আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

শরীয়তপুর-১

বিএনপির প্রার্থী আসলামকে নিয়ে তৃণমূলে অসন্তোষ চরমে

মো. আল-আমিন, শরীয়তপুর

বিএনপির প্রার্থী আসলামকে নিয়ে তৃণমূলে অসন্তোষ চরমে

ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে শরীয়তপুর-১ (সদর ও জাজিরা) আসনে বিএনপির প্রার্থী নিয়ে তৃণমূলে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে। ভোটের সময় যত ঘনিয়ে আসছে, ততই উত্তেজনার পারদ বাড়ছে স্থানীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে। অপরদিকে মাঠ গোছাতে শুরু করেছে জামায়াতে ইসলামী। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় নাগরিক পার্টিও জোর প্রচারে নেমেছে। প্রত্যেক দলই দাবি করছে যে সুষ্ঠু ভোট হলে তাদের প্রার্থীই নির্বাচিত হবেন।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির ঘোষিত প্রার্থী সাঈদ আহমেদ আসলামকে কেন্দ্র করে তৃণমূলে শুরু হয়েছে তীব্র মতবিরোধ। এখানে এবার নতুন করে মাথাচাড়া দিয়েছে অন্তর্কোন্দল ও মনোনয়ন-সংকট। বিএনপি কেন্দ্রীয়ভাবে শীর্ষ আসনগুলোতে তাদের প্রার্থীর নাম প্রকাশ করার পর থেকেই শরীয়তপুর-১ আসনে দেখা দেয় অস্থিরতা। ঘোষিত প্রার্থী সাঈদ আহমেদ দলটির জেলার সাংগঠনিক সম্পাদক হলেও, স্থানীয় নেতাকর্মীদের একাংশ তাকে ‘অ-স্থানীয়’ ও ‘গ্রহণযোগ্য নন’ বলে দাবি করছেন।

বিজ্ঞাপন

মনোনয়ন বঞ্চিতদের মধ্যে সবচেয়ে আলোচনায় আছেন সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন কালু। তার সমর্থকরা বেশ কয়েকদিন ধরে মানববন্ধন, বিক্ষোভ সমাবেশ, মশাল মিছিল এবং সড়ক অবরোধ করে মনোনয়ন বাতিলের দাবি জানাচ্ছেন।

বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা অভিযোগ করছেন, দলীয়ভাবে যিনি বছরের পর বছর শ্রম দিয়েছেন, তাকে বাদ দিয়ে বাইরে থেকে প্রার্থী আনা হয়েছে। এটি তৃণমূলকে উপেক্ষা করার শামিল।

স্থানীয় সূত্রে খবর পাওয়া গেছে, বিক্ষোভকারীরা একাধিকবার শহরের বিভিন্ন সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবাদ করেন এবং কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার দাবি জানিয়ে স্লোগান দেন। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে—নেতাকর্মীদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে সাধারণ ভোটাররাও পড়েছেন বিভ্রান্তিতে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক প্রবীণ ভোটার বলেন, বিএনপি নিজেরাই যদি এক না হয়, তাহলে বাইরে কীভাবে তারা লড়বে? আমরাও বুঝতে পারছি না কাকে সমর্থন দেব।

শরীয়তপুর পৌরসভার ৫ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি আলী আজম সরদার বলেন, ‘শরীয়তপুর–১ আসনে অন্য একটি নির্বাচনি এলাকা থেকে একজন নেতাকে এনে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। ত্যাগী নেতাকে বাদ দেওয়া হয়েছে, যা আমরা মানতে পারছি না। মনোনয়ন পরিবর্তন না করা পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাব।

সদর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক নাজমুল ছৈয়াল বলেন, সাঈদ আহমেদ জেলা পর্যায়ের নেতা হলেও তিনি শরীয়তপুর–৩ নির্বাচনি এলাকার বাসিন্দা।

বিএনপি যখন অন্তর্দ্বন্দ্বে ব্যস্ত, ঠিক তখনই মাঠ গোছাতে শুরু করেছে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)।

তিনটি দলই এ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশ জামায়েত ইসলামীর পক্ষ থেকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে ড. মোশাররফ হোসেন মাসুদকে, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ থেকে প্রার্থী তোফায়েল আহমেদ কাসেমী।

তাদের নেতাকর্মীরা প্রতিদিনই বিভিন্ন গ্রামে গণসংযোগ করছেন। তাদের দাবি—সুষ্ঠু ভোট হলে তাদের প্রার্থীই নির্বাচিত হবেন।

এই আত্মবিশ্বাসের পেছনে কারণও আছে। বিশেষ করে বিএনপির অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগে তারা বাড়তি সাড়া পাচ্ছেন তৃণমূল ভোটারদের কাছে।

জামায়াত নেতা ইঞ্জিনিয়ার লোকমান হোসাইন বলেন, জামায়াত ক্ষমতায় গেলে এলাকায় দুর্নীতি, চাঁদাবাজি ও মাদক নির্মূল করবে ইনশাআল্লাহ। ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করে ন্যায়ভিত্তিক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠাই আমাদের লক্ষ্য। তিনি আরো জানান, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অস্থিরতায় মানুষ বিকল্প খুঁজছে, আর সেই সুযোগটাই নিতে চায় জামায়াত।

এ আসনে আরো কয়েকটি দলের প্রার্থী থাকায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরো বহুমুখী হয়ে উঠেছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), জাকের পার্টি ও খেলাফত মজলিসের প্রার্থীরাও ধীরে ধীরে মাঠে সক্রিয় হচ্ছেন।

শরীয়তপুর সদর উপজেলার পালং এলাকার এক মধ্যবয়সি ভোটার শহি মাদবর বলেন, আমরা দল দেখি না, মানুষ দেখি। বিএনপি হোক বা জামায়াত—যে এই এলাকার উন্নয়ন করবে, দেশের জন্য ভালো করবে, তাকেই ভোট দিতে চাই। কিন্তু দলগুলোর ভেতরের মারামারি আমাদের বিভ্রান্ত করছে।

জাজিরা উপজেলার এক তরুণ ভোটার পলাশ খান বলেন, আগে ভাবতাম বিএনপিই একমাত্র বিকল্প। কিন্তু এখন যদি তারা নিজেরাই এক থাকতে না পারে, তাহলে বিকল্প ভাবতেই হচ্ছে। যারা সুশাসনের কথা বলবে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে থাকবে—তাদের দিকেই ঝুঁকছি।

শরীয়তপুরের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. তোয়াব হোসেন বলেন, বাংলাদেশের নির্বাচনি রাজনীতিতে তৃণমূলকে উপেক্ষা করলে তার প্রতিক্রিয়া অবশ্যম্ভাবী। শরীয়তপুর-১ আসনে বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিভক্তি যদি দ্রুত নিরসন না হয়, তাহলে এতে সরাসরি লাভবান হবে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) শরীয়তপুর জেলার সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম বলেন, আমাদের অবস্থান দল-নিরপেক্ষ। আমরা চাই এমন জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হোক, যিনি সুশাসন, জবাবদিহি ও আইনের শাসন নিশ্চিত করবেন। বিএনপি হোক বা জামায়াত—যে দলই হোক, প্রার্থীকে হতে হবে সৎ, গ্রহণযোগ্য ও জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। ভোটারদের উচিত দলীয় আবেগের বাইরে এসে প্রার্থীর যোগ্যতা ও নৈতিকতা বিবেচনা করা।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন