খুলছে সেন্টমার্টিন, জাহাজ চালাতে রাজি নন মালিকরা

স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার
প্রকাশ : ৩১ অক্টোবর ২০২৫, ১৭: ১৩

দীর্ঘ ৯ মাস বন্ধ থাকার পর আজ পহেলা নভেম্বর থেকে আবারো সেন্টমার্টিন দ্বীপ ভ্রমণে যেতে পারবেন পর্যটকরা। তবে প্রতিদিন সর্বাধিক দু’হাজার পর্যটক সেন্টমার্টিনে যাওয়ার সুযোগ পাবেন। কিন্তু তারা সেন্টমার্টিনে রাত্রিযাপন করতে পারবেন না। দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ভ্রমণের ক্ষেত্রে সেন্টমার্টিনগামী পর্যটকদের মানতে হবে সরকারের ১২ নির্দেশনা।

বিজ্ঞাপন

নভেম্বর জুড়ে সুযোগ না থাকলেও ডিসেম্বর ও জানুয়ারি দু’মাস পর্যটকরা সেন্টমার্টিনে রাতযাপন করতে করতে পারবেন।

দেশের একমাত্র প্রবালসমৃদ্ধ এই দ্বীপে পহেলা ফেব্রুয়ারি থেকে পর্যটকদের যাতায়াত বন্ধ রয়েছে। এবারও নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাস দ্বীপটিতে ভ্রমণের সুযোগ পাবেন পর্যটকরা। পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের বিধিনিষেধের কারণে সেন্টমার্টিনের পর্যটন শিল্পে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।

এদিকে নভেম্বরে রাতে অবস্থানের সুযোগ না থাকায় পর্যটকদের সেন্টমার্টিনে যাওয়ার আগ্রহ কম থাকবে বলেই মনে করা হচ্ছে। তাই পর্যটক খরার আশঙ্কায় সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পহেলা নভেম্বর থেকে জাহাজ চালানো শুরু না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাহাজ মালিকদের সংগঠন সি ক্রুজ অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ।

যদিও কক্সবাজার শহরের উত্তর নুনিয়াছড়া বিআইডব্লিউটিএ জেটি ঘাট থেকে সেন্টমার্টিনগামী জাহাজ চলাচলের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। আইনগত বিধিনিষেধের কারণে ইনানিতে নৌবাহিনীর জেটি থেকে সেন্টমার্টিনগামী জাহাজ চলাচলের সুযোগ রাখা হয়নি।

পহেলা নভেম্বর থেকে সেন্টমার্টিন পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়েছে জানিয়ে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট (এডিএম) মো. শাহিদুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, সেন্টমার্টিনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকারের জারি করা ১২ নির্দেশনা এবার কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করবে জেলা প্রশাসন।

তিনি জানান, আগে টেকনাফ থেকে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল করলেও নিরাপত্তার কারণে এখন কক্সবাজার শহর থেকে পর্যটকবাহী জাহাজ বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে সেন্টমার্টিন যাতায়াত করবে।

স্থানীয় অধিবাসী ও পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, কক্সবাজার থেকে সেন্টমার্টিন যাতায়াতে ১২ থেকে ১৪ ঘণ্টা সময় লাগে। সেখানে যদি পর্যটকরা রাত্রিযাপন করতে না পারেন, তাহলে মাত্র দুই-তিন ঘণ্টা ভ্রমণের জন্য ১৪ ঘণ্টা জাহাজে চড়ে তারা সেন্টমার্টিনে যাওয়ার আগ্রহ হারাবেন।

এ জন্য তারা বর্তমান সরকারের পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের ‘বাড়াবাড়ি’কে দায়ী করছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেন্টমার্টিনের একাধিক অধিবাসী ও পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, এই রিজওয়ানা হাসান পরিবেশ দোহাই দিয়ে কক্সবাজার ও সেন্টমার্টিনের পর্যটন শিল্পকে ধ্বংস করছেন। একই সাথে সেন্টমার্টিনের অধিবাসীদের জীবিকায় আঘাত করেছেন।

অন্যদিকে পরিবেশ অধিদপ্তর বলছে, প্রতিবেশ সংকটাপন্ন সেন্টমার্টিনে ১ হাজার ৭৬ প্রজাতির জীববৈচিত্র্য রয়েছে। অতীতে অনিয়ন্ত্রিতভাবে অবকাঠামো নির্মাণ, বিপুল পর্যটকের সমাগম ও পরিবেশদূষণের কারণে দ্বীপটি সংকটাপন্ন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু গত ৯ মাস সেন্টমার্টিনে পর্যটক যাতায়াত বন্ধ থাকায় দ্বীপের জীববৈচিত্র্য বিস্তার ও পরিবেশের উন্নতি হয়েছে।

বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের উপ-পরিচালক মহিবুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, সেন্টমার্টিনে যাতায়াতের জন্য পর্যটকদের যে ১২টি নির্দেশনা মানতে হবে তারমধ্যে অন্যতম বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের স্বীকৃত ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে অনলাইনে টিকিট কিনতে হবে। সেখানে প্রতিটি টিকিটে ট্রাভেল পাস এবং কিউআর কোড সংযুক্ত থাকবে। কিউআর কোড ছাড়া টিকিট নকল হিসেবে গণ্য হবে। এসব নিশ্চিত করার জন্য ট্যুরিজম বোর্ডের পক্ষ থেকে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত বছরের মতো এবারও কক্সবাজার শহরের উত্তর নুনিয়াছড়ার বিআইডব্লিউটিএ ঘাট থেকে সেন্টমার্টিনে যাওয়া-আসা করবে পর্যটকবাহী জাহাজ। আইনগত বিধিনিষেধ থাকায় উখিয়ার ইনানী থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।

গত ২৭ অক্টোবর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়, বিআইডব্লিউটিএ এবং নৌপরিবহণ অধিদপ্তরকে নীতিগত সম্মতি প্রদান বিষয়ে প্রেরিত চিঠিতে এমন সিদ্ধান্তের কথা বলা হয়েছে।

এদিকে জাহাজমালিক ও পর্যটনসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, মিয়ানমারের রাখাইনে সংঘাতের কারণে ২০২৩ সাল থেকে টেকনাফের দমদমিয়া ঘাট থেকে জাহাজ চলাচল বন্ধ রয়েছে। এরপর মেরিন ড্রাইভের ইনানীর নৌবাহিনী জেটিঘাট দিয়ে জাহাজ চলাচল করেছিল। গত বছর থেকে কক্সবাজার শহরের উত্তর নুনিয়াছড়া বিআইডব্লিউটিএর জেটিঘাট থেকে সাগরপথে পর্যটকবাহী জাহাজ চলাচল করে আসছিল।

জাহাজ মালিকদের সংগঠন সি ক্রুজ অপারেটর ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক হোসাইনুল ইসলাম বাহাদুর বলেন, পহেলা নভেম্বর থেকে কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন রুটে জাহাজ চলাচলের অনুমতি রয়েছে। কিন্তু পর্যাপ্ত পর্যটক বা যাত্রী না থাকায় জাহাজ চালানো সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি বলেন, গত বছরের মতো ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে জাহাজ চালানোর প্রস্তুতি চলছে। তবে ইনানী থেকে জাহাজ চালানোর অনুমতি পেলে হয়তো এই নভেম্বরে চালানোর সিদ্ধান্ত হতে পারে।

সুত্র বলছে, ইতোমধ্যে সেন্টমার্টিন রুটে পর্যটক বহনের জন্য দুইটি জাহাজ অনুমোদন পেয়েছে। এগুলো হলো কর্ণফুলী এক্সপ্রেস ও বার আউলিয়া। অন্যগুলো এখনও প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।

সেন্টমার্টিন হোটেল-রিসোর্ট মালিক সমিতির সভাপতি শিবলুল আযম কোরেশী সাংবাদিকদের বলেন, দ্বীপের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সরকারের উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। কিন্তু দ্বীপে পর্যটনখাতের বিনিয়োগ ও স্থানীয়দের জীবন-জীবিকা ঝুঁকিতে ফেলে পরিবেশ রক্ষা ও ভালো পর্যটন আশা করা যাবে না।

অপরদিকে দীর্ঘদিন পর্যটকশূন্য সেন্টমার্টিনে কর্মহীন হয়ে পড়া নিম্নবিত্ত ৫০০ পরিবারকে সরকার ১১ হাজার ৪০০ টাকা করে অর্থ সহায়তা দেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ এহসান উদ্দিন।

সেন্টমার্টিন যেতে মানতে হবে যে ১২ নির্দেশনা

সেন্টমার্টিন দ্বীপের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, পরিবেশ, প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র রক্ষায় ভ্রমণের ক্ষেত্রে সরকার গত ২২ অক্টোবর পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়- এ সংক্রান্ত ১২টি নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।

প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া সেন্টমার্টিন দ্বীপে কোনো নৌযান চলাচলের অনুমতি দিতে পারবে না। পর্যটকদের অবশ্যই বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের স্বীকৃত ওয়েব পোর্টালের মাধ্যমে অনলাইনে টিকিট কিনতে হবে। সেখানে প্রতিটি টিকিটে ট্রাভেল পাস এবং কিউআর কোড সংযুক্ত থাকবে। কিউআর কোড ছাড়া টিকিট নকল হিসেবে গণ্য হবে।

দ্বীপে ভ্রমণের সময়সূচি এবং পর্যটক উপস্থিতিও এবার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত থাকবে। নভেম্বর মাসে পর্যটকরা শুধু দিনের বেলায় ভ্রমণ করতে পারবেন, রাত্রিযাপন করতে পারবেন না। ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাসে রাত্রিযাপনের অনুমতি থাকবে। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে দ্বীপে পর্যটক যাতায়াত সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকবে। প্রতিদিন গড়ে দুই হাজারের বেশি পর্যটক দ্বীপে ভ্রমণ করতে পারবেন না।

সেন্টমার্টিনের প্রাকৃতিক পরিবেশ অক্ষুণ্ন রাখতে রাতে সৈকতে আলো জ্বালানো, শব্দ সৃষ্টি বা বার-বি-কিউ পার্টি করা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কেয়াবনে প্রবেশ, কেয়া ফল সংগ্রহ বা ক্রয়-বিক্রয়, সামুদ্রিক কাছিম, পাখি, প্রবাল, রাজকাঁকড়া, শামুক-ঝিনুক ও অন্যান্য জীববৈচিত্র্যের ক্ষতি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এছাড়া সৈকতে মোটরসাইকেল, সি-বাইকসহ যে কোনো মোটরচালিত যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ থাকবে।

নিষিদ্ধ পলিথিন বহণ করা যাবে না এবং একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিক, যেমন চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিক চামচ, স্ট্র, সাবান ও শ্যাম্পুর মিনিপ্যাক, ৫০০ ও ১০০০ মিলিলিটারের প্লাস্টিক বোতল ইত্যাদি বহন নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। পর্যটকদের নিজস্ব পানির ফ্লাস্ক সঙ্গে রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত