ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৫০ শয্যাবিশিষ্ট নবীনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ডাক্তার, নার্স ও ওষুধ সংকটসহ নানা অব্যবস্থাপনার কারণে সেবাবঞ্চিত হচ্ছেন হাজারো রোগী।
সরেজমিনে হাসপাতালে দেখা গেছে, সকাল সাড়ে দশটার দিকে ডাক্তারের চেম্বারের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন নবীনগর ও পার্শ্ববর্তী রায়পুরা উপজেলা থেকে আসা শতশত রোগী। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করে চিকিৎসা শেষে হাসপাতালের ফার্মেসি থেকে সরকারি ওষুধ না পেয়ে হতাশ হয়ে চলে যাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ ডাক্তারের চিকিৎসাপত্র নিয়ে বাজারের বিভিন্ন ফার্মেসিতে ছুটছেন।
হাসপাতালের দুতলার সিঁড়িতে উঠতেই ময়লা আবর্জনা ও ধুলাবালি চোখে পড়লো। দুতলার একটি রুমে শিশুদের চিকিৎসা দিচ্ছেন ডাক্তার ফাহিম। চেম্বারের সামনে অর্ধশত নারী তাদের সন্তানদের নিয়ে বেঞ্চে বসে আছেন। পাশের রুমে রক্ত পরীক্ষার ল্যাব, এই জায়গাতেও ধুলাবালি ও বিভিন্ন পুরোনো কাগজ পড়ে আছে। ওয়ার্ডগুলো তেমনভাবে নেই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা। জরুরি বিভাগের সামনেও তেলাপোকা ও ধুলাবালি দেখা গেছে। হাসপাতালের সামনে ময়লা আবর্জনা ও পানি জমে জন্ম নিচ্ছে মশা। হাসপাতালের সেফটিক টাংকি গাড়ির চাপে ভেঙে যাওয়ার কারণে বের হচ্ছে দুর্গন্ধ। এসবের মধ্য দিয়েই চলছে চিকিৎসাসেবা।
ফাতেমা বেগম নামে এক শিশুর মা বলেন, টাকার অভাবে শিশুকে নিয়ে প্রায় ৫ কিলোমিটার দূর থেকে সরকারি হাসপাতালে এসেছি চিকিৎসা করাতে ও ওষুধ নিতে, ডাক্তার সাব শুধু ওষুধ লিখে দিয়েছে, সরকারি কোনো ওষুধ দেয়নি। ফ্রি ওষুধ নেই বলেও জানিয়েছে। যে ওষুধ লিখে দিয়েছে তা কেনার মতো টাকা আমার কাছে নেই, তাই ফিরে যাচ্ছি।
নবীনগর পৌর এলাকার বাছির মিয়া বলেন, চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রে পাঁচটি ওষুধ লিখে দিয়েছেন, হাসপাতালের ফার্মেসি থেকে শুধুমাত্র পাঁচটি প্যারাসিটামল দিয়েছে। বাকি ওষুধ চাইলে কাউন্টার থেকে বলে, সরবরাহ নেই। সরকারি হাসপাতালে রোগীদের পর্যাপ্ত চিকিৎসা না দিয়ে তাদের বেসরকারি হাসপাতালে রেফার করেন এবং যেতে উৎসাহিত করেন। এছাড়াও অনেক সময় ডাক্তাররা তাদের কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন, যার ফলে রোগীদের দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হচ্ছে এবং সঠিক সময়ে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক রোগী জানান, ডাক্তাররা সকাল ১০টার পর চেম্বারে আসেন। এরমধ্যে রয়েছে ডাক্তারদের অনুপস্থিতি, অব্যবস্থাপনা, নিম্নমানের খাবার, সরঞ্জাম এবং ঔষধের অভাব। সেই সাথে আছে ওষুধ ক্রয়সহ বিভিন্ন দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি। এসব কারণে হাসপাতালের সেবার মান দিনদিন কমে যাচ্ছে এবং রোগীদের বেসরকারি হাসপাতালে যেতে উৎসাহিত করছে। এসকল বিষয়ে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।
এসব বিষয়ে জানতে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. কিশলয় সাহাকে প্রশ্ন করার সময় অনেকটা বিরক্তি প্রকাশ করে বলেন, আমি বিভিন্ন ক্যাডারে কাজ করেছি, ডাক্তার হয়েছি বলে ভয় পাবো, বিষয়টি এমন নয়। গত কয়েকদিন ধরে আমার বিরুদ্ধে ফেসবুকে বিভিন্ন লেখালেখি শুরু হয়েছে। এই সকল লেখার পেছনে কে রয়েছে সেটাও আমি জানি।
লেখালেখি করে আমাকে বদলি করা যাবে না। সরকারের একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আমাকে এখানে বসিয়েছেন।
এ সময় তিনি অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ৫০ শয্যা এই স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিতে প্রতিদিন গড়ে ১২০০ থেকে ১৫০০ রোগী আসে। রোগী ভর্তি হওয়ার কথা ৫০ জন, কিন্তু ভর্তি থাকে ১০০ থেকে ১২০ জন। ডাক্তার থাকার কথা ৪১ জন, আছে ১৮জন, নার্স থাকার কথা ৩৩ জন আছে ১৮ জন,
এতো রোগী সামাল দিতে ডাক্তারদের হিমশিম খেতে হচ্ছে এবং হাসপাতালে চাহিদা অনুযায়ী ওষুধের বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না।
তিনি আরও বলেন, হাসপাতালের বিভিন্ন ল্যাব থেকে আয় হওয়া ৫৭ লাখ টাকা সরকারের কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে । হাসপাতালের জনবল সংকটের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবগত করা হয়েছে এবং ঔষধ ক্রয় করার জন্য টেন্ডার আহবান করা হয়েছে। আশা করি দ্রুত সংকটের সমাধান হবে। হাসপাতালের ভিতর ও বাইরে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে আমরা আরও সচেতন হবো। হাসপাতালের নিজস্ব জেনারেটর আছে, কিন্তু জ্বালানি তেলের বরাদ্দ না থাকায় চালাতে পারছি না।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাজীব চৌধুরী বলেন, হাসপাতালের ভিতর ও বাইরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা এবং ওষুধ বিতরণে কোনো অবহেলা থাকলে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। জনবল সংকটের বিষয়ে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। আমরা চেষ্টা করছি নতুন জনবল পাওয়ার জন্য।

