ফারাক্কার প্রভাবে পদ্মা এখন ধু-ধু বালুচর

মঈন উদ্দিন, রাজশাহী
প্রকাশ : ২০ জানুয়ারি ২০২৫, ১৪: ২১

আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কলকাতা বন্দরের নাব্য বৃদ্ধির কারণ দেখিয়ে তৈরি ফারাক্কা বাঁধের প্রভাবে বাংলাদেশ অংশে পদ্মা পরিণত হয়েছে একখণ্ড মরুভূমিতে। বিশেষ করে পদ্মা, যমুনা, তিস্তা, ব্রহ্মপুত্রসহ বিভিন্ন নদী, উপ-নদী, শাখা-প্রশাখা এখন পানির পরিবর্তে দেখা যাচ্ছে ধু ধু বালুচর। গঙ্গা পানি চুক্তির ন্যায্যতা আদায় করতে না পারলে অস্তিত্ব সংকটে পড়বে পদ্মা। উত্তরাঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির সংকটও দেখা দিয়েছে।

বিজ্ঞাপন

আগামী ২০২৬ সালে চুক্তি নবায়ন হওয়ার কথা। তখন যেন গ্যারান্টিক্লজ ও ন্যায্য হিস্যা অনুযায়ী পানিপ্রবাহ নিশ্চিত করা যায়, সে বিষয়ে এখনই সংশ্লিষ্টদের সজাগ থাকার আহ্বান পদ্মা পাড়ের মানুষদের। ফারাক্কা চুক্তির পর বাংলাদেশ পানি পেয়েছে কেবল বর্ষা মৌসুমে। কিন্তু সারা বছরের প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে চুক্তি রক্ষা করেনি ভারত। চুক্তির নামে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিম সীমান্ত থেকে ১৮ কিলোমিটার উজানে ভারতের গঙ্গা নদীর ওপর তৈরি করা হয় ফারাক্কা বাঁধ। ১৯৬১ সালে বাঁধের মূল নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে তা শেষ হয়। ১৯৭৫ সালের ২১ এপ্রিল ভারত ফারাক্কা চালু করার পর থেকে অব্যাহতভাবে মরণদশা শুরু হয়েছে। ১৯৮৪ সালের তুলনায় শুকনো মৌসুমে পদ্মা নদীর আয়তন কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশ। পানির গভীরতা কমেছে ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ। প্রবাহ কমেছে ২৬ দশমিক ২ শতাংশ।

শুধু তাই নয়, পানি না পাওয়ায় বাংলাদেশের অসংখ্য নদ-নদীর প্রাণী-বৈচিত্র্য ধ্বংস হয়ে গেছে। নদী আছে পানি নেই, বালু আছে কিন্তু কোথায় যেন কোন মাটির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে পদ্মার কোলে জেগে ওঠা চরে সবুজ ফসল ফলানো সম্ভব হচ্ছে না। প্রতি বছর বালু জমতে জমতে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে উত্তরাঞ্চলে বোরো আবাদের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে চাহিদা মোতাবেক বিদ্যুৎ না পাওয়া আর ভূগর্ভস্থ পানিস্তর নিচে নেমে যাওয়ার জন্য সেচনির্ভর ফসল নিয়ে শঙ্কিত চাষিরা।

এদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে শুষ্ক মৌসুম শুরুর আগেই পানিশূন্য হয়ে যাচ্ছে পদ্মা। এর ফলে চর ও বরেন্দ্র এলাকায় সৃষ্টি হচ্ছে বৈরী আবহাওয়া। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে এ অঞ্চলের মানুষের একদিকে যেমন স্বাস্থ্যের ক্ষতি হচ্ছে, অন্যদিকে এর বিরূপ প্রভাব কৃষিতে পড়ায় মানুষ অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ব্যাপক ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে নদীর নাব্য ফিরিয়ে আনা এবং সব নদীকে পানি সংরক্ষণাগারে পরিণত করা অত্যাবশ্যক। একই সঙ্গে জরুরি ভিত্তিতে গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ করা দরকার। গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণের কথা এ দেশের মানুষ দশকের পর দশক ধরে শুনে আসছে। ব্যারাজটি এখনও নির্মাণ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. লতিফুর রহমান সরকার বলেন, আমরা চরম ভয়াবহ অবস্থার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত করতেছি। ইতোমধ্যে ভূগর্ভের ৪০-৫০ ফুট নিচে পানির স্তর নেমে গেছে। যেভাবে নিয়মিত ভূগর্ভ থেকে পানি উত্তোলন করা হচ্ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে পানির স্তর আরও নিচে নেমে যাবে এবং সংকট প্রকট আকার ধারণ করবে।

নদী গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ফারাক্কা চুক্তি অনুযায়ী ১ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে শুকনো মৌসুম। মৌসুমের ৩১ মে পর্যন্ত উভয় দেশ দশদিন করে গঙ্গার পানি ভাগাভাগি করে নেওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশ চুক্তি মোতাবেক কখনও পানি পায়নি। এ নিয়ে যৌথ নদী কমিশনের তেমন ভূমিকা দেখা যায়নি। নেপালের কোশি থেকে শুরু করে ফারাক্কা পর্যন্ত সুদীর্ঘ পথে ভারত পানি প্রত্যাহারের যে একতরফা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে, তাতে ভাটির দেশ বাংলাদেশের বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠছে। বাংলাদেশের মানুষ চুক্তির নামে প্রতারণার শিকার হয়েছে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত