জাহাজ জট কমাতে গিয়ে কন্টেইনার জটের ফাঁদে চট্টগ্রাম বন্দর

সোহাগ কুমার বিশ্বাস, চট্টগ্রাম
প্রকাশ : ২১ আগস্ট ২০২৫, ০৯: ৩৪

বহির্নোঙ্গরে জাহাজের জট কমাতে গিয়ে এবার কন্টেইনার জটের ফাঁদে পড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। জট নিরসনে নিলামযোগ্য কন্টেইনার দ্রুত নিলামের তাগিদ দেওয়ার পাশাপাশি আমদানি করা কন্টেইনার বন্দরের ইয়ার্ডে ফেলে না রেখে এক দিনের মধ্যে অফডকে নিয়ে যাওয়ার নির্দেশনাসহ নানামুখী উদ্যোগ নিয়েও হালে পানি পাচ্ছে না বন্দর কর্তৃপক্ষ।

সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী ৫৩ হাজার ৫১৮ টিইইউএস কন্টেইনার ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন বন্দরের ইয়ার্ডগুলোতে বুধবার কন্টেইনারের পরিমাণ ছিল ৪৭ হাজার ৪৬৩ টিইইউএস। অপারেশন স্বাভাবিক রাখতে ২০ থেকে ২৫ শতাংশ জায়গা খালি রাখতে হয়। সেই হিসেবে কন্টেইনারের পরিমাণ ৪৫ হাজার ছাড়ালেই জট হিসেবে মনে করা হয়। স্বাভাবিক সময়ে এই কন্টেইনারের পরিমাণ থাকে ৩২ থেকে ৩৫ হাজারের মধ্যে।

বিজ্ঞাপন

বন্দর সূত্র জানায়, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ দুই বছর ডলার সংকটে আমদানির গতি কমে যায়। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার কয়েক মাসের মধ্যে এই সংকট কাটতে শুরু করে। ব্যাংকগুলোতে এলসি খোলায় বাড়তে থাকে আমদানির পরিমাণ। এতে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমায় কন্টেইনারবাহী জাহাজের সংখ্যা বেড়ে যায় অস্বাভাবিকভাবে। বন্দরের পরিসংখ্যান বলছে, গত এপ্রিল মাসে জাহাজ এসেছিল ১২২টি, মে মাসে ১২৬টি, জুনে ১১৩টি ও সর্বশেষ জুলাইতে ১২৬টি কন্টেইনারবাহী জাহাজ নোঙ্গর করেছে বন্দরের বিভিন্ন জেটিতে। আগের সরকারের সময় যার পরিমাণ থাকত ১০০ থেকে ১০৫টির মধ্যে।

জাহাজের সংখ্যা বাড়লেও সে অনুযায়ী বার্থিং সুবিধা নেই বন্দরের জেটিতে। ফলে বহির্নোঙ্গরে জাহাজের জট বাড়তে থাকে। সংকট সমাধানে আগে যেখানে একসঙ্গে ১০টির বেশি জাহাজকে বার্থিং দেওয়া হতো না এখন সেখানে ১৩টি পর্যন্ত জাহাজ বার্থিং দেওয়া শুরু করে বন্দর কর্তৃপক্ষ। ফলে জাহাজের টার্ন এরাউন্ড টাইম ৪ দিনের পরিবর্তে নেমে আসে ২ দিনে।

কিন্তু জাহাজ থেকে যে গতিতে কন্টেইনার নামতে থাকে সেই গতিতে কন্টেইনার ডেলিভারি করা সম্ভব হয়নি। ফলে বন্দরের অভ্যন্তরে জট বাড়তে থাকে কন্টেইনারের। ধীরে ধীরে তা ধারণক্ষমতা ছাড়িয়ে যেতে শুরু করেছে। তাই এই মুহূর্তে সংকট নিরসনে বেশকিছু যৌথ পদক্ষেপ নিয়েছে বন্দর ও এনবিআর। এর মধ্যে জাহাজ থেকে নামার দিনই অফডকগামী কন্টেইনার নিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা অন্যতম। আগে যেখানে আমদানির প্রথম ৪ দিন পর্যন্ত বিনা শুল্কে কন্টেইনার রাখা যেত বন্দরের অভ্যন্তরে। আর এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ধীরে ডকুমেন্টেশনসহ দাপ্তরিক কাজ শেষ করে কন্টেইনার নিয়ে যেত আমদানিকারক ও অফডক কর্তৃপক্ষ।

চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব ওমর ফারুখ জানান, আগে একসঙ্গে ১০টি জাহাজ থেকে কন্টেইনার আনলোড করা হতো। এখন ১৩টি জাহাজ থেকে কন্টেইনার নামছে। ফলে ইয়ার্ডে কন্টেইনারের স্থিতি কিছুটা বাড়ছে। কন্টেইনার ডেলিভারি গতিশীল করতে বেশকিছু উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। শিগগির জট নিরসন হবে বলে জানান তিনি।

অফডক মালিকদের সংগঠন বিকডার সেক্রেটারি রুহুল আমিন শিকদার বিপ্লব জানান, প্রথম একদিন ও পরে দুই দিনের মধ্যে অফডকগামী কন্টেইনার নিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তিন দিনের আগে দাপ্তরিক কাজ শেষ করা কঠিন। বন্দরে থাকা ৪৮ হাজারের বেশি কন্টেইনারের মধ্যে অফডকগামী কন্টেইনার থাকবে সর্বোচ্চ ৫ হাজার। বাকি কন্টেইনার সাধারণ আমদানিকারকদের। দুই দিনের মধ্যে কন্টেইনার ডেলিভারি নেওয়ার এই নির্দেশনা শুধু অফডক কর্তৃপক্ষের বিপরীতে সবার প্রতি জারি করা হলে সুফল বেশি আসত।

চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ জানান, বন্দরে আসা ৭০ শতাংশ কন্টেইনারের গন্তব্য থাকে রাজধানী ঢাকা। যার অন্তত ৭৫ শতাংশই পরিবহন হয় সড়কপথে। বাকিটা রেল ও নৌ-পথে। তাই ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি, রেলের সেবা বাড়ানো ও নৌপথে কন্টেইনার পরিবহন সহজীকরণ করতে একটি প্যাকেজ উদ্যোগ না নিলে বন্দরে পণ্য হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বাড়লেও তাতে সুফল আসবে না খুব একটা। বরং এখনকার মতো জটের কবলে পড়ে স্থবিরতা নামবে জাতীয় অর্থনীতিতে।

চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক পরিকল্পনা ও প্রশাসন বিভাগের পরিচালক বন্দর বিশেষজ্ঞ জাফর আলম জানান, বন্দরের ১০ হাজারের বেশি নিলামযোগ্য ও ৩ শতাধিক ধ্বংসযোগ্য কন্টেইনার রয়েছে। এছাড়া চিহ্নিত কিছু আমদানিকারক বছরের পর বছর ধরে বন্দরকে গুদাম হিসেবে ব্যবহার করে। অর্থাৎ সামান্য স্টোররেন্ট দিয়ে ধীরে ধীরে পণ্য খালাস করে। এই চক্রকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া গেলে বর্তমান অবকাঠামোতেই আরো ২০ থেকে ৩০ শতাংশ খালি করা সম্ভব। এজন্য প্রয়োজন আন্তরিক সদিচ্ছা।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত