আমার দেশ

১৬ বছরে ব্যবসা গুটিয়েছে ১৪ বিদেশি এয়ারলাইনস

সোহাগ কুমার বিশ্বাস, চট্টগ্রাম
১৬ বছরে ব্যবসা গুটিয়েছে ১৪ বিদেশি এয়ারলাইনস

আওয়ামী সরকারের ১৬ বছরে নানা অব্যবস্থাপনা আর দুর্নীতির কারণে চট্টগ্রাম থেকে একে একে ১৪টি বিদেশি এয়ারলাইনস কোম্পানি ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে। মাত্র দুটি এয়ারলাইনস দিয়ে ‘আন্তর্জাতিক’ নামটি এখনো ধরে রেখেছে চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। অথচ আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ দুই রুটেই যাত্রী পরিবহনে প্রবৃদ্ধি হচ্ছে প্রতিবছর। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, অনিয়ম আর দুর্নীতির কারণেই এয়ারলাইনসের সংখ্যা কমেছে বন্দরনগরী থেকে।

বিজ্ঞাপন

তবে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর শৃঙ্খলা ফিরেছে আকাশ পরিবহন সেবায়। চলে যাওয়া ১৪টির মধ্যে তিনটি এয়ারলাইনস আবারও ফেরার প্রস্তুতি শুরু করেছে। এরই মধ্যে বিমানবন্দরের আধুনিকায়নে বেশ কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। এগুলো বাস্তবায়ন হলে ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।

এদিকে, বন্ধ হয়ে যাওয়া দেশি-বিদেশি ছয়টি এয়ারলাইনসের কাছে শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের পাওনা দুই হাজর ১২৬ কোটি টাকা। বারবার তাগাদা দিয়েও বাংলাদেশ বিমান ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বকেয়া আদায়ে আশানুরূপ সাড়া পাচ্ছে না বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। উপায়ন্তর না পেয়ে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার কথাও চিন্তা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

সূত্র জানায়, ২০০০ সালে এই বিমানবন্দর আন্তর্জাতিক মর্যাদা পায়। তখন থেকেই সরাসরি বিদেশি ফ্লাইট চলাচল শুরু হয়। প্রথম পর্যায়ে বছরে ছয় লাখ যাত্রী পরিবহনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। দুই যুগের ব্যবধানে এখন সেই একই অবকাঠামোতে সাড়ে ১৬ লাখ যাত্রী আসা-যাওয়া করছে। প্রতিবছর এই সংখ্যা বাড়ছে।

২০২২ সালে হযরত শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করেছে ১৪ লাখ ৫৫ হাজার ১৮ যাত্রী। এর মধ্যে ৮ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪ জনই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন রুটের যাত্রী। ওই বছর অভ্যন্তরীণ রুটের যাত্রী ছিলেন ৫ লাখ ৬১ হাজার ৯৫৪ জন। ২০২৩ সালে এই বিমানবন্দরে মোট যাত্রী আসা-যাওয়া করেছে ১৬ লাখ ২৭ হাজার ৮৭ জন। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক রুটের যাত্রীসংখ্যা ছিলেন ৯ লাখ ৭৭ হাজার ৬৭৪ আর অভ্যন্তরীণ রুটে যাত্রী আসা-যাওয়া করেছেন ৬ লাখ ৪৯ হাজার ৪১৩ জন। সবশেষ ২০২৪ সালে চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের মোট যাত্রী ছিলেন ১৬ লাখ ৪১ হাজার ৬১১ জন। এর মধ্যে অন্তর্জাতিক রুটে ৯ লাখ ২১ হাজার ৬২৭ এবং অভ্যন্তরীণ রুটে ৭ লাখ ১৯ হাজার ৯৮৪ যাত্রী এই বিমানবন্দর ব্যবহার করেছেন।

যাত্রীসংখ্যায় প্রবৃদ্ধি অব্যাহত থাকলেও কমছে এয়ারলাইনসের সংখ্যা। আন্তর্জাতিক মর্যাদা পাওয়ার পর থেকে ১৬টি বিদেশি এয়ারলাইনস চট্টগ্রাম থেকে সরাসরি বিভিন্ন দেশে ফ্লাইট পরিচালনা করত। পাশাপাশি দেশি আরো সাতটি এয়ারলাইনস অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট চালাত। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই একে একে বন্ধ হতে শুরু করে দেশি-বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো। এর মধ্যে সবচেয়ে বিপর্যয় নামে বিদেশি এয়ারলাইনসের ক্ষেত্রে। ১৬ বছরে বিদেশি ১৪টি এয়ারলাইনস তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে চট্টগ্রাম থেকে। এছাড়া তিনটি দেশি এয়ারলাইনসও বন্ধ হয়ে গেছে এ সময়ে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে শাহ আমানত বিমানবন্দরের শীর্ষ এক কর্মকর্তা জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে লোক দেখানো বিভিন্ন প্রকল্পের নামে লুটপাট হলেও প্রকৃত সমৃদ্ধি অর্জিত হয়নি বিমানবন্দরের। আন্তর্জাতিক এয়ারলাইনসগুলো বাংলাদেশ সময় বিকাল ৫টা থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত স্লট চায়। কিন্তু বিমানবন্দরটি পরিচালনা হয় সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত। আন্তর্জাতিক রুটের ফ্লাইটের জন্য রাতের গুরুত্বপুর্ণ সময় বন্ধ থাকে বিমানবন্দর। তাই সকালের দিকে আন্তর্জাতিক রুটের ফ্লাইটের চাপ বেশি থাকে। একসঙ্গে ৩০০ থেকে ৪০০ যাত্রী এলে ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করার পর্যাপ্ত কাউন্টার নেই। মাত্র দুটি ব্যাগেজ বেল্ট দিয়ে এতে যাত্রীর চাপ সামালোর সুযোগও নেই। তার মধ্যে প্যাসেঞ্জার বিল্ডিংয়ের সক্ষমতা কম। ৬ লাখ যাত্রীর সক্ষমতা দিয়ে ১৬ লাখ হ্যান্ডলিং করা হচ্ছে। ফলে অনেক ভোগান্তি তৈরি হচ্ছে। যাত্রী বেশি হওয়ায় একেকটি লাগেজ পেতে দেড় থেকে দুই ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লাগছে।

বিদেশি বিমান সংস্থার ফ্লাইট কমে যাওয়ায় চট্টগ্রামভিত্তিক বিদেশগামী যাত্রীদের ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে বিদেশে যেতে হচ্ছে। অথবা সংযুক্ত আরব আমিরাত কিংবা ওমানের মাসকাট হয়ে ইউরোপ-আমেরিকা-চীনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গন্তব্যে যেতে হচ্ছে। এতে বাড়তি সময় ব্যয় ও খরচ বেশি হচ্ছে বলে অভিযোগ যাত্রীদের।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের রানওয়ের সমস্যা আপাতত নেই। কিন্তু অন্যান্য অবকাঠামো ও আধুনিক যন্ত্রাংশের সংকট প্রকট। যাত্রীর আকাল না থাকলেও এসব কারণে নামে আন্তর্জাতিক থাকলেও মানের দিক থেকে তা কতটা ধরে রাখতে পেরেছে—সে প্রশ্ন রয়েই গেছে।

গত ১৬ বছরে চট্টগ্রাম থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়া এয়ারলাইনসগুলোর মধ্যে রয়েছে আমিরাতভিত্তিক ফ্লাই দুবাই, ভারতের স্পাইস জেট বিমান, কুয়েতের জাজিরা এয়ারওয়েজ, ওমান এয়ার, থাই এয়ার, থাই স্মাইল এয়ার, কুয়েত এয়ার, ফুকেট এয়ার, মালিন্দো এয়ার, রোটানা এয়ার, হিমালয়ান এয়ার, রাস আল কাইমা (আরএকে) এয়ার, টাইগার এয়ারওয়েজ ও সিল্ক এয়ার।

বর্তমানে চট্টগ্রাম থেকে আন্তর্জাতিক রুটের ফ্লাইট পরিচালনা করছে মাত্র চারটি এয়ারলাইনস। এর মধ্যে দুটি দেশি আর দুটি বিদেশি। বিদেশি সংস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে এয়ার অ্যারাবিয়া ও সালাম এয়ার। আর বিমান বাংলাদেশ এবং ইউএস বাংলা নামের দুটি দেশি এয়ারলাইনস চট্টগ্রাম থেকে আন্তর্জাতিক রুটে বিমান চালনা করছে।

এ বিষয়ে বিমানবন্দরের পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন শেখ আব্দুল্লাহ আলমগীর জানান, কোনো এয়ারলাইনস ব্যবসা গুটিয়ে নিতে চাইলে অনেকগুলো কারণ একসঙ্গে হতে হয়। বিমানবন্দরের সংকট অন্য ২০টি কারণের মধ্যে মাত্র একটি। বিমানবন্দরের যে সংকটগুলো দীর্ঘদিন ধরে জমা ছিল, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সেগুলো চিহ্নিত করে পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এয়ারপোর্টের সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। এরই মধ্যে ব্যবসা গুটিয়ে নেওয়া এয়ারলাইনসগুলো যোগাযোগ শুরু করেছে। ফ্লাই দুবাই আগামী পহেলা অক্টোবর থেকে অপারেশনে আসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সৌদি এয়ারলাইনস নতুন করে ফিজিবিলিটি স্ট্যাডি শুরু করেছে। কাতার এয়ারওয়েজও যোগাযোগ করছে। এর মধ্যে সংকটগুলো নিরসন করতে পারলে আরো নতুন নতুন এয়ারলাইনস চট্টগ্রামে আসতে উৎসাহিত হবে বলে জানান তিনি।

পাওনা আদায়ে অনিশ্চয়তা

দেশি-বিদেশি ছয়টি এয়ারলাইনসের কাছে দুই হাজার ১২৬ কোটি টাকা পাওনা রয়েছে শাহ আমানত কর্তৃপক্ষের। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি টাকা বকেয়া রেখেছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে—রিজেন্ট এয়ার, ইউএস-বাংলা, নভোএয়ার, জিএমজি এয়ারলাইনস ও ইউনাইটেড এয়ারওয়েজ। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের কাছেই এককভাবে পাওনা রয়েছে এক হাজার ৭৮৬ কোটি টাকা। বকেয়া আদায়ে দফায় দফায় চিঠি চালাচালি করেও শুধু বিমান বাংলাদেশ ছাড়া আর কেউ সাড়া দিচ্ছে না।

শাহ আমানতের জনসংযোগ কর্মকর্তা ইব্রাহীম খলিল জানান, এয়ারলাইনস প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ছয় ধরনের অ্যারোনটিক্যাল চার্জ আদায় করে থাকে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। এসব খাতে এয়ারলাইনস প্রতিষ্ঠানের কাছে দীর্ঘদিন ধরে দুই হাজার কোটি টাকার বেশি রাজস্ব পাওনা। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানের কাছে বকেয়া রাজস্বের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ১২৬ কোটি ৪৩ লাখ ৬০ হাজার ২৭৭ টাকা।

তিনি আরো জানান, এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে তিনটি এয়ারলাইনস বকেয়া পরিশোধ না করেই তাদের কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। এই তিন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রিজেন্ট এয়ারের কাছে পাওনা ২৫২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা, ইউনাইটেড এয়ারওয়েজের কাছে পাওনা ৫৪ কোটি ৯৬ লাখ এবং জিএমজি এয়ারলাইনসের কাছে পাওনা ২৯ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এছাড়া ইউএস-বাংলার কাছে পাওনা দুই কোটি ৩৮ লাখ টাকা এবং নভো এয়ারের কাছে এক কোটি ২০ লাখ টাকা। চালু থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ানো হচ্ছে। আর বন্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে বকেয়া আদায়ে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার কথা ভাবছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন