কোটালীপাড়ায় দেড় শতাধিক খালে প্রভাবশালীর মাছের ঘের

মনিরুজ্জামান শেখ জুয়েল, কোটালীপাড়া (গোপালগঞ্জ)
প্রকাশ : ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৩: ৪৩
কোটালীপাড়ার খালে বাঁধ দিয়ে মৎস্য ঘের বানিয়েছেন প্রভাবশালীরা। ছবি: আমার দেশ

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার অর্ধশত ছোটবড় বিলের প্রায় দেড় শতাধিক সরকারি খালে বাঁধ দিয়ে অবৈধভাবে দখল করে মাছের ঘের বানিয়েছে প্রভাবশালীরা। এসব খাল-বিলে একসময় ভরপুর থাকত শোল, টাকি, কই, শিং, মাগুর, পাঙাশ, বোয়াল, চিতল, ফলি, পুঁটি, খলসে, মলা, ভুসি চিংড়ি, ট্যাংরাসহ শতাধিক প্রজাতির মাছ। দিনদিন এগুলো দখল ও দূষণে অস্তিত্ব সংকটে পড়ায় এখন বিলুপ্তির পথে।

বিজ্ঞাপন

অন্যদিকে ব্রিজ নির্মাণ ও খালখনন কাজের জন্য প্রায় ৩০টি খাল বছরের পর বছর বাঁধ দিয়ে রাখায় খালজুড়ে জমাট বেঁধে আছে কচুরিপানা। এতে করে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে খালগুলো।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলার পিঞ্জুরী ইউনিয়নের কলমুনিয়া খাল, তিতাল বাড়ি খাল, পেত্নীখালী খাল, বাসাখালী খাল, কুমলাবতী খাল, গোদার খাল, পুকুরিয়া খাল, পাথরিয়া খাল, চৌদ্দবুনিয়া খাল, রামমানির খাল, কুইচা মোড়া খাল, চাইর খাল, সীমানার খাল, কাটা খাল, দেওপুরা খালসহ প্রায় ৩০টি খাল বছরের পর বছর দখল করে রেখেছে ১৩ প্রভাবশালী ব্যক্তি। মৎস্য প্রজেক্টের নামে প্রতিটি প্রজেক্টে এদের এক একজনের রয়েছে ৫০ থেকে ১০০টি শেয়ার। সাধারণ মানুষের রয়েছে নামমাত্র শেয়ার। এ খাল দখলকারীদের মধ্যে রয়েছে আওয়ামী লীগ নেতা, ইউপি মেম্বার, বিএনপি নেতাসহ স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।

কোটালীপাড়া উপজেলার রামনগরের বিল, রথিয়ারপাড় বিল, মাছপাড়ার, কুমুরিয়া, বৈকণ্ঠপুর বিল, লখণ্ডার, মুশুরিয়ার, পিড়ারবাড়ি, পলোটানা, ধোরাল, চিথলিয়ার, পশ্চিম দিঘলিয়ার, পূর্বপাড়া, চিত্রাপাড়া-শুয়াগ্রাম, সাতুরিয়ার কান্দি, আশুতিয়ার, পারকোনা বিলসহ প্রায় অর্ধশত ছোটবড় বিল রয়েছে। এসব বিলের প্রায় শতাধিক খাল দখল করে নিয়ে মাছ চাষ করছে প্রভাবশালী মহল।

খালগুলো আবদ্ধ থাকায় পানি পচে দুর্গন্ধ ছড়ানোয় গোসল ও রান্নার কাজে খালের পানি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এতে দুর্ভোগে পড়েছে এসব এলাকার হাজার হাজার পরিবার এবং খালগুলো হয়ে পড়ছে মাছশূন্য। খালগুলো আটকে মাছের ঘের করায় ক্ষুদ্র মৎস্যজীবীরা খাল-বিল থেকে মাছ ধরতে পারছে না। যে কারণে অভাব-অনটনে কাটছে দরিদ্র মৎস্যজীবীদের সংসার।

অন্যদিকে গোপালগঞ্জ-কোটালীপাড়া খালটি খননের জন্য ঘাঘর নদীর মোহনায়, কুশলা ব্রিজের নিচে, ধরলাসহ আরো কয়েক জায়গায় প্রায় এক বছর ধরে বাঁধ দেওয়া হয়। বর্তমানে বাঁধ দেওয়ার কারণে মালামাল নিলে খাল দিয়ে চলাচল বন্ধ হওয়ায় সীমাহীন দূর্ভোগে পড়েছেন খালপাড় এলাকার বাসিন্দা, ব্যবসায়ী ও কৃষকরা।

মুক্ত জলাশয় থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করা মৎস্যজীবী ও সাধারণ জনগণ দ্রুত সময়ের মধ্যে দখল করা খাল উদ্ধারের দাবি জানিয়ে গত ১৩ আগস্ট গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসক মুহম্মদ কামরুজ্জামানের কাছে গণশুনানিতে অভিযোগ জানিয়েছেন কয়েকজন ভূক্তভোগী। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে গত ১৮ আগস্ট খাল উদ্ধারে ব্যবস্থা নিতে কোটালীপাড়ার ইউএনওকে লিখিতভাবে জানানো হলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।

গণশুনানিতে খাল দখলের অভিযোগ জানানো শিক্ষার্থী মাহফুজ শেখ বলেন, এসব খাল দখলে রাখার জন্য প্রভাবশালী একটি চক্র কাজ করে। ঘুস দেওয়া বা প্রভাব প্রতিপত্তি দেখানো, যেখানে যা লাগে এ চক্র তাই ব্যবহার করে বছরের পর বছর খালগুলো নিজেদের কবজায় রেখেছে। সরকারের উচিত দ্রুত সব খাল দখলমুক্ত করে সবার জন্য উন্মুক্ত করা।

উপজেলার দেওপুরা গ্রামের মৎস্যজীবী মনোজিত বলেন, সারা বছর খাল-বিল থেকে মাছ ধরে আমাদের সংসার চলত। কয়েক বছর ধরে এলাকার সব খাল দখল করে মাছের ঘের করায় এখন আমরা আর এসব খাল বিল থেকে মাছ ধরতে পারছি না। আমরা এখন বেকার হয়ে পড়েছি।

কোটালীপাড়া কল্যাণ সংঘের সভাপতি সোহেল শেখ বলেন, খাল দখল করে মাছ চাষ করায় দেশীয় মাছ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস এবং নৌ-চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। উপজেলার বিভিন্ন বিলের নকশা দেখে দ্রুত সময়ে এসব খাল উদ্ধারের দাবি জানাচ্ছি।

দখলকারীদের কাছে খাল দখলের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তারা কোনো রকম মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।

খাল দখল ও উদ্ধার অভিযান নিয়ে কোটালীপাড়া সিনিয়র উপজেলা মৎস্য অফিসার এসএম শাহজাহান সিরাজ বলেন, কোটালীপাড়া উপজেলার বিভিন্ন খালে বাঁধ দিয়ে মাছচাষ করার বিষয়টি উপজেলা প্রশাসন ও মৎস‍্য অধিদপ্তরের নজরে এসেছে। এসব অবৈধ বাঁধ দিয়ে মাছচাষ করার কারণে দেশীয় মাছের প্রজনন ও বিস্তারের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন থেকে উপজেলা প্রশাসন ও সিনিয়র উপজেলা মৎস‍্য অফিস ও অন‍্যান‍্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে সঙ্গে নিয়ে নিয়মিত অবৈধ বাঁধ উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করা হবে। এ ব‍্যাপারে বাঁধের অবস্থানসংক্রান্ত তথ‍্য দিয়ে উপজেলা প্রশাসনকে সহযোগিতার জন‍্য তিনি স্থানীয় সচেতন জনগণকে আহ্বান জানান।

কোটালীপাড়া উপজেলার নির্বাহী অফিসার (অতিরিক্ত দায়িত্বে) মাসুম বিল্লাহ বলেন, এ উপজেলা একটি নিম্ন জলাভূমি এলাকা। এখানে অধিকাংশ জনসাধারণ কৃষি ও মৎস্য কাজে জড়িত। এ এলাকায় প্রচুর মাছের ঘের রয়েছে, যা মৎস্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে। তবে পরিতাপের বিষয় অনেক অসাধু মৎস্যচাষি সরকারি খাল ও ব্রিজের নিচে বাঁধ দিয়ে অবৈধ দখল নিয়ে ঘেরের জায়গা বানিয়ে পানির স্বাভাবিক গতিকে ব্যাহত করে। এর ফলে কৃষির পাশাপাশি দেশীয় প্রজাতির মাছও বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। আমরা এ বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছি। ইতোমধ্যে এ বিষয়ে অভিযান চলমান রয়েছে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত