কফি শপের আড়ালে জমজমাট মাদকের আড্ডা

এম হাসান, কুমিল্লা
প্রকাশ : ০৯ জুলাই ২০২৫, ২৩: ০০

কুমিল্লা শহরের প্রাণকেন্দ্র গোমতী নদীর পাড় ঘিরে গড়ে উঠেছে অর্ধ শতাধিক চা ও কফি শপ। দিনের বেলা বন্ধ থাকলেও সন্ধ্যার পর এসব দোকানে জমে ওঠে আড্ডা। চা-কফির আড়ালে চলে ইয়াবা, গাঁজাসহ নানা ধরনের মাদকদ্রব্যের বেচাকেনা।

ফলে শহরের সৌন্দর্যবেষ্টিত এই এলাকাটি এখন মাদক সেবন ও বাণিজ্যের এক বিপজ্জনক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। যা ঝুঁকিতে ফেলছে স্থানীয় তরুণ ও যুবকদের ভবিষ্যৎ।

বিজ্ঞাপন

স্থানীয় সূত্র অনুযায়ী, আমতলী থেকে বিবিরবাজার স্থলবন্দর পর্যন্ত ১২ কিলোমিটার সড়কজুড়ে গড়ে উঠেছে এসব অবৈধ দোকান। এখানে প্রতিদিন কোটি টাকার বেশি মাদক বেচাকেনা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। সন্ধ্যা নামার পর থেকেই নদীর পাড়ে ভিড় জমে বাইকার, তরুণ-তরুণীদের। বাইক পার্ক করে তারা চলে যায় নদীর চরে, যেখানে নির্জন পরিবেশে চলে মাদক সেবন।

অবাধে মাদক বাণিজ্য চললেও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সাবেক কাউন্সিলর কাজী গোলাম কিবরিয়া অভিযোগ করে বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণির সদস্য মাদক ব্যবসায়ীদের চেনে, কিন্তু টাকার বিনিময়ে তাদের ছেড়ে দেয়। একটা চক্র গড়ে উঠেছে। কুমিল্লার গোমতী পাড় মাদকের নিরাপদ রুটে পরিণত হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তরুণ বলেন, আমি বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে যাই। আমার দুই বন্ধু দুটি সিগারেট কেনে ৬০০ টাকায়। এত টাকায় সিগারেট কেনার বিষয় জানতে চাইলে তারা জানায়, সেগুলো আসলে মাদক ছিল।

পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও সেনাবাহিনী মাদক নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে স্থানীয়রা। গত ২৯ জুন, সেনাবাহিনীর একটি অভিযানে আদর্শ সদর উপজেলার শুভপুর গোমতী নদীর পাড়ের একটি চা দোকান থেকে ৩০ লাখ টাকা নগদ ও ৩ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। আটক করা হয় মো. রিয়াজ (৪০) নামের এক যুবককে। একটা দোকানে এত পরিমাণ মাদক পাওয়ায় মাদকের বিস্তৃতির বিষয়টা সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়।

Drug 2

কুমিল্লা জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, এপ্রিল মাসে মাদক সংশ্লিষ্ট ১৪৮টি এবং মে মাসে ১৮৬টি মামলা দায়ের হয়েছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরও গত দুই মাসে ২৩০টি মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করে ৪০ জনকে আটক করেছে, করা হয়েছে ৩৩টি মামলা। তারপরও থামছে না মাদকের কারবার।

গোপন সূত্রে জানা গেছে, প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় এসব দোকান পরিচালিত হওয়ায় অভিযান চালাতে হিমশিম খাচ্ছে পুলিশ। অভিযানে কেবল কিছু ছোট-খাটো ব্যবসায়ী ধরা পড়লেও মূল হোতারা থেকে যাচ্ছে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।

গোয়েন্দা তথ্যমতে, কুমিল্লার গোলাবাড়ি ও বিবিরবাজার এলাকাকে মাদক চোরাচালানের অন্যতম রুট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। ভারত থেকে সীমান্ত পেরিয়ে মাদক প্রবেশ করছে এসব পথ দিয়ে। কুমিল্লার পাঁচটি উপজেলা ভারতের সীমান্তঘেঁষা হওয়ায় চোরাচালান রোধে বাড়তি নজরদারির প্রয়োজন বলে মনে করে স্থানীয়রা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক যুবক বলেন, পুলিশকে তথ্য দিলে ব্যবসায়ীরা জেনে যায়। সাংবাদিকদের কিছু বললেও বিপদ হতে পারে। মাদক নিয়ন্ত্রণকারীদের অনেকেই রাজনৈতিক নেতাদের ঘনিষ্ঠ। যখন যে রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে, তখন সেই দলের নেতাদের প্রশ্রয়ে চলে এই মাদক ব্যবসা।

কুমিল্লা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক রফিকুল ইসলাম বলেন, আমি কুমিল্লায় নতুন এসেছি। গোমতীর পাড়ের মাদক সংক্রান্ত তথ্য প্রথম আপনার কাছ থেকেই শুনলাম। এ ব্যাপারে দ্রুত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

কোতোয়ালি থানার ওসি মহিনুল ইসলাম বলেন, মাদকবিরোধী অভিযান আমাদের নিয়মিত কাজ। মাদকের সঙ্গে জড়িতদের যেই হোক, আইনের আওতায় আনা হবে।

কুমিল্লা বিজিবি সেক্টর কমান্ডার কর্নেল রেজাউল করিম জানান, গত এক বছরে বিজিবি কুমিল্লা অঞ্চলে ১১ কোটি টাকার মাদক জব্দ করেছে। সীমান্তের ৩২৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বিজিবির কড়া নজরদারি রয়েছে।

অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রাশেদুল হক চৌধুরী আমার দেশকে বলেন, ভাসমান দোকানে মাদক বিক্রি সংক্রান্ত অভিযোগ তদন্ত করা হবে। আমাদের টহল টিম নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছে।

সচেতন নাগরিকদের দাবি, কেবল প্রশাসনিক উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে হলে প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন। এর জন্য অভিভাবক, শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি এবং গণমাধ্যমকে একযোগে কাজ করতে হবে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত