রবীন্দ্র কাছারিবাড়িতে সেদিন যা ঘটেছিল

আসলাম আলী, শাহজাদপুর (সিরাজগঞ্জ)
প্রকাশ : ১৪ জুন ২০২৫, ০৯: ১২

দর্শনার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের রবীন্দ্র কাছারিবাড়ি। দুদিন বন্ধ থাকার পর গতকাল শুক্রবার সকাল ১০টায় উন্মুক্ত করার পর বেশ কজন দর্শনার্থী স্থাপনাটি পরিদর্শন করেন।

এর আগে ‘হামলা ও ভাঙচুরের’ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সেখানে প্রবেশে অনির্দিষ্টকালের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল। সেই বিধিনিষেধ তুলে নিয়ে গতকাল সেটি খুলে দেয় জেলা প্রশাসন। সরেজমিনে এ দৃশ্য দেখা যায়।

বিজ্ঞাপন

সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম কাছারিবাড়িটি দর্শনার্থীদের প্রবেশের জন্য খুলে দেওয়ার সময় বলেন, রবীন্দ্র কাছারিবাড়িতে কোনো ধরনের হামলার ঘটনা ঘটেনি। স্থাপনাটি সম্পূর্ণ অক্ষত রয়েছে। হামলা হয়েছে মূলত কাছারিবাড়ির পাশের মিলনায়তনে। কোনো মৌলবাদ বা কোনো রাজনৈতিক কারণেও এ ঘটনা ঘটেনি।

গতকাল সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এ আক্রমণের সঙ্গে ব‍্যক্তিগত দ্বন্দ্বের বাইরে কোনো সাম্প্রদায়িক বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই। ওই ঘটনায় রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত কোনো নিদর্শনও নষ্ট হয়নি। কবিগুরুর সম্মান বা মর্যাদাহানিকর কিছুই ঘটেনি।

এদিকে কাছারিবাড়িতে তথাকথিত ‘হামলার’ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি দিয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।

অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে গত ১১ জুন রবীন্দ্র কাছারিবাড়িতে দর্শনার্থীদের প্রবেশ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এর আগে ৮ জুন এক দর্শনার্থী পরিবারের সদস্যরা কাছারিবাড়ি পরিদর্শনে গেলে পার্কিং ফি নিয়ে গেটের এক কর্মচারীর সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। একপর্যায়ে ওই দর্শনার্থীকে মিলনায়তনের ভেতরে আটকে মারধর ও পিটিয়ে আহত করা হয়। সে ঘটনার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। ওই ঘটনায় ভুক্তভোগী শাহনেওয়াজ বাদী হয়ে শাহজাদপুর থানায় কাছারিবাড়ির কাস্টোডিয়ান হাবিবুর রহমানকে ১ নম্বর আসামি করে লিখিত অভিযোগ দেন।

ঘটনার দুদিন পরও কার্যকর কোনো ব্যবস্থা থানা পুলিশ না নেওয়ায় ওই ঘটনার প্রতিবাদে স্থানীয়রা ১০ জুন শাহজাদপুর প্রেস ক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেন। পরে উত্তেজিত জনতা কাছারিবাড়িতে প্রবেশ করে মিলনায়তনের দরজা-জানালা ভাঙচুর করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। শাহজাদপুরের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মুশফিকুর রহমান ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। হামলা-ভাঙচুরের ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনির্দিষ্টকালের জন্য দর্শনার্থীদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়।

গতকাল কাছারিবাড়িতে জেলা প্রশাসক নজরুল বলেন, হামলাটি হয়েছিল কাছারিবাড়ি সংলগ্ন মিলনায়তনে। সেটি এই স্থাপনাকে টার্গেট করে নয়, বরং প্রবেশ টোকেন নিয়ে এক প্রবাসী দর্শনার্থীর সঙ্গে কাছারিবাড়ির কর্মীদের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়। এতে ধর্মীয় বা রাজনৈতিক কোনো কারণ নেই। এখানে নিরাপত্তারও কোনো ঘাটতি নেই। এখন অবাধে ও নির্ভয়ে দর্শনার্থীরা ভ্রমণ করতে পারবেন।

গতকাল জেলা প্রশাসকের সঙ্গে কাছারিবাড়ি পরিদর্শন করেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশাসন) শেখ কামাল হোসেন, সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন, শাহজাদপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. কামরুজ্জামান, সহকারী কমিশনার মুশফিকুর রহমান, উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ইকবাল হোসেন হিরু, উপজেলা জামায়াতের আমির অধ্যাপক মিজানুর রহমান, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কাজী শওকত প্রমুখ।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে হামলা-ভাঙচুর ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটির প্রধান প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের উপপরিচালক (প্রশাসন) শেখ কামাল হোসেন বলেন, ইতোমধ্যেই তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করেছে। শিগগিরই ঘটনার বিস্তারিত প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করা হবে। সেই প্রতিবেদন দেখে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যাবস্থা নেওয়া হবে।

এ ব্যাপারে সিরাজগঞ্জের পুলিশ সুপার ফারুক হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, রবীন্দ্র কাছারিবাড়িতে সার্বিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে। আর কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার আশঙ্কা নেই। তিনি আরো বলেন, ইতোমধ্যেই হামলা-ভাঙচুরের সঙ্গে জড়িত ৬ জনকে আটক করা হয়েছে।

রবীন্দ্র কাছারিবাড়ির কাস্টোডিয়ান হাবিবুর রহমান বলেন, অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার কারণে রবীন্দ্র কাছারিবাড়িতে ১১ জুন থেকে দর্শনার্থীদের প্রবেশ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এতে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা দর্শনার্থীরা ফিরে গেছেন। প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ও জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তি, সাংস্কৃতিক কর্মী, সাংবাদিক ও সুধীসমাজের সঙ্গে কথা বলে এটিকে চালু করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এদিকে নিষিদ্ধ ঘোষিত ছাত্রলীগ ক্যাডাররা কাছারিবাড়ির মিলনায়তনে হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করেছেন শাহজাদপুর উপজেলা বিএনপি নেতারা। মিলনায়তনের দরজা-জানালা ভাঙচুরের নেতৃত্বে ছিল সংগঠনটির ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার আইনবিষয়ক সম্পাদক মো. সবুজ। গত ১২ জুন সন্ধ্যা ৬টায় শাহজাদপুর উপজেলা বিএনপির আয়োজনে দলের অস্থায়ী কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে তারা এ দাবি করেন। এ সময় উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ইকবাল হোসেন হিরু ও সাধারণ সম্পাদক আরিফুজ্জামান আরিফ বক্তব্য দেন।

মোদিকে মমতার চিঠি

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছারিবাড়িতে হামলার ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি দিয়েছেন দেশটির পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার পাঠানো ওই চিঠিতে মমতা ভাঙচুরের ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে মোদিকে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান।

মমতা চিঠিতে বলেন, ‘ভাঙচুরের ঘটনা কেবল মর্মান্তিকই নয়, বরং আমাদের জাতীয় গর্ব ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্যও দুর্ভাগ্যজনক। এটি আমাদের সংবেদনশীলতা, আমাদের লালিত সম্পদ এবং অতীতের জন্য আমাদের সাধারণ স্মৃতির ওপর এক জঘন্য আক্রমণ। বাংলার মানুষের কাছে এই হামলা কবির সাধারণভাবে প্রচলিত ঐতিহ্যের ওপরই আক্রমণ।

নরেন্দ্র মোদিকে উদ্দেশ করে মমতা লেখেন, আমি আপনাকে অনুরোধ করব যে, আপনি দয়া করে প্রতিবেশী দেশের সরকারের সঙ্গে বিষয়টি অত্যন্ত জোরালোভাবে তুলে ধরুন, যাতে এই জঘন্য ও নির্বোধ কাজের জন্য দায়ীদের দ্রুত বিচারের আওতায় আনার ক্ষেত্রে কোনো বিলম্ব না করা হয়। যদিও ইতোমধ্যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, তবুও ভবিষ্যতে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্মৃতিস্তম্ভগুলোর ওপর যে কোনো হামলা রোধে জোরালো আন্তর্জাতিক প্রতিবাদ অত্যন্ত জরুরি। কারণ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কেবল বাংলাতেই নয়, সমগ্র বিশ্বেই খ্যাত।’

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত