শতকোটি টাকার সেতুর পাশে যুবলীগ নেতার রমরমা বালুর ব্যবসা

জেলা প্রতিনিধি, মাদারীপুর
প্রকাশ : ১৩ অক্টোবর ২০২৫, ১৬: ৪৪

মাদারীপুর সদর উপজেলার হবিগঞ্জ সেতুর মাত্র ৫০ মিটার দূরেই রমরমা বালু ব্যবসা করছে বাহাদুরপুর ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি ও ওয়ার্ড মেম্বার শফিকুল বেপারী দেদুল। সেতুর কিছুটা দূলে আড়িয়াল খাঁ নদ থেকে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করে সেতুর সাথেই দুটো ব্রেজ নির্মাণ করে বালুর ব্যবসা করে যাচ্ছেন। প্রশাসনের চোখের সামনে এমন রমরমা ব্যবসা করলেও অজ্ঞত কারণে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। ফলে নদী তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন দেখা দিতে পারে। আর শতকোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেতুর ক্ষতির সম্ভাবনা দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিজ্ঞাপন

সরেজমিনে দেখা গেছে, হবিগঞ্জ সেতুর পূর্ব পাশ সংলগ্ন বালু রাখার জন্যে বড় আকারের দুটো ব্রেজ নির্মাণ করা। যেখানে আড়িলায় খাঁ নদ থেকে জ্রেজারের মাধ্যমে বালু উত্তোলন করে বাল্কহেডের মাধ্যমে আনলোড করা হচ্ছে। যে স্থানে বালু জমানো হচ্ছে, তার মাত্র ৫০ ফুট দূরেই সেতুটি। ফলে বালু উত্তোলন ও আনলোডের কারণে বড় বড় ঢেউয়ের সৃষ্টি হচ্ছে। এতে ভাঙন দেখে দিয়েছে নদীর পিলারের স্থানে। একের পর এক বাল্কহেড বালু নিয়ে আসছে, তা ফেলে আবারো যাচ্ছে। অন্যদিকে সেই বালু পাইকের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় টাকার বিনিময়ে ভরাট করছে। এমনই হুলুস্থুল কাণ্ড দেখা যাচ্ছে গত দুই মাস ধরে।

স্থানীদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, সেতুর সাথে বালু স্তূপ করা ব্রেজ দুটো বছর দুই আগেও নিয়ন্ত্রণ ছিল মাদারীপুর সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বাহাদুরপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন সেলিম ও তার ছেলে সৈয়দ রাজিবের। তারা এই স্থানে বালুর স্তূপ করে রমবমা ব্যবস্থা করতেন। এদের স্থানীয়ভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিতেন দক্ষিণ বিরাঙ্গল গ্রামের ফজলুল হক বেপারীর ছেলে ও ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি শফিকুল বেপার দেদুর। যিনি বাহাদুরপুর ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের মেম্বার। তারা মিলেই বালুর অবৈধ ব্যবসা করে আসছিল। কিন্তু ৫ আগস্টের ফাসিস্ট আওয়ামী লীগের পতনের পরে আত্মগোপনে চলে যান সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন সেলিম ও তা ছেলে সৈয়দ রাজিব। এরপরে বেশ কিছু দিন বালু ব্যবসা বন্ধ ছিল। কিন্তু গত দুই মাস ধরে পুনরায় ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নেয় শফিকুর বেপারী দেদুল ও স্থানীয় রুহুল মিয়ার কবজায়। তাদের নিয়ন্ত্রণেই চলছে ব্যবসা। তাদের সাথে যোগ দিয়েছেন আরো কয়েকজন স্থানীয় লোক।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সদর উপজেলার কালিকাপুর ইউনিয়নের মামুন নামে এক ব্যক্তির ড্রেজার দিয়ে আড়িয়াল খাঁ নদের অন্তত ৫টি স্থান থেকে দিন-রাতে বালু উত্তোলন করা হয়। আর সেই বালু ফেলা হচ্ছে দেদুলের ব্রেজে। পরে এসব বালু রাতের আঁধারে বিক্রি করা হচ্ছে বিভিন্ন স্থানে। অবৈধভাবে উত্তোলন করা এসব বালু বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিলেও রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার। বালু পরিবহনে ব্যবহার করা হচ্ছে ট্রাক্টরও। ফলে ভেঙে যাচ্ছে চলাচলের রাস্তা। অন্যদিকে সেতুও ক্ষতিগ্রস্থ্য হচ্চে। প্রতিদিন সেতু দিয়ে হাজার হাজার যানবাহন চলাচল করায় স্থানটি সকলেই চোখে পড়ছে। কিন্তু এরপরেও প্রশাসন কোন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যক্তি বলেন, দেদুল মেম্বার এতোটাই প্রভাবশালী যে, তার উপরে কেউ কথা বলতে ভয় পায়। কেউ প্রতিবাদ করলে হামলা করা হয়। সপ্তাহখানের আগে দক্ষিণ বিরাঙ্গল গ্রামের ইঞ্জিল হকের ছেলে লিয়াকত হত্যার প্রতিবাদ করায় তাকে মারধর করে দেদুলের লোকজন। ফলে অন্যরা কথা বলতে ভয় পাচ্ছে। অলিখিত এলাকার ত্রাস দেদুল মেম্বার।

স্থানীয়ভাবে জানা যায়, এরই মধ্যে দেদুলের মাধ্যমের দক্ষিণ বিরাঙ্গল গ্রামের ফারুক মাতুব্বর, মিজান মাতুব্বর, সেলিম বেপারী, মনির বেপারী, বিল্লাল সরদার, মুকাই হোসেনসহ অন্তত ১৫ থেকে ২০ জনের বাড়িতে লাখ লাখ টাকার বালু বিক্রি করেছে দেদুল সিন্ডিকেট। ফলে এর একটি অংশ প্রশাসনের দায়িত্বশীলদেরও দেয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যদিও জেলা ও উপজেলা প্রশাসন মাঝে মাঝে অবৈধ ড্রেজার ব্যবসায়ীদের জরিমান করছেন। কিন্তু তারপরেও এসব অবৈধ ব্যবস্থা বন্ধ করা যাচ্ছে না।

নাম প্রকাশে অনুচ্ছিক এক ব্যক্তি বলেন, আওয়ামী লীগের আমলেও ছাত্রলীগ যুবলীগের নেতারা বালুর ব্যবসা করতো, এখনো তারাই কৌশলে বালুর ব্যবসা করছে। সাথে কিছু বিএনপির লোকজন জড়িত হচেছ। এখন আর আগের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়। বরং এখন প্রশাসন ম্যানেজ করেই তারা কাজ করতে পারছে। বালু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম কমে নাই বরং আগের চেয়ে বাড়ছে।

এলজিইজির অথায়নে প্রায় শতকোটি টাকা ব্যয়ে আড়িয়াল খাঁ নদের উপর হবিগঞ্জ ব্রিজটি নির্মাণ করা হয়। যার অন্তত দুই হাজার মিটারের মধ্যে বালু উত্তোলন করার নিয়ন নেই। কিন্তু ব্রিজের মাত্র ৫০০ মিটার দূরেই অবৈধ ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করা হচেছ। এতে বিজ্রেরও ব্যাপক ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে মুখ খুললেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সানাউল কাদের খান।

তিনি বলেন, নিয়ম হলো সেতুর অন্তত দেড় হাজার থেকে দুই হাজার মিটার দূরে নদীর পলি অপসারণ করার। কিন্তু অপরিকল্পিতভাবে ড্রেজার দিয়ে বালু উত্তোলন করায় সেতুর ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই প্রশাসনের এর ব্যবস্থা নেয়া খুবই জরুবি। না হলে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত সেতুর ক্ষতি হবে।

এ ব্যাপারে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাবাব ওয়াদিয়া বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিল না। এখন যেহেতু জেনেছি, খুবই দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া আমরা প্রায় প্রতিনিয়ত অবৈধ বালু উত্তোলনের বিষয় ভ্রাম্যমান আদালতের মাধ্যমে বালু ব্যবসায়ীদের জেল-জরিমান করছি। আশা রাখি, এসবও বন্ধ করা হবে।

অভিযোগের বিষয় শফিকুল বেপারী দেদুলের বাড়িতে গিয়ে পাওয়া যায়নি। তার ব্যবহারিত মোবাইল রিসিভ করেনি। মোবাইলে ক্ষুদে বার্তা দিয়েও কোন উত্তর পাওয়া যায়নি।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত