই মামলা প্রত্যাহার করতে হবে এবং এই ধরনের আরো কোনো মামলা আছে কি না, সে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে।’
গেজেটে প্রকাশিত শহীদ সদস্যদের পরিবারের বর্তমান অবস্থা নিয়ে গবেষণা করা ‘জুলাই স্মৃতি সংরক্ষণ’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের আহ্বায়ক নাহিদ হাসান আমার দেশকে বলেন, ‘এটি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে, তার নাম ইচ্ছাকৃতভাবে তালিকায় রাখা হয়েছে, যাতে ভবিষ্যতে আন্দোলনকারীদের ওপর মামলা চাপানো যায়। বিষয়টি নিয়ে তদন্তে জানা যায়, এই নামটি ভুলবশত নয়, বরং পরিকল্পিতভাবে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে বলে অনেকে সন্দেহ করছেন।’
নাম বাতিলের আবেদন আন্দোলকারীদের
গেজেটে শহীদের তালিকায় পুলিশের নাম বাতিলের জন্য গত ১৮ জানুয়ারি ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসারের কাছে একটি চিঠি দিয়েছিলেন স্থানীয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মী সাকিবুজ্জামান। সম্প্রতি তিনি আমার দেশকে বলেন, ‘স্থানীয় প্রশাসন প্রাথমিকভাবে ঈশ্বরগঞ্জে শহীদদের যে তালিকা করেছিল, তার এক নম্বরে ছিল এই পুলিশ সদস্যের নাম। পরে জেলা প্রশাসক মফিজুল আলম নামফলক উদ্বোধন করেন। আমরা স্থানীয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে এর প্রতিবাদ জানিয়েছিলাম। পরে স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতিবাদের পর তা স্কচটেপ দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়।’
সাকিবুজ্জামান আরো বলেন, ‘আমরা গেজেট থেকে এই নাম বাতিল করার জন্য উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর প্রথমে একটা আবেদন করেছিলাম। পরে সেই কার্যালয় থেকে আমাদের জানানো হয়, সেই আবেদনের কপি হারিয়ে গেছে। পরবর্তী সময়ে আমরা আবার আবেদন করি। কিন্তু এর কোনো অগ্রগতি নেই।’
তিনি বলেন, ‘ঈশ্বরগঞ্জে আন্দোলনে নিহত শহীদ শেখ শাহরিয়ার বিন মতিনের (তালিকায় ৭৬১ নম্বর) বাবা মোহাম্মদ আব্দুল মতিন গেজেট থেকে সেই পুলিশ সদস্যের নাম বাতিল করতে ঢাকায় আবেদন করেছেন।’
এ বিষয়ে জুলাই গণহত্যায় শহীদ হওয়া ব্যক্তিদের স্মরণে প্রতিষ্ঠিত সংস্থা জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের নাম প্রকাশ না করার শর্তে আমার দেশকে জানান, ‘লিখিত আকারে এই অভিযোগটা অনেকদিন আগে পেয়েছি আমরা। তবে অজানা কোনো এক চাপের কারণে আমরা কোনো ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারিনি এখনো।’
২০২৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সমাজসেবা অধিদপ্তর সংস্থাটির কার্যকরি পরিষদের অনুমোদন দেয়। সংস্থাটির লক্ষ্য জুলাই গণহত্যায় শহীদ ও আহতদের পরিবারকে অবিলম্বে স্বাস্থ্যসেবা, আর্থিক সহায়তা ও দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা দেওয়া।
শহীদের তালিকায় পুলিশ সদস্যের নাম অন্তর্ভুক্ত হওয়ার বিষয়ে হোয়াটসঅ্যাপ বার্তায় জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর মাহবুবুর রহমান স্নিগ্ধ, অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত ও শহীদবিষয়ক সেল সম্পাদক হাসান এনামের কাছে জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু তারা কেউ সেটির জবাব দেননি।
মামলার বর্তমান অবস্থা
পুলিশ ইন্সপেক্টর নিহতের ঘটনায় মামলাকালে খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছিলেন সালাহউদ্দীন মিয়া। তিনি মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছিলেন সাব-ইন্সপেক্টর (নিরস্ত্র) সৈয়দ রুহুল আমিনকে। হাসিনার পতন ও পলায়নের পর খিলগাঁও থানার নতুন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) হিসেবে যোগ দেন দাউদ হোসেন। সম্প্রতি তিনি আমার দেশকে বলেন, ‘সেই মামলাটি পিবিআইকে হস্তান্তর করা হয়েছে। এটা তারা তদন্ত করছে।’
এ বিষয়ে মামলাটির তদন্তে যুক্ত পিবিআইয়ের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হান্নানকে ফোন করা হলে তিনি রিসিভ করেননি। বার্তা পাঠানো হলেও কোনো জবাব দেননি।
উল্লেখ্য, সরকারের গণঅভ্যুত্থানসংক্রান্ত বিশেষ সেল ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ‘শহীদ’ ও আহতদের প্রথম ধাপের খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছিল ২০২৪ সালের ২১ ডিসেম্বর। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর জুলাই-আগস্টে নিহত এবং আহতদের তালিকা তৈরি করতে গত ১৫ আগস্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে। যাচাই-বাছাই শেষে ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ সালে শহীদদের নাম প্রকাশ করে প্রথম গেজেট প্রকাশ হয়।
জুলাই গণহত্যার দায়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২০২৪ সালের ১৯ আগস্ট পলাতক শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে তিনটি ‘গণহত্যা’ মামলার তদন্ত শুরু করে, যার মধ্যে অভ্যুত্থানের সময় ৪৫০ বিক্ষোভকারী হত্যার অভিযোগ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে বিভিন্ন মেরূকরণ। এ নির্বাচনে কোন দল ক্ষমতায় আসবে, কোন দল কার সঙ্গে সমঝোতা বা জোট করে ভোট করবেÑএসব বিষয় নিয়ে আলোচনা ও তৎপরতাও জোরদার হচ্ছে। বিশেষ করে ইসলামি দলগুলোকে নিয়ে সাধারণ ভোটারদের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট মহলে বিশেষ আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
১২ ঘণ্টা আগেনীলের দেশখ্যাত নীলফামারী দীর্ঘদিন শোষণ করেছিল ইংরেজরা। তাদের স্থানীয় নিপীড়ক নীলকরদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিলেন উত্তরের এই জেলার চাষিরা। ২০০ বছর পর সেই নিষ্ঠুর ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি করেন আওয়ামী ‘কসাই’খ্যাত আসাদুজ্জামান নূর।
১৬ ঘণ্টা আগেআগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পরিচালনায় জেলা প্রশাসকদেরই (ডিসি) রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ হিসেবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন এলাকার দুজন বিভাগীয় কমিশনার এবং ৬৪ জন ডিসিসহ ৬৬ জন রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হবে।
২ দিন আগেবছরের প্রায় ১০ মাস পার হলেও মাধ্যমিক স্তরের বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ শুরু হয়নি। এমনকি পাঠ্যবইয়ের কনটেন্টও পুরোপুরি প্রস্তুত হয়নি; এখনো চলছে পরিবর্তন-পরিমার্জনের কাজ। এছাড়া ক্রয়-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদের অনুমোদনও মেলেনি এখনো।
২ দিন আগে