আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

ভোলায় অগ্রণী ব্যাংকে দুর্নীতির ‘শাস্তি’ পদোন্নতি

ইউনুছ শরীফ, ভোলা
ভোলায় অগ্রণী ব্যাংকে দুর্নীতির ‘শাস্তি’ পদোন্নতি

বিতর্ক পিছু ছাড়ছে না অগ্রণী ব্যাংকের ভোলা জোনাল অফিসের। ঋণ বিতরণে অনিয়ম, ভুয়া ঠিকানার প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ, দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের শাস্তির পরিবর্তে পদোন্নতিসহ বিভিন্ন অভিযোগে জর্জরিত রাষ্ট্রায়ত্ত এই বাণিজ্যিক ব্যাংকের কার্যালয়টি।

এমনকি ঘুষ কারবারে জড়িতদের বিরুদ্ধে কথা বলায় বদলি করা হয় কর্মকর্তাদের। এ অফিসের সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের তথ্য আগেও একাধিক গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে, কিন্তু রহস্যজনক কারণে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

বিজ্ঞাপন

মাস দেড়েক আগে অগ্রণী ব্যাংকের ভোলা জোনাল অফিসের আওতাধীন ভোলা শাখার ব্যবস্থাপক (এজিএম) আলমগীর হোসেনকে বদলি করা হয়েছে। তিনি সুনামের সঙ্গে কর্মরত থাকার পরও তার অস্বাভাবিক বদলি নিয়ে কার্যালয়টিতে চলছে কানাঘুষা। তাকে চট্টগ্রামে স্থানান্তর করে দুর্নীতির প্রতিবন্ধকতা দূর করা হয়েছে বলে অনেকে মন্তব্য করছেন।

ব্যবস্থাপক আলমগীর ঋণ বিতরণে বিভিন্ন অনিয়ম খুঁজে পাওয়ার পর শাখার সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার ও ঋণ বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা মো. জিয়াউদ্দিনকে কারণ দর্শানোর নোটিস (শোকজ) দেন। শোকজের জবাব পাওয়ার আগেই তিনি পেয়েছেন বদলির নোটিস। তাকে চলে যেতে হয়েছে চট্টগ্রাম সার্কেলে। এসবের নেপথ্যে কাজ করেছে ব্যাংকটির বরিশাল সার্কেল ও ভোলা জোনের দুর্নীতিবাজদের চক্র।

এই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে তথ্যপ্রমাণসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে একাধিক বার সংবাদ প্রকাশ হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো, ‘গণমাধ্যমে তথ্য প্রদানকারী’ সন্দেহে সৎ ও ব্যাংকের জন্য নিবেদিত কর্মীদের জোন ও সার্কেলের বাইরে বদলি করে দুর্নীতিবাজ ও ফ্যাসিস্টদের আগলে রাখছেন বরিশাল সার্কেলের জিএম জাহিদ ইকবাল এবং ভোলা জোনাল অফিসের ইনচার্জ গণেশ চন্দ্র দেবনাথ।

একটি ঘটনার অনুসন্ধানে জানা গেছে, গত ২১ ফেব্রুয়ারি ঋণ বিতরণে বেশকিছু অনিয়মের প্রমাণ তুলে ধরে জিয়াউদ্দিনকে শোকজ করেন আলমগীর। যেখানে ‘টি২৪ সফটওয়্যার’ ব্যবহার করে ১২ লাখ টাকা ব্যক্তিগত ঋণ নিয়ে জিয়াউদ্দিন ইন্টারেস্ট রেট শূন্য দেখিয়েছেন। এছাড়া তার বিরুদ্ধে নানা জালিয়াতি ও ঋণ আদায়ে গাফিলতির অভিযোগ প্রমাণ হয়েছে। এ বিষয়ে তাকে সতর্ক করা হলে ক্ষুব্ধ হন জিয়াউদ্দিন ও তার অপকর্মের দোসর ভোলা জোনাল অফিসের কয়েক কর্মকর্তা।

মেসার্স আরোহী ট্রেডার্সের মালিক আবুল কাশেমের আবেদন ছাড়াই ৫০ লাখ টাকার ঋণের নবায়ন করেন জিয়াউদ্দিন। কিন্তু রহস্যজনক এই নবায়নের ঘটনা তদন্ত করে ওই নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাননি আলমগীর। এ কারণে তিনি সেটি অনুমোদন করেননি। এতে জিয়াউদ্দিন সিন্ডিকেটের ক্ষোভ আরো বাড়ে। কেননা এখানে ছিল বড় অংকের লেনদেন। যার ভাগবাটোয়ারার বড় অংশ পেত জোনাল অফিস।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আরোহী ট্রেডার্সের নামে ২০১২ সালের ৩ নভেম্বর অগ্রণী ব্যাংক ভোলা শাখা থেকে ঋণ নেওয়া হয়। কিন্তু কোনো রকম বাণিজ্যিক কার্যক্রম ও প্রাতিষ্ঠানিক প্রমাণ ছাড়াই প্রতি বছর ঋণ নবায়ন করা হচ্ছিল। বিষয়টি নিয়ে আপত্তি জানানোয় আরোহী ট্রেডার্সের মালিক আবুল কাশেমের ছেলে মিজানুর রহমান জিতুর মাধ্যমে আলমগীরের বিরুদ্ধে ভুয়া অভিযোগ করানো হয়।

অভিযোগের তদন্তকারীরা মাঠপর্যায়ে খোঁজখবর না নিয়েই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে আলমগীরকে কাগজে-কলমে অভিযুক্ত করেন এবং তাকে বদলি করা হয়। এরপর জিয়াউদ্দিনকে ঋণ কর্মকর্তা থেকে প্রমোশন দিয়ে শাখার ব্যবস্থাপকের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

জিয়াউদ্দিন আগে ব্যাংকটির চরফ্যাশন শাখায় ম্যানেজারের পদে ছিলেন। তখন তার বিরুদ্ধে ঋণ নেওয়া প্রতিষ্ঠান মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পর যথাসময়ে ঋণ খেলাপি না করা, খেলাপি হওয়া সত্ত্বেও নিয়মিত দেখিয়ে ১৭ লাখ টাকা সুদ চার্জ করা এবং ৩ লাখ টাকা ইন্স্যুরেন্স কাটার অভিযোগ উঠেছিল। সেই ঘটনায় বরিশাল সার্কেলের মহাব্যবস্থাপকের কার্যালয় থেকে ২০২৪ সালে ১২ সেপ্টেম্বর ব্যাখ্যা তলব করা হয়।

জিয়াউদ্দিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ হলে কঠোর প্রসাশনিক ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ভিজিলেন্স ডিভিশনের কঠোর নির্দেশনা থাকলেও ভোলা জোনাল অফিসের ইনচার্জ গণেশ চন্দ্র দেবনাথ এবং ভোলা শাখা ব্যবস্থাপক (বর্তমানে বরিশাল সার্কেল অফিসে কর্মরত) পংকজ কুমার নাথসহ বরিশাল সার্কেল অফিসের কয়েক কর্মকর্তা যৌথভাবে অর্থনৈতিক লেনদেনের মাধ্যমে তাকে রক্ষা করেন।

জিয়াউদ্দিনের বিরুদ্ধে ভুয়া নমিনি সাজিয়ে মৃত অলিয়ার রহমানের হিসাব থেকে সাড়ে সাত লাখ টাকা আত্মসাতেরও অভিযোগ আছে। এ অভিযোগ থেকেও দায়সারা তদন্তের মাধ্যমে অব্যাহতি দেন পংকজ। এছাড়া চরফ্যাশন শাখার মেসার্স বিকাশ স্টোরের বিরুদ্ধে ব্যাংকের পক্ষ থেকে দায়ের করা সিআর মামলাটি তৎকালীন ম্যানেজার জিয়াউদ্দিনের অবহেলায় খারিজ হয়ে যায়। সেজন্য তার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

নানা অনিয়মে জড়িত থাকায় অগ্রণী ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ের ২০২৪ সালের ২১ এপ্রিলের একটি চিঠিতে জিয়াউদ্দিনের বিরুদ্ধে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা থাকলেও ভোলা জোনাল কার্যালয়ের ডিজিএম গণেশ তা পালন করেননি। উল্টো তাকে পদোন্নতি দিয়ে শাখার ম্যানেজার হিসেবে সুপারিশ করেন।

এছাড়া জিয়াউদ্দিনের আরো অসংখ্য অনিয়মের প্রমাণ আছে। তিনি কোনো ধরনের ঋণ না নিয়েই ভোলা শহরের যুগীরঘোলে মুন্সীবাড়ির ভেতর জমি কিনেছেন ২১ লাখ টাকা দিয়ে। ২০১৩ সালের মার্চে চাকরি শুরু করা এই কর্মকর্তার বিপুল অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

বদলির কারণ জানতে চাইলে ভোলা শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক আলমগীর হোসেন বলেন, ‘অগ্রণী ব্যাংক বরিশাল সার্কেল কার্যালয় ও ভোলা আঞ্চলিক কার্যালয়ের ফ্যাসিস্ট ও দুর্নীতিবাজ সিন্ডিকেটের কর্মকর্তারা আমার বিরুদ্ধে কল্পকাহিনি তৈরি করেছে, যার কোনো ভিত্তি নেই।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে তদন্তে আসেন বরিশাল সার্কেল অফিসের এজিএম আজিজুর রহমান। তিনি এসেই ভোলা জোনাল অফিসের ডিজিএম গণেশ চন্দ্র দেবনাথের নির্দেশে শাখার সব কর্মকর্তাকে ডেকে পাঠান এবং আমার বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ জমা দিতে বাধ্য করেন। যেসব কর্মকর্তা লিখিত দিতে চাননি, তাদের বদলি ও ব্যাখ্যা তলবের হুমকি দেওয়া হয়।’

তিনি দাবি করেন, ‘জিয়াউদ্দিনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে বরিশাল সার্কেল অফিসের এজিএম পংকজ কুমার নাথ, এজিএম আজিজুর রহমান, এসপিও এফ এম সাদিকুর রহমান, জিএমের পিএস বঙ্গবন্ধু পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম এবং সাধারণ সম্পাদক দেবাশীষ কুণ্ডের মাধ্যমে নগদ লেনদেন করেন তিনি। তারা সার্কেল অফিসের এজিএম পংকজ কুমার নাথ ও আজিজুর রহমানের সহযোগিতায় আমাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ না দিয়ে ভোলা জোন থেকে চট্টগ্রাম সার্কেল অফিসে বদলি করান।’

হয়রানির শিকার হওয়ার ভয়ে নাম প্রকাশ না করে ওই শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, এই ব্যাংকের কয়েকটি ঘটনায় দেখেছিÑ‘এখানে চোরের কোনো শাস্তি হয় না, যারা চোর ধরিয়ে দেয় তাদেরই শাস্তি হয়’।

অভিযোগের বিষয়ে অগ্রণী ব্যাংক ভোলা জোনাল কার্যালয়ের ডিজিএম গণেশ চন্দ্র দেবনাথ বলেন, ‘আমার ক্ষমতার একটা লিমিটেশন আছে। হেড অফিসের নিয়ম অনুযায়ী সব বদলি ও প্রমোশন হয়েছে। এখানে আমার কিছু করার নেই।’

তার অনিয়ম ও দুর্নীতি এবং দুর্নীতিবাজ অফিসারদের তার প্যানেলে ঢুকানোর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি চমকে ওঠেন এবং বলেন, এসব অভিযোগ অসত্যও হতে পারে।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর
খুঁজুন