রেলের ইঞ্জিন সংকটে স্থবির কন্টেইনার-জ্বালানি পরিবহন

সোহাগ কুমার বিশ্বাস, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ০৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮: ৫৩

কন্টেইনার পরিবহন হয় তিনটি মাধ্যমে। সড়ক পথে সবচেয়ে বেশি কন্টেইনার পরিবহন হলেও রেল ও নৌ পথেও বিপুল পরিমাণ কন্টেইনার পরিবহন হয় প্রতিনিয়ত। কিন্তু সম্প্রতি রেলপথে পণ্য পরিবহন থমকে গেছে।

পাশাপাশি চট্টগ্রামের প্রধান ডিপো থেকে সারাদেশে জ্বালানি তেল পরিবহনের বড় একটি অংশ নির্ভর করে রেলপথের ওপর। সেখানেও তৈরি হয়েছে স্থবিরতা। এই রুটগুলোতে যে পরিমাণ ট্রেনের চাহিদা রয়েছে তা পূরণ করতে পারছে না রেলওয়ে। ফলে বন্দরে কন্টেইনার জটের পাশাপাশি বিভিন্ন এলাকায় জ্বালানি তেলেরও সংকট দেখা দিচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

রেলওয়ে বলছে, ইঞ্জিন সংকটের কারণে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত কন্টেইনার ও জ্বালানি তেল পরিবহন করতে পারছে না তারা। দৈনিক যেখানে ১৩ ইঞ্জিনের চাহিদা রয়েছে সেখানে ২টির বেশি ইঞ্জিন দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এতে উদ্বেগ জানিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর ও বিপিসি।

সম্প্রতি রেলওয়ের করা একটি অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনেও ইঞ্জিন সংকটের এই ভয়াবহতা ফুটে ওঠে। প্রতিবেদনটি আমার দেশ’র হাতে এসেছে। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, চট্টগ্রাম-ঢাকা রুটে কনটেইনার ও তেলবাহী ট্রেন চলাচল সচল রাখতে দৈনিক কমপক্ষে ১৩টি লোকোমোটিভ প্রয়োজন, সেখানে কার্যত চলছে মাত্র দুটি। একটি ইঞ্জিন দেওয়া হয়েছে কনটেইনারবাহী ট্রেনে এবং অন্যটি বিশেষ সেনা সেবা ও জ্বালানি পরিবহনে ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে চট্টগ্রাম বন্দর ও আশপাশের স্টেশনে অন্তত আটটি পূর্ণ কনটেইনার রেক থেমে আছে কোনো ইঞ্জিন ছাড়াই। চট্টগ্রাম বন্দর থেকে রেলপথে পরিবহনযোগ্য প্রায় দেড় হাজার কন্টেইনার জমে আছে বিভিন্ন ইয়ার্ডে। বন্দরে সৃষ্ট কন্টেইনার জটের এটিও একটি কারণ হিসেবে দেখছে রেলওয়ে।

বন্দর সূত্র জানিয়েছে, চট্টগ্রাম বন্দর সচল রাখতে প্রতিদিন অন্তত আড়াই জোড়া অর্থাৎ ৫টি কনটেইনার ট্রেন প্রয়োজন। কিন্তু লোকোমোটিভের সংকটে বর্তমানে উভয় দিকে একটি করে মাত্র দুটি ট্রেন চলাচল করছে। এতে একদিকে যেমন চট্টগ্রাম বন্দরে জট তৈরি হচ্ছে অন্যদিকে কমলাপুর আইসিডির সক্ষমতা অপচয় হচ্ছে। রেলের এই সংকট অব্যাহত থাকলে বন্দরে ইয়ার্ডজট আরো তীব্র হবে এবং লজিস্টিক খরচ বেড়ে যাবে। যা শেষ পর্যন্ত ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দামে প্রভাব ফেলবে।

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুখ জানান, রেলপথে পণ্য পরিবহনের চাহিদা ও সম্ভাবনা আছে অনেক। কিন্তু সেবার মান নিশ্চিত করতে না পারায় নষ্ট হচ্ছে সম্ভাবনা। দৈনিক যেখানে পাঁচটি ট্রেনের চাহিদা রয়েছে সেখানে গড়ে একটি করেও বরাদ্দ মিলছে না। এতে কমলাপুর আইসিডিগামী কন্টেইনারের স্থিতি বাড়ছে। ইঞ্জিন বরাদ্দ চেয়ে রেলওয়েকে বারবার চিঠি দিয়েও সুফল আসছে না।

বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক সহ-সভাপতি খন্দকার বেলায়েত হোসেন জানান, এক দিনের দেরিতে একটি রপ্তানি অর্ডার বাতিল হতে পারে। অথবা বায়ারের পক্ষ থেকে এয়ারশিপমেন্টের তাগিদ আসতে পারে। যা অনেক শিল্প কারখানা মালিকের জন্য বহন করা সম্ভব হবে না। কনটেইনারগুলো বন্দরের ইয়ার্ডে স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি দিন পড়ে থাকায় তাদের অতিরিক্ত গুদাম ভাড়া গুনতে হচ্ছে। তাই সরকারের উচিত যে কোনো মূল্যে বন্দরকেন্দ্রিক সার্ভিস নির্বিঘ্ন রাখা। বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত লোকোমোটিভ সরবরাহ না করা হলে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

বিপিসি সূত্র জানায়, আগস্ট মাসে মোট লোকমোটিভের চাহিদা ছিল ৩০টি। বিপরীতে রেলওয়ে সরবরাহ করেছে মাত্র ১০টি। এর মধ্যে সিলেট রুটে ১১টির চাহিদার বিপরীতে পাওয়া গেছে মাত্র ২টি। শ্রীমঙ্গলে ৭টির চাহিদা ছিল কিন্তু মিলেছে ৩টি, রংপুরে ৭টির চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা হয়েছে ২টি। ঢাকায় ৫টির স্থলে ৩টি ইঞ্জিন দিয়েছে রেলওয়ে। পর্যাপ্ত ইঞ্জিন না পাওয়ায় সিলেট ও শ্রীমঙ্গলে ভৈরব ডিপো থেকে তেল সরবরাহ করতে হয়েছে। রংপুরে বাঘাবাড়ি ডিপো থেকে আর ঢাকায় গুদনাইলঘাট ও ফতুল্লা ডিপো থেকে সড়কপথে জ্বালানি সরবরাহ করা হয়েছে। এতে বাড়তি খরচ গুনতে হয়েছে বিপিসির।

বিপিসির মার্কেটিং বিভাগের জিএম জাহেদ হোসেন জানান, রেলের লোকমোটিভ সংকটে জ্বালানি তেল পরিবহনে বিপর্যয় নেমেছে। চাহিদার তিনভাগের এক ভাগও লোকমোটিভ সরবরাহ করতে পারছে না রেলওয়ে। যেগুলো দেওয়া হয় সেগুলোরও সক্ষমতা একেবারেই কম। তাই সময়মতো জ্বলানি গন্তব্যে পৌঁছাচ্ছে না। ফলে বিকল্প উপায়ে জ্বালানির যোগান দিতে গিয়ে ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি শৃঙ্খলাও ভেঙে পড়ছে।

ইঞ্জিন সংকটের বিষয়টি স্বীকার করে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের জিএম মোহাম্মদ সুবক্তগীন জানান, নিয়মিত মেরামতের প্রয়োজনে অনেক ইঞ্জিন সার্ভিস থেকে বাদ পড়েছে। বিপরীতে যাত্রীবাহী ট্রেনের চাপ বেড়েছে। ফলে কন্টেইনার ও জ্বালানি তেল পরিবহনে চাহিদা অনুযায়ী লোকমোটিভ সরবরাহ করা আপাতত সম্ভব হচ্ছে না। দ্রুত সময়ের মধ্যে অন্তত দুটি ইঞ্জিন যোগ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া চলতি বছরের মধ্যে নতুন কয়েকটি ইঞ্জিন আসার কথা রয়েছে। এগুলো এলে সংকট কেটে যাবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত