গুম-খুনের নগরীতে পরিণত করে আওয়ামী সন্ত্রাসীরা

আবু সাউদ মাসুদ, নারায়ণগঞ্জ
প্রকাশ : ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৮: ৪৪

আওয়ামী লীগের পতন নারায়ণগঞ্জের মানুষের কাছে এখনো রূপকথার মতো। গডফাদাররা নিরুদ্দেশ। আগের মতো আর নদী-নালা থেকে লাশ কুড়াতে হয় না। তবে মানুষের মনে গেঁথে আছে গত সাড়ে ১৫ বছরের দুঃসহ স্মৃতি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর জেলার বাসিন্দারা জিম্মি হয়ে পড়েন ওসমান, গাজী ও বাবু পরিবারের হাতে। গুম-খুনের মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেন তারা। যারাই এই তিনের বিরুদ্ধে গেছে, তাদের হয় এলাকা ছাড়তে হয়েছে, নয়তো শীতলক্ষ্যা নদীতে তাদের লাশ মিলেছে।

২০০৮ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। নারায়ণগঞ্জে পুনর্বাসিত হন গডফাদার খ্যাত শামীম ওসমান। বিতর্কের কারণে ২০০৮ সালের নির্বাচনে শামীম ওসমানকে মনোনয়ন দেয়নি আওয়ামী লীগ। নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনে নৌকার মনোনয়ন নিয়ে বিজয়ী হন সারাহ্‌ বেগম কবরী। সম্পর্কে ওসমানের চাচি হলেও দেশে ফেরার পরপরই তার সঙ্গে কবরীর বিরোধ সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগের একটি অংশ কবরীকে সমর্থন দিলে ওসমানের কর্তৃত্ব হুমকির মুখে পড়ে। এর মাধ্যমেই নারায়ণগঞ্জে গুম-খুনের রাজত্বের সূত্রপাত।

বিজ্ঞাপন

একই সময় নারায়ণগঞ্জ-১ আসনে এমপি হন গোলাম দস্তগীর গাজী। এলাকায় সে সময় তার জনপ্রিয়তাও ছিল বেশ। তবে দ্রুতই তার আসল রূপ দেখতে পায় রূপগঞ্জবাসী। গত সাড়ে ১৫ বছর পুরো উপজেলাকে জিম্মি করে রাখেন গাজী। দেশব্যাপী বিভিন্ন স্থাপনা শেখ পরিবারের সদস্যদের নামে হলেও রূপগঞ্জের চিত্র ছিল ভিন্ন। সেখানে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলোর নামফলকে থাকত গাজী। এ কারণে ধীরে ধীরে রূপগঞ্জকে ‘গাজীগঞ্জ’ বলে সমালোচনা করতে শুরু করেন স্থানীয়রা।

অপরদিকে ২০০৮ সালে প্রথমবারের মতো এমপি নির্বাচিত হন নারায়ণগঞ্জ-২ (আড়াইহাজার) আসনের নজরুল ইসলাম বাবু ও নারায়ণগঞ্জ-৩ (সোনারগাঁ) আসনের আবদুল্লাহ আল কায়সার হাসনাত। বাবু টানা চারবার এমপি হলেও কায়সারের আসনটি জোটের হিসাব-নিকাশের কারণে চলে যায় জাতীয় পার্টির ঝুলিতে। ওসমান পরিবারের আরেক প্রভাবশালী সদস্য নাসিম ওসমান ছিলেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য। ফলে এ আসনও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করত ওসমান পরিবার।

সিটি নির্বাচনে হারের বদলা নিতে উন্মাদ হয়ে ওঠে ওসমান পরিবার

২০১১ সালে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের (নাসিক) প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তখন আওয়ামী লীগের সমর্থন নিয়ে মেয়র হতে মাঠে নামেন শামীম ওসমান। তার বিপরীতে মাঠে উত্তেজনা বাড়ান সাবেক পৌর মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী। ওই বছরের ৩১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ভোটে শামীম ওসমানকে হারিয়ে বিপুল ভোটে মেয়র নির্বাচিত হন ডা. আইভী। শুরু হয় শামীম ও আইভীর দ্বৈরথ। ঘটতে থাকে একের পর এক হত্যাকাণ্ড। তবে নাসিক নির্বাচনের আগে থেকেই মহানগর আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জেলার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের একটি বড় অংশ আইভীর পাশে দাঁড়ায়। তাকে ভোটযুদ্ধ থেকে সরিয়ে দিতে ওই গ্রুপটিকেই টার্গেট করে ওসমান পরিবার।

এরই অংশ হিসেবে ২০১১ সালের ১৬ মে গার্মেন্ট ব্যবসায়ী আশিককে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যান তার বন্ধু সিজার ও সিদ্দিক। একদিন পর ১৮ মে শীতলক্ষ্যায় তার লাশ পায় পুলিশ। আলোচিত ওই হত্যাকাণ্ডে শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী ওসমানের সংশ্লিষ্টতা আছে বলে শোনা যায়। নাসিক নির্বাচনে পরাজয়ের পর বেড়ে যায় হত্যাকাণ্ড, পড়তে থাকে একের পর এক লাশ।

ওসমান পরিবারের রাজনৈতিক প্রতিহিংসা সব সীমা ছাড়িয়ে যায় যখন পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে আইভীর অন্যতম সহযোগী ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের নেতা রফিউর রাব্বির ছেলে মেধাবী শিক্ষার্থী তানভীর আহমেদ ত্বকীকে খুন করা হয়। ২০১৩ সালের ৬ মার্চ বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হওয়ার পর ৮ মার্চ শীতলক্ষ্যায় মেলে তার লাশ। এ হত্যাকাণ্ডেও আজমেরী ওসমানের সরাসরি সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া যায়। তার অফিস থেকে ত্বকীর রক্তমাখা জামাকাপড়ও উদ্ধার হয়। এতে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে পালিয়ে যান আজমেরী। তবে কিছুদিন পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে ‘আমি ওসমান পরিবারের পাশে আছি’ বলার পর বদলে যায় পরিস্থিতি। নারায়ণগঞ্জে ফেরেন আজমেরী, থেমে যায় ত্বকী হত্যা মামলার তদন্তকাজ।

সেভেন মার্ডারে ওসমানদের ছায়া

২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল দুপুরে ফতুল্লার লিংক রোড এলাকা থেকে নাসিকের তৎকালীন প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম, তার তিন সহযোগী স্বপন, তাজুল ও লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম এবং একই পথে যাওয়া আইনজীবী চন্দন কুমার সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিমকে অপহরণ করা হয়। তিনদিন পর ৩০ মে শীতলক্ষ্যায় একে একে ছয়জনের লাশ পাওয়া যায়। পরদিন ভেসে ওঠে অপরজনের লাশ। পরে হত্যাকাণ্ডের প্রধান অভিযুক্ত নূর হোসেনের সঙ্গে শামীম ওসমানের কলরেকর্ড ছড়িয়ে পড়ে। নাসিকের তৎকালীন মেয়র ডা. আইভীসহ স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা এ ঘটনায় শামীম ওসমানের সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ তুললেও বিষয়টি কখনো খতিয়ে দেখা হয়নি।

রূপগঞ্জ পরিণত হয়েছিল গাজীগঞ্জে

২০০৮ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে দানবে পরিণত হন গোলাম দস্তগীর গাজী। মাঝে ২০১৮ সাল থেকে ২০২৪ পর্যন্ত বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। রূপগঞ্জের বিভিন্ন সড়ক, ব্রিজ ও সরকারি স্থাপনা নিজের নামে করতে শুরু করেন গাজী। দেশের বাকি অংশে যখন শেখ মুজিবুর রহমানের গুণগান হতো, তখন এই উপজেলায় শুধু তার (গাজী) প্রশংসা। কায়েম করেন একাধিপত্য।

নির্বাচিত হওয়ার পরপরই জমি দখল ও ভূমিদস্যুতায় মেতে ওঠেন গাজী। সাধারণ মানুষের বিঘার পর বিঘা জমি দখলের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। রাতের আঁধারে ড্রেজার দিয়ে বসতবাড়িসহ বিভিন্ন জায়গা ভরাট করে ফেলতেন তিনি। যেখানে-সেখানে লাগিয়ে দিতেন সাইনবোর্ড। তার হাত থেকে রক্ষা পাননি আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও। দখল করা জমিতে বিভিন্ন কল-কারখানা গড়েছেন তিনি।

পাশাপাশি জমি দখলে বাধা হয়ে দাঁড়ানোয় খাদুন ও কর্ণগোপ এলাকায় একাধিক যুবককে গাজীর নির্দেশে হত্যা করা হয় বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। স্থানীয় শিক্ষিত সমাজের প্রতিনিধিরাও রেহাই পাননি তার অত্যাচার-নির্যাতন থেকে। ২০২৪ সালে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদে প্রার্থী হতে চাইলে গাজীর নির্দেশে রূপগঞ্জ গ্র্যাজুয়েট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইউসুফ চৌধুরীকে কুপিয়ে জখম করে গাজীর নেতাকর্মীরা।

ক্ষমতায় থাকাকালীন বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ওপর নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে বর্বরোচিত নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছেন গাজী। বিএনপি নেতাকর্মীদের না পেয়ে অনেক ক্ষেত্রে পরিবারের সদস্যদের ওপরও আক্রমণ করা হয়েছে। গাজী বাহিনীর প্রতাপে রূপগঞ্জে দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছরেও বাড়িতে থাকতে পারেননি বিরোধী মতের কোনো নেতাকর্মী। চালাতে পারেননি কোনো ব্যবসা-বাণিজ্য।

গাজী বাহিনীর চাঁদাবাজিতে জিম্মি ছিল রূপগঞ্জ। সব খাত থেকে চাঁদা তুলত তার লোকজন। সেই টাকা দিয়েই বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী পালতেন এই গডফাদার। এছাড়া প্রশাসন ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ছিল গাজীর একচ্ছত্র প্রভাব। রূপগঞ্জের সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে গাজীর পছন্দেই নিয়োগ, বদলি হতো। সরকারি স্কুলসহ প্রায় সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের গভর্নিং বডির নেতৃত্বেও ছিলেন তার পরিবারের সদস্যরা।

রূপগঞ্জে পরিবারতন্ত্রও কায়েম করেছিলেন গাজী। তার স্ত্রী হাসিনা গাজীকে তারাব পৌরসভার মেয়র বানাতে সৃষ্টি করেন ত্রাসের রাজনীতি। গাজীর ভয়ে তখন কেউই তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি। স্ত্রীকে পাস করিয়ে নেন তিনি। এছাড়া ছোট ছেলে গোলাম মর্তুজা পাপ্পাকে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বানানোর সবরকম চেষ্টাই করেন। কিন্তু তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী এমপি-মন্ত্রীর স্বজনরা উপজেলা নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না বলে ঘোষণা দিলে গাজীর পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।

বাবুর দুঃশাসনে তটস্থ ছিল আড়াইহাজারবাসী

ছাত্রলীগের রাজনীতির মধ্য দিয়ে নজরুল ইসলাম বাবুর উত্থান ঘটে। নারায়ণগঞ্জের গডফাদার হিসেবে খ্যাত শামীম ওসমানের সঙ্গে তার সখ্য ছিল। সে সুবাদে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনার সুনজরে আসেন বাবু। তবে আগে থেকেই তিনি বিতর্কিত ছিলেন। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ছাড়াও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ছিল তার নাম। ছাত্রলীগের বড় বড় পদে দায়িত্ব পালন ও দলের জন্য তার ত্যাগী নেতৃত্বে পুরস্কার হিসেবে ২০০৮ সালে তাকে নারায়ণগঞ্জ-২ (আড়াইহাজার) আসনে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।

২০০৮ সালের নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই বাবুর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ উঠতে থাকে। আড়াইহাজারের বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেন তিনি। উপজেলাজুড়ে বিশাল সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলেন। তাদের দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করতেন পুরো উপজেলা।

২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে পুনরায় এমপি হন বাবু। এরপর একপ্রকার অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন তিনি। লুটপাট, দখলদারিত্বের সব মাত্রা ছাড়িয়ে যান তিনি। আওয়ামী লীগ আমলেই বাবুর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনে দুদক, যা সে সময় একপ্রকার অকল্পনীয় ছিল।

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবুর বিরুদ্ধে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। সে সময় প্রথম অনুসন্ধান কর্মকর্তা ছিলেন দুদকের উপপরিচালক সামছুল আলম। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে নতুন অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের ৫ সেপ্টেম্বর নতুন অনুসন্ধান কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান দুদক উপপরিচালক ওয়াকিল আহমেদ। অনুসন্ধান শেষে অব্যাহতির সুপারিশ করে প্রতিবেদন দাখিল করেন তিনি। এই প্রতিবেদন কমিশনে গৃহীতও হয়। ২০১৮ সালের ৫ মার্চ বাবুকে দায়মুক্তি দেওয়া হয়।

২০১৮ সালের নির্বাচনে আড়াইহাজারে বাবুর প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির নজরুল ইসলাম আজাদ। নির্বাচনি প্রচারে পুরো সময় আজাদের ওপর একাধিকবার হামলা চালায় বাবুর সন্ত্রাসীরা। এক পর্যায়ে আজাদের বাড়িতেও বেশ কয়েকবার হামলা চালায় সন্ত্রাসীরা। সেই বিতর্কিত নির্বাচনও বাগিয়ে নেন বাবু।

২০১৯ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হলে ১১৮ জনের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান শুরু করে দুদক। ওই তালিকায় সংসদ সদস্য বাবু ও তার স্ত্রীর নামও আছে। দুদকের বিশেষ তদন্ত শাখা-২ বাবু ও তার পরিবারের সম্পদ নিয়ে অনুসন্ধানের এক পর্যায়ে প্রাথমিক যে প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেয়, সেখানে বাবু ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা দেশ-বিদেশের সম্পদের তথ্য উল্লেখ আছে। প্রাথমিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাবু, তার ভাই, স্ত্রী ও আত্মীয়-স্বজনের নামে টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অবৈধ সম্পদ দখল, নিয়োগবাণিজ্য করে ৫১৩ কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে জানা যায়।

ওসমান পরিবারের আশীর্বাদে সোনারগাঁ কাঁপান খোকা

নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগের এমপিরা দেশ ছেড়ে পালালেও রাজনীতিতে সক্রিয় আছেন সোনারগাঁয়ের সাবেক এমপি লিয়াকত হোসেন খোকা। নারায়ণগঞ্জে তাকে খুব একটা দেখা না গেলেও ঢাকায় জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় রাজনীতিতে তিনি বেশ তৎপর। ওসমান পরিবারের ঘনিষ্ঠজন হিসেবে পরিচিত খোকা সোনারগাঁয়ে কায়েম করেন ত্রাসের রাজত্ব।

২০১৪ সালে সোনারগাঁ থেকে এমপি নির্বাচিত হন খোকা। জাতীয় পার্টির রাজনীতি করলেও ওসমান পরিবারের একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন খোকা। জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম মেম্বার ও প্রয়াত সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানের কাছের কর্মী হিসেবে পরিচিত ছিলেন তিনি। ওসমান পরিবারের তদবিরেই ২০১৪ সালের নির্বাচনে সোনারগাঁ আসন জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয় আওয়ামী লীগ। বিতর্কিত সে নির্বাচনে এমপি হন খোকা।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির সব নেতাকর্মী এবং সাবেক এমপিরা পালালেও দম্ভভরে চলছেন টানা ১০ বছর এমপি থাকা খোকা। এখনো দাপট আছে তার সন্ত্রাসী বাহিনীর। লুটপাট ও দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার কোটি টাকার মালিক বনে গেলেও আছেন অধরা।

শাপলা ম্যাসাকারের পর নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী তাণ্ডব

২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকায় হেফাজতে ইসলাম নেতাকর্মীদের ওপর বর্বর হত্যাকাণ্ড চালায় আওয়ামী সন্ত্রাসী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। পরদিন ৬ মে উত্তপ্ত ছিল রাজধানীর পাশের নারায়ণগঞ্জ জেলা। এ ঘটনায় সিদ্ধিরগঞ্জ ও সোনারগাঁয়ে ১৭টি মামলা হয়। এর মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জে ১১টি ও সোনারগাঁ থানায় ছয়টি মামলা হয়। সেদিন ভোর থেকে দুপুর পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের শিমরাইলে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে হেফাজত ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের টানা সাড়ে পাঁচ ঘণ্টার সংঘর্ষে ১৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও পুলিশের দুজন করে সদস্য নিহত হন। এসব ঘটনায় দায়ের করা মামলায় বিএনপি ও হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীদের আসামি করা হলেও চার্জশিট থেকে হেফাজতের নাম বাদ দেওয়া হয়।

নারায়ণগঞ্জে ১৭ বছরে বিএনপির

বিরুদ্ধে ৬০০ মামলা

নারায়ণগঞ্জে আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিএনপি নেতাকর্মীদের দমনের অন্যতম অস্ত্র ছিল গায়েবি মামলা দিয়ে হয়রানি করা। বিএনপি যখনই আন্দোলন বেগবান করত, তখনই এসব মামলা দায়ের করে দলটির নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার-হয়রানি করত পুলিশ। মামলার কারণে মাসের পর মাস বাড়িছাড়া থাকতেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। এর অধিকাংশই ছিল ভুয়া ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এভাবে জেলার সাতটি থানায় ৬০০ রাজনৈতিক মামলা আছে।

সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট এবং নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত পিপি (পাবলিক প্রসিকিউটর) একেএম ওমর ফারক নয়ন জানান, ২০২৪ সালে তারা নারায়ণগঞ্জের সাত থানার ৬০০ রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়েছিলেন। এ পর্যন্ত ৩০০টি প্রত্যাহার করা হয়েছে। অপর মামলাগুলো প্রত্যাহার প্রক্রিয়াধীন।

১৫ বছরে ৫০ নেতাকর্মী প্রাণ হারান

নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক মাসুকুল ইসলাম রাজীব বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে রাজনৈতিক মাঠ ছিল চ্যালেঞ্জিং। পুলিশের চেয়ে বেশি অত্যাচার-জুলুম-নির্যাতন চালিয়েছে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। মিথ্যা মামলা, আদালত আর জেল ছিল আমাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। পাশাপাশি ছিল গুম আতঙ্ক। ৯ বার জেল খেটেছি, বহুদিন রিমান্ডে পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছি। সাড়ে ১৫ বছরে আমাদের প্রায় ৫০ নেতাকর্মীকে খুন করা হয়েছে।

মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব আবু আল ইউসুফ খান টিপু বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে জীবন হাতে নিয়ে রাজপথে মিছিল-মিটিং করতে হয়েছিল। অনেককে বিএনপির রাজনীতি করার কারণে নির্যাতন করা হয়েছে, এমনকি বশ্যতা স্বীকার না করায় হত্যা পর্যন্ত করা হয়েছে।

মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান বলেন, ২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আনন্দ শোভাযাত্রায় পুলিশের গুলিতে নিহত শাওন প্রধানের স্মৃতি আমাকে এখনো শিহরিত করে। ওকে যখন পুলিশ গুলি করে, আমি সামনে থেকে ধরেছিলাম। ওর বুক থেকে যখন গরম রক্ত বের হচ্ছিল, তখন আমার কলিজা ছটফট করছিল। সেই স্মৃতি মনে হলে আমি এখনো আঁতকে উঠি।

জুলাই আন্দোলনে শামীম ওসমানের অস্ত্রবাজি

জুলাই আন্দোলনের মাধ্যমে পতন ঘটে ওসমান পরিবারের। দেড় দশকের জিম্মিদশা থেকে মুক্তি পায় নারায়ণগঞ্জবাসী। বিভিন্ন সময় বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের উদ্দেশ করে নানান হুংকার দিয়ে এলেও খেলা শুরু হওয়ার সঙ্গেই পালিয়ে যান শামীম ওসমান। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সশস্ত্র হামলা চালায় তার সন্ত্রাসীরা। মাঠে থেকে তাদের নেতৃত্ব দিয়েছেন তার ছেলে অয়ন ওসমান, শ্যালক তানভীর আহমেদ টিটু, বেয়াই সালাউদ্দিন লাভলু ও অয়নের শ্যালক ভিকি। তাদের সঙ্গে ছিলেন ছাত্রলীগের সাবেক জেলা সভাপতি হাবিবুর রহমান রিয়াদসহ আওয়ামী সন্ত্রাসীরা।

শহরের রাইফেল ক্লাব থেকে লুট করে অত্যাধুনিক বিভিন্ন অস্ত্র নিয়ে সেদিন নারায়ণগঞ্জে আন্দোলনকারীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন শামীম ওসমান ও তার সন্ত্রাসীরা। দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জের চাষাড়া থেকে ডিআইটি এলাকায় পিস্তল, শর্টগান ও অটোমেটিক মেশিনগান দিয়ে গুলিবর্ষণ করেন এবং তাণ্ডব চালান তারা। গুলি ছুড়তে ছুড়তে ডিআইটি এলাকার দিকে অগ্রসর হন। তাদের ও পুলিশের হাতে শহীদ হন ২২ ছাত্র-জনতা।

জুলাই আন্দোলনে শহীদ ২২

নারায়ণগঞ্জে জুলাই আন্দোলনে ২২ জন শহীদ হন আওয়ামী সন্ত্রাসী ও পুলিশের গুলিতে। নিহতরা হলেন রিয়া গোপ, মো. রোমান, আরমান মোল্লা, মো. ইরফান ভূঁইয়া, মো. তুহিন, মো. মোহসীন, মো. জনি, ইব্রাহিম, মো. স্বজন, মো. আদিল, পারভেজ হাওলাদার, মোহাম্মদ ফারহানুল ইসলাম ভূঁইয়া, ছলেমান, ইমরান হাসান, হযরত বিল্লাল, সফিকুল, মো. সজল, মো. মাবরুর হুসাইন, মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান খান, মোহাম্মদ সাইফুল হাসান ও আহসান কবির।

নারায়ণগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মুহাম্মদ গিয়াসউদ্দিন বলেন, আওয়ামী আমলে কোনো রাজনীতিই ছিল না। আমরা যারা জালিমের বিরুদ্ধে কথা বলেছি, আন্দোলন করেছি, তাদের রাতের আঁধারে ধরে নিয়ে গেছে, গুম করা হয়েছে, হত্যা করা হয়েছে কিংবা মিথ্যা মামলা দিয়ে বাড়িঘরছাড়া করেছে। পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাবকে তাদের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। তখন ইতিহাসের সবচেয়ে নিকৃষ্টতম সময় পার করেছে বাংলাদেশের মানুষ।

মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমির ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা আবদুল জব্বার জানান, আওয়ামী লীগ আমলে আমাদের রাজনৈতিক ময়দান ছিল কণ্টকাকীর্ণ। শুধু আমাদের জন্য কঠিন সময় ছিল এমন নয়, বরং দেশপ্রেমিক সব রাজনৈতিক দলের জন্যই কঠিন সময় ছিল। সে সময় আমরা অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছি। রাজনৈতিক কার্যালয়গুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। ওয়ারেন্ট ছাড়াই নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা হতো। জেল থেকে জামিনে মুক্ত হওয়ার পরও জেলগেট থেকে পুনরায় গ্রেপ্তার করা হতো। মিথ্যা মামলার পর মামলা দিয়ে জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত