নিভে যাওয়ার আগে যে আলো জ্বেলে দিলেন দুই বীর

জমির উদ্দিন, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ১৫: ০৭
আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ১৫: ৫৪

কিছু মৃত্যু হয় প্রচণ্ড শব্দে-বুলেট, বিস্ফোরণ বা চিৎকারে। আবার কিছু মৃত্যু হয় খুব নিঃশব্দে কিন্তু কাঁপিয়ে দেয় ভেতরটা। সেনা কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট তানজিম সারোয়ার নির্জন এবং পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন এমনই দুই নিঃশব্দ বিস্ফোরণ।

বিজ্ঞাপন

তাদের মৃত্যু শুধু দায়িত্ব পালনের গল্প নয় এক মানবিকতার চূড়ান্ত সৌন্দর্য। যেখানে নিজের জীবন চলে যায় তবু আরেকজন বেঁচে থাকে।

সেনাবাহিনীর ৪০ মিনিটের ডকুমেন্টারির অনির্বাণে এমন দুটি বাস্তব গল্প মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে গেছে।

গত শুক্রবার রাত ৯টায় এই ডকুমেন্টারি প্রকাশ করে সেনাবাহিনী।

তানজিম: গুলি করতে পারতেন, করলেন না। ছুটে গিয়ে ধরলেন, প্রাণ দিলেন।

কক্সবাজারের চকরিয়ার মাইজপাড়া পাহাড়ঘেরা এক গ্রাম। ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪ রাত তখন গভীর। ডাকাতি ঠেকাতে সেনা-পুলিশের অভিযানে নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তানজিম সারোয়ার নির্জন। বয়স মাত্র ২৩। সামনে ডাকাতদল, হাতে অস্ত্র কিন্তু নির্দেশ স্পষ্ট ‘কোনোভাবেই গুলি নয়, ঘনবসতি এলাকা। একজন সাধারণ মানুষও যেন ঝরে না যায়।

ডাকাতেরা পালিয়ে যাচ্ছিল। দুই দিক দিয়ে ঘেরাও করে ফেলেছে বাহিনী। তানজিম দূর থেকে লক্ষ্য করেন, দুইজন পালানোর চেষ্টা করছে। তবুও তিনি গুলি করেন না। ছুটে যান, খালি হাতে ধরে ফেলেন একজনকে।

ঠিক সেই মুহূর্তেই ছুরি বের করে দেয় ডাকাত। তানজিমের মাথায়, ঘাড়ে একের পর এক ছুরিকাঘাত। চারপাশে আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ে। আলোর মানুষটা নিভে যেতে থাকেন।

তার সহযোদ্ধারা বলেন, তিনি চাইলে গুলি করতে পারতেন, কিন্তু তিনি জানতেন-সামনে মানুষ আছে। তার কাছে জীবন নেওয়ার চেয়ে জীবন বাঁচানোই বড় ছিল।

তানজিমের মৃত্যুতে শুধু একটা অপারেশন শেষ হয়নি, মনে হচ্ছিল, যেন একটা আলো নিভে গেল। কিন্তু ওই নিভে যাওয়া আলোর ছায়ায় এখনও অনেক মানুষ কাঁদে, ভেবে নেয়- আমার জায়গায় আমি কী করতাম?

পাহাড়ে মৃত্যুর মুখে পড়ে বলেছিলেন: ‘আমার অস্ত্রটা নিয়ে চলে যা, আমি থাকব...’

‘অনির্বাণ’ প্রামাণ্যচিত্রের আরেকটি গল্প যেন দম বন্ধ করে দেয়। ঘটনাটি ১২ মার্চ ২০৩ সালের। পাহাড়ি এলাকায় বন্যা। তারপর ডায়রিয়ায় আক্রান্ত গ্রামের মানুষের চিকিৎসা দিতে গিয়েছিলেন সেনাবাহিনীর একটি দল। চিকিৎসাসেবা শেষে ফেরার পথে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের অতর্কিত হামলা।

বুলেট ছুটে আসে অন্ধকার পাহাড় চিরে। মাস্টার ওয়ারেন্ট অফিসার নাজিম উদ্দিন গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে যান।

আরেকজন সহযোদ্ধা কাছে গিয়ে ধরেন তাকে। গোলাগুলির মধ্যেও কণ্ঠ শোনা যায়, ‘তুই শোন... আমি যেতেই পারব না... আমার অস্ত্রটা নিয়ে যা, যেন ওদের হাতে না পড়ে।

অস্ত্রটা নিজের জীবনের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। নিজেকে ফেলে রেখে অস্ত্র তুলে দেন সহযোদ্ধার হাতে। আরও একবার বলেন, ‘তুই চলে যা, আমি থাকব। আমাদের কাজ শেষ হয়নি।

এমন মৃত্যু আসলে মৃত্যু নয়। এ এক জীবন্ত দায়িত্ব, যেটা পরের সহযোদ্ধার কাঁধে সরে যায়। যেমন আলো এক হাতে নিভে গিয়ে আরেক হাতে জ্বলে উঠে। তানজিম কিংবা পাহাড়ে নিহত সেনা কর্মকর্তা নাজিম তারা কেউই যুদ্ধ করতে যাননি। তারা ডাকাতি ঠেকাতে, অসুস্থদের চিকিৎসা দিতে গিয়েছিলেন। তবুও ফিরে আসেননি। তাদের হাতে ছিল অস্ত্র, কিন্তু তারা অস্ত্রের নয়, আন্তরিকতার সৈনিক ছিলেন।

লেফটেন্যান্ট তানজিম সারোয়ার বাড়ি টাঙ্গাইলে। তিন বেতকা গ্রামের সারোয়ার জাহান ওরফে দেলোয়ারের ছেলে। পাবনা ক্যাডেট কলেজ থেকে তিনি উচ্চমাধ্যমিক পাস করেন। তানজিম ৮২তম দীর্ঘমেয়াদি কোর্সে ২০২২ সালে বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমি থেকে আর্মি সার্ভিস কোরে (এএসসি) কমিশনড লাভ করেন।

একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে বাবা সারোয়ার জাহান এখনো শোকে পাথর। মা নাজমা বেগম বলেন, ছেলেকে যুদ্ধের মাঠে পাঠাইনি, মানুষ বাঁচাতে পাঠিয়েছিলাম। সে নিজের কথা না ভেবে বাঁচাতে গিয়েছিল আরেকজনকে।

৪০ মিনিটের সেনাবাহিনীর প্রামাণ্যচিত্র ‘অনির্বাণ’ শুধু ভিডিও নয়, এটি এক নীরব শোকগাথা। তানজিমের অপারেশনের ভিডিও দেখা যায়, যেখানে চারপাশে অন্ধকার, গলা মাইক দিয়ে বলা হচ্ছে, ‘সতর্ক থাকুন, সেনাবাহিনী ঘিরে ফেলেছে।’ তারপর দেখা যায় দ্রুতগতিতে ছুটে যাওয়া সেনা সদস্যরা, আর পরের মুহূর্তেই নিথর পড়ে আছেন একজন-তানজিম।

পাহাড়ি অভিযানের দৃশ্যেও একই রকম কাঁপুনি। সহকর্মীর কাঁধে উঠে যাচ্ছে একটি অস্ত্র, নিচে পড়ে রইলেন আহত সেই সৈনিক। ক্যামেরা তার মুখে যায় না, কিন্তু চোখের কোণে আটকে থাকা শেষ চাহনিটা বোঝা যায়।

সেনাবাহিনীর প্রামাণ্যচিত্র ‘অনির্বাণ’ দেখেছেন চট্টগ্রামের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী। এই ৪০ মিনিটের ডকুমেন্টারিতে দুই সেনা সদস্য-তানজিম ও নাজিমের আত্মত্যাগের দৃশ্য দেখে তাদের অনেকে আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। তারা বলছেন, এই গল্প সেনাবাহিনীর নয়-মানবতার গল্প।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আতিকুর রহমান বলেন, তানজিমের ঘটনাটা আমি দেখেছি রাত ২টার দিকে। ঘর অন্ধকার ছিল, মোবাইলের আলোয় ভিডিও দেখছিলাম। যখন তিনি গুলি না করে খালি হাতে ধরতে গিয়েছিলেন-আর তৎক্ষণাৎ ছুরিকাঘাতে মারা যান, আমি এক মুহূর্তের জন্য নিশ্বাস নিতে ভুলে গিয়েছিলাম। মনে হলো, ‘এই দেশে এমন মানুষও আছে!’ এটা শুধু ডকুমেন্টারি না, আত্মার গায়ে হাত রেখে যাওয়া কিছু দৃশ্য।

প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র সজিব ওয়াজেদ বলেন, আমি অনেক সিনেমা দেখি, কিন্তু ‘অনির্বাণ’ দেখার সময় মনে হচ্ছিল এটা কোনো কল্পকাহিনি না, একটা বাস্তবতা, যা আমি জানতাম না। পাহাড়ে মৃত্যুর আগে এক অফিসার যেভাবে অস্ত্র দিয়ে বললেন ‘তুই চলে যা’ ওই জায়গাটা একদম কাঁপিয়ে দিয়েছে। এই সেনারা যুদ্ধ করতে যায়নি, কিন্তু সত্যিকারের বীরের মতো বিদায় নিয়েছে। আমি এখন জানি, বীরত্ব মানে শুধু বন্দুক না, মানুষকে বাঁচাতে জীবন দিয়ে দেওয়ার নামও বীরত্ব।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত