কিস্তিতে ফ্রিজ কিনে জেল খাটলেন গৃহবধূ

জেলা প্রতিনিধি, কুড়িগ্রাম
প্রকাশ : ১১ নভেম্বর ২০২৫, ২০: ৫৮
আপডেট : ১১ নভেম্বর ২০২৫, ২১: ৪৫

সহজ কিস্তিতে পণ্য কেনার ধ্রুম্যজালে আটকা পড়ে বকেয়া ঋণের দায়ে কারাগারে যেতে হয়েছে কুড়িগ্রামের এক হতদরিদ্র গৃহবধূকে। ওয়ালটন ব্রান্ডের একটি ফ্রিজ কেনার কিস্তির টাকা পরিশোধ করতে বিলম্ব হওয়ায় তাকে এই কঠিন শাস্তি ভোগ করতে হয়েছে। যদিও দুই দিন কারাভোগের পর তিনি জামিনে মুক্ত হয়ে ঘরে ফিরেছেন।

ভুক্তভোগী গৃহবধূর নাম আনোয়ারা বেগম (৩২)। তিনি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভোগডাঙা ইউনিয়নের ধরলা তীরবর্তী চর বড়াইবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা কপিয়ালের স্ত্রী। কপিয়াল পেশায় একজন রিকশাচালক।

বিজ্ঞাপন

গত শুক্রবার (৭ নভেম্বর) দিবাগত মধ্যরাতে পরোয়ানার (ওয়ারেন্ট) ভিত্তিতে আনোয়ারা বেগমকে বসতবাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। পরে সোমবার (১০ নভেম্বর) সকালে তিনি জামিনে মুক্ত হন। কিস্তিতে ফ্রিজ কিনে গৃহবধূর জেলে যাওয়ার ঘটনা এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছে।

চর বড়াইবাড়ি গ্রামে আনোয়ারা-কপিয়াল দম্পতির বাড়িতে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কিস্তির টাকা পরিশোধে বিলম্বে জেলে যাওয়ার ঘটনা কোনোভাবেই মানতে পারছেন না এই দম্পতি ও গ্রামবাসী।

আনোয়ারা জানান, দ্ররিদ্র পারিবারের অনটন দূর করতে ২০২৩ সালে গ্রামে এ্কটি দোকানঘর ভাড়া নিয়ে তিনি নিজেই সেই দোকানে ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করেন। ওই সময় দোকানের জন্য কিস্তিতে ওয়ালটন কোম্পানির একটি ফ্রিজ কেনেন। তখন ফ্রিজের দাম ছিল ৩৯ হাজার টাকা। সাধ্যমতো নিয়মিত কিস্তি পরিশোধও করছিলেন। কিন্তু এর মধ্যে মেয়ের বিয়ের আয়োজন হয়। বাধ্য হয়ে সুদের ওপর ঋণ করে মেয়ের বিয়ে দেন। সেই ঋণের সুদের টাকা আর ফ্রিজের কিস্তি পরিশোধ করতে হিমশিম খাচ্ছিলেন। এরমধ্যে মূলধনের অভাবে দোকানটি বন্ধ হয়ে যায়। সংসারের খরচ আর ঋণ পরিশোধের জন্য স্বামী কপিয়াল ঢাকায় রিকশা চালাতে যান। কিন্তু তার একার আয় দিয়ে কোনও কিছুরই ঠিকমতো চলছিল না। এর মধ্যে কষ্ট করে হলেও ফ্রিজের কিস্তির ৩৪ হাজার টাকা পরিশোধ করেন। কিন্তু ততদিনে সুদে আসলে ফ্রিজের মূল্য দাঁড়ায় ৫৬ হাজার টাকায়। তারপরও যখন যেমন পেরেছেন কিস্তিতে টাকা দিয়েছেন। এরমধ্যে ওয়ালটন কোম্পানির পক্ষ থেকে যে মামলা করা হয়েছে তা কোনোভাবে তারা জানতে পারেননি।

আনোয়ারা বলেন, “মামলা হইছে সেটা আমরা জানতাম না। হঠাৎ মাঝ রাইতে পুলিশ আসি আমাক বলে যে তাদের সাথে যাইতে হবে। আমারতো গোটা শরীর কাঁপা শুরু করছে। একটা মহিলা পুলিশ জানায় যে কোনো কোম্পানির থাকি মালামাল কেনার টাকা পরিশোধ না করায় মামলা হইছে। তখনই ফোন করি স্বামীক জানাই। রাইতে পুলিশ আমাক নিয়া যায়া জেলে পাঠায় দেয়। স্বামী ঢাকা থাকি আসি একদিন পর আমাক জামিন করায়। দুইদিন জেল খাটি বাড়ি আসছি। এলাও আমার শরীর কাঁপে। ফ্রিজ কিনিয়া জেল খাঁটা লাগিলো।”

তিনি আরও বলেন, “তিন মাস থাকি কিস্তি নিবারও আইসে না। ওমরা মামলা করছে তাও জানি না। ৩৪ হাজার টাকা পরিশোধ করছি। অভাবের সংসারের জন্যে বাকি কয়টা টাকা এলাও দিবার পাই নাই। আস্তে আস্তে দিবার চাই। কিন্তু জেলত যাওয়া লাগবে সেটা চিন্তা করি নাই। বেটির বিয়া দেওয়া ধারের টাকাও পরিশোধ করবার পাই নাই। আমাদের অবস্থা খারাপ। স্বামী টাকা ধার করি নিয়া জামিন করাইছে।” নিজের আর্থিক অনটনের কথা এভাবেই বলেন ভুক্তভোগী এই গৃহবধূ।

আনোয়ারার স্বামী কপিয়াল বলেন, “হামরা গরিব মানুষ। খাসের জায়গায় থাকি। কিস্তির জন্যে মামলা হইছে সেটা কবার পাই নাই। কেউ আমাদেক বলে নাই, নোটিশও পাই নাই। খবর পায়া ওই রাইতে ঢাকা থাকি বাড়ি আসছি। উকিল ধরি বউকে জামিন করি আনছি। ফ্রিজের টাকা কিস্তিতে শোধ করা ছাড়া উপায় নাই। ফ্রিজ কিনিয়া এমন পরিস্থিতিতে পড়া লাগবে কোনো দিনও ভাবি নাই।”

ওই গ্রামের বাসিন্দা ও পল্লী চিকিৎসক আমির হোসেন বলেন, “এরা হতদরিদ্র। খাসের জায়গায় ঘর তুলে জীবন-যাপন করেন। কিস্তির সামান্য কয়টা টাকার জন্য একজন নারীকে এভাবে জেল খাটানো অমানবিক। সময় দিলে এরা আস্তে আস্তে টাকা পরিশোধ করবে। কত বড় বড় ঋণ খেলাপি দাপটে ঘুরে বেড়ায়। গরিব মানুষের বেলায় শুধু আইন!”

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আনোয়রা বেগম কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার ওয়ালটন শো-রুম থেকে কিস্তিতে ফ্রিজটি কেনেন। দুই বছর মেয়াদী কিস্তিতে নেওয়া ফ্রিজটির এখনও ২২ হাজার ২৭৫ টাকা বাকি রয়েছে বলে জানিয়েছেন মামলার বাদী ও ওয়ালটনের শাখা ব্যবস্থাপক সাগর। তিনি বলেন, দুই মাস আগে মামলা হয়েছে। তাদের কাছে নোটিশ পাঠানো হয়েছিল। এডি রিটার্ন আসছে। তারা হয়তো নোটিশ রিসিভ করেননি। এখন তারা বাকি টাকা পরিশোধ করলে আমরা মামলা তুলে নিবো।’

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত