চট্টগ্রামের রাউজান উপজেলার কদলপুর ইউনিয়নজুড়ে আবারও আতঙ্কের নাম ডাকাত আলম। একজন ভয়ংকর অস্ত্রধারী ডাকাত থেকে রাজনৈতিক আশ্রয়ে রক্ষা পাওয়া এই আলম একসময় আওয়ামী লীগের সাবেক স্থানীয় সংসদ সদস্য ফজলে করিম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছিলেন। সময়ের পালাবদলে তিনি এখন বিএনপির এক প্রভাবশালী নেতার ‘ডানহাত’ হয়ে এলাকায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করছেন।
নতুন রাজনৈতিক ছাতার নিচে আলম পুনরায় শক্তিশালী হয়ে উঠেছে- এমন অভিযোগ স্থানীয়দের। তার রয়েছে ২২ সদস্যের একটি সংগঠিত বাহিনী, যাদের হাতে বৈধ-অবৈধ ভারী অস্ত্র, আধুনিক যোগাযোগ সরঞ্জাম এবং গোটা এলাকায় ছড়ানো নজরদারি ব্যবস্থার দাপট।
স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, আলম বাহিনীর হাতে কমপক্ষে একটি একে-৪৭, তিনটি শটগান, নয়টি শাটার, দুটি তুর্কি বন্দুক রয়েছে। এর মধ্যে একটি বন্দুক আজিজ বসের এবং অন্যটি শওকত মেম্বারের। এ দুজনই অতীতে আওয়ামী লীগ রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তাদের সঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ছবি রয়েছে। আবার চারটি ভারতীয় ৭.৬ এমএম পিস্তলও রয়েছে বাহিনীটির কাছে। আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য, বাহিনীটির কাছে প্রায় ৩০–৩৫টি বাংলা বন্দুক রয়েছে, যেগুলো লুকিয়ে রাখার জন্য স্থানীয় এলাকার অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশুদের ব্যবহার করা হয়।
নিরাপত্তার অংশ হিসেবে বাহিনীর কাছে চারটি পুলিশি মানের বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটও রয়েছে। শুধু তাই নয়, পাঁচ কিলোমিটার এলাকা কাভার করতে সক্ষম ছয়টি ওয়াকিটকি সেট ব্যবহার করে তারা নিয়মিত যোগাযোগ রাখে। রাউজানের পাহাড়তলী মোড়ে স্থাপিত সিসিটিভি ক্যামেরার ভিডিও ফিড সরাসরি আলমের মোবাইলে দেখা যায়। ফলে এলাকাজুড়ে কে কোথায় চলাফেরা করছে, এমনকি পুলিশি গতিবিধিও দ্রুত জানতে পারে আলম ও তার বাহিনী।
রাউজানে সম্প্রতি একটি ভিডিও ভাইরাল হয়ে এলাকায় ব্যাপক চাঞ্চল্য তৈরি করেছে। ভিডিওটি ধারণ করা হয়েছে পাশের একটি বাড়ির বারান্দা থেকে, যেখানে স্পষ্টভাবে দেখা যায় ডাকাত আলমের ঠিক পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে অন্তত পাঁচজন অস্ত্রধারী। তাদের কারও হাতে দেশি শটগান, কারও হাতে শাটার বন্দুক, আর এক যুবককে দেখা যায় দেহজুড়ে কালো পোশাক পরে ছাতা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে। কিন্তু সবচেয়ে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে আরেকজনের দৃশ্য। তার হাতে ঝুলছে একটি একে-৪৭ ধাঁচের আধুনিক রাইফেল, যা নিয়ে সে আলমের সঙ্গে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে হাঁটাহাঁটি করছে।
ভাইরাল হওয়া ভিডিওটিতে আলমকে কেন্দ্র করে এমন সশস্ত্র প্রদর্শন যে নির্ভীকভাবে করা হয়েছে, তাতে স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক আরও বেড়েছে। ভিডিও প্রকাশের পর থেকেই গ্রামবাসী বলছেন, ‘আলম এখন শুধু অস্ত্রধারী নয়, গোটা ইউনিয়নকে ভয় দেখিয়ে নিজের দখলে রাখতে চায়।
পুলিশ জানায়, ২০০৫ সালে যৌথ বাহিনীর অভিযানে আলমের ভাই আজাদসহ চারজন নিহত হয়। সেই অভিযানে আলম অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে যান। অভিযানের সময় লাইসেন্সপ্রাপ্ত একটি বন্দুকও নিখোঁজ হয়। পরে আলম তার অপরাধী নেটওয়ার্ককে আরও বিস্তৃত করে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে আলম কিছু যুবককে সামনে রেখে অস্ত্র ব্যবসা, ইয়াবা কারবার, পাহাড়ি চোলাই মদ উৎপাদন ও পাচারসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত। বাহিনীতে রয়েছে ২২ সদস্য, একাধিক তরুণ, যারা আলমের নির্দেশে এলাকায় দাপট দেখায়।
একাধিক পরিবার বলছে, যে বাড়ি থেকে সম্প্রতি ভিডিও ধারণ করা হয়েছে সেই বাড়ির লোকজনের কাছ থেকে আলম ৪ লাখ টাকা দাবি করে। টাকা না দেয়ায় পরিবারটিকে ঘরছাড়া করে দেয় আলম।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে আলমের ব্যবহৃত মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে তার হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি দাবি করেন, ‘অস্ত্র নিয়ে ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি বানানো। ওই ভিডিওতে আমাকে দেখা গেলেও সেটি বানানো। কখনো মেয়ে দিয়ে ভিডিও বানাইছে, কখনো অন্য কোনো কিছু দিয়ে। সিসিটিভি লাগানোর মতো টাকা আমার নেই। আমি গরিব। আমার ঘর ভাঙা।
এ বিষয়ে রাউজান থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, অভিযোগগুলো আমরা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখছি। কেউ অপরাধ করলে তার রাজনৈতিক পরিচয় যাই হোক, তাকে আইনের ঊর্ধ্বে রাখা হবে না।
সার্বিক পরিস্থিতি জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (অপারেশন অ্যান্ড ক্রাইম) মো. সিরাজুল ইসলাম আমার দেশকে বলেন, রাউজানে বর্তমানে সাতটি গ্রুপ সক্রিয়। তাদের ধরতে নিয়মিত অভিযান চলছে। আপনি জানেন, প্রায় প্রতিদিনই আমরা অস্ত্র উদ্ধার করছি, সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার করছি। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া আলমের অস্ত্রের মহড়ার ভিডিও যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। কোনো অপরাধী আমাদের নজরদারির বাইরে নেই।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের পর থেকে এই উপজেলায় ১৪টি হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে। যার বেশির ভাগই আধিপত্য বিস্তার, রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব, চাঁদাবাজির ভাগবাটোয়ারা ও পুরোনো শত্রুতাকে কেন্দ্র করে হয়েছে।

