লোকসানের বোঝা নিয়ে খুঁড়িয়ে চলছে মোবারকগঞ্জ চিনিকল

টিপু সুলতান, কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ)
প্রকাশ : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১: ২৪
আপডেট : ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৭: ১১

কালীগঞ্জে মোবারকগঞ্জ চিনিকল একটি ভারী শিল্প প্রতিষ্ঠান হলেও বর্তমানে এটি চলছে বিপুল লোকসান আর ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে। বিশেষ করে গত ২০২৩-২৪ আখ মাড়াই মৌসুমে প্রতি কেজি চিনির উৎপাদন ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৫৪২ টাকা, যেখানে প্রতি কেজিতে লোকসান দিতে হয়েছে ৪১৭ টাকা। চিনিকলটি গত মাড়াই মৌসুমে ৭০ হাজার টন আখ মাড়াই করে ৩ হাজার ৯২০ টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। চিনির আহরণ ধার্য করেছিল মাত্র ৫.৬%, যা উৎপাদনের জন্য অপ্রতুল। এছাড়া আ.লীগ সরকারের আমলে অতিরিক্ত অদক্ষ জনবল নিয়োগের কারণে চিনিকলটিতে প্রতি বছর বেতন ভাতা বাবদ অতিরিক্ত টাকা গুনতে হচ্ছে।

বিজ্ঞাপন

ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ উপজেলায় ২০৩.৯৩ একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠিত চিনিকলটি ১৯৬৫ সালে নির্মাণকাজ শুরু হয়ে ১৯৬৮ সালে সমাপ্ত হয় এবং ১৯৬৭-৬৮ সালে চিনি উৎপাদন শুরু হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার এই প্রতিষ্ঠানটিকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঘোষণা করে। মোবারকগঞ্জ চিনিকল ১৯৬৫ সালে স্থাপিত হয় নেদারল্যান্ডস সরকারের সহায়তায়। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর থেকে মিলটি কোনো আধুনিকায়নের মুখ দেখেনি। ব্রিটিশ আমলের পুরোনো যন্ত্রপাতি দিয়ে উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় প্রতি বছর বাড়ছে জ্বালানি খরচ এবং রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়। উৎপাদন ব্যয়ের সিংহভাগ যায় কর্মচারীদের বেতন, সরকারের ভ্যাট এবং ব্যাংক ঋণের সুদ পরিশোধে। দীর্ঘদিন চিনিকলটি নানাঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে চালু রয়েছে। মান্দাতার আমলের যন্ত্রপাতি দিয়ে ও নিম্নমানের যন্ত্রাংশ দিয়ে চিনিকলটি চালু রয়েছে।

গত মাড়াই মৌসুমে চিনি উৎপাদন হার ছিল অন্য অর্থবছরের থেকে অনেক কম। গত অর্থবছরে ২ হাজার ৫০০ টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও অর্জিত হয় মাত্র ১৮৭১ টন। এছাড়া মিলটিতে অপারেশনাল লস দেখানো হয়েছে ৩৪ কোটি ও ব্যাংক ঋণের সুদ দেখানো হয়েছে ৩৬ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ৭০ কোটি টাকা লোকসানের বোঝা আর ৩৫০ কোটি টাকা ব্যাংকের দেনা মাথায় নিয়ে আবার আখ মাড়াই মৌসুম উদ্বোধন করা হয়েছিল।

২০২৪ সালের ১৩ ডিসেম্বর বিকালে মোবারকগঞ্জ চিনিকলটি ৫৮তম মাড়াই মৌসুম শুরু করেছি। ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ শহরসংলগ্ন এলাকায় ১৯৬৫ সালে ৩ কোটি ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে ২০৭ দশমিক ৯৩ একর নিজস্ব জমির ওপর নেদারল্যান্ডস সরকারের সহযোগিতায় মোবারকগঞ্জ চিনিকলটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। চিনিকলের আওতাধীন ২০ দশমিক ৬২ একর জমিতে কারখানা, ৩৮ দশমিক ২২ একর জমিতে কর্মকর্তা ও শ্রমিক-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক কলোনি, ২৩ দশমিক ৯৮ একর পুকুর, ১০৭ একর জমিতে ইক্ষু খামার ও ১৮ দশমিক ১২ একর জমিতে রয়েছে সাবজোন অফিস ও আখ ক্রয় কেন্দ্র।

ঝিনাইদহের ছয় উপজেলা ছাড়া যশোরের দুটি উপজেলা নিয়ে গঠিত চিনিকলের আটটি জোন অফিস নিয়ে ইক্ষু উন্নয়ন, রোপণ, ক্রয়, আখ চাষিদের বিভিন্ন পরামর্শ দেওয়া প্রধান কাজ। কিন্তু পরে গিয়ে সবই শেষ হয়ে মাঠপর্যায়ের দায়িত্বরত ইক্ষু উন্নয়ন কর্মকর্তাদের দুর্নীতির কারণে কৃষকরা আখ রোপণ করতে অনিহা প্রকাশ করে। মোচিকের আওতাধীন কৃষকদের অভিযোগ, মিলের কর্মকর্তা ও সিবিএ নেতাদের লাগামহীন দুর্নীতি, কর্তব্য অবহেলা ও অদক্ষ শ্রমিক কর্মচারীদের কারণে মিলটির ঐতিহ্য হারিয়েছে। এছাড়া আ.লীগ সরকারের আমলে অতিরিক্ত অদক্ষ জনবল নিয়োগের কারণে চিনিকলটিতে প্রতি বছর বেতনভাতা বাবদ অতিরিক্ত টাকা গুনতে হচ্ছে।

মোবারকগঞ্জ চিনিকলে ১১৮৪ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ থাকলেও বর্তমানে ৬৫৮ জন কর্মরত আছেন। দীর্ঘদিন ধরে দক্ষ জনবল সংকটে ভুগছে চিনিকলটি। আবাদযোগ্য জমির পরিমাণ ১ লাখ ৫০ হাজার ২৩৫ হেক্টর। এই জমির মধ্যে ২০২৪/২৫ মাড়াই মৌসুমে আখ রোপণ হয়েছিল মাত্র ৪ হাজার ৪১০ একর জমিতে। মৌসুমে চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য ছিল ৩ হাজার ৭৮০ টন। চিনি উৎপাদন হয়েছিল ৩ হাজার ৮৬৮ টন। আগামী ২০২৫/২৬ মৌসুমে আখ রোপণের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য করা হয়েছে ৪ হাজার ৮০০ একর। আখ মাড়াই কার্যদিবসে ধার্য হয়েছে ৯০ হাজার টন এবং চিনি উৎপাদন হবে ৪ হাজার ৫০০ টন।

বর্তমানে মিলটিতে ২ হাজার ৫০০ টন চিনি, ৪১ টন চিটাগুড় মজুত রয়েছে। বিশেষ করে প্রতি বছর আখ মাড়াই মৌসুমের সময় ব্যাপকভাবে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে বন্ধ থাকে মাড়াই কার্যক্রম। ফলে ক্রয় কেন্দ্রগুলোতে খোলা আকাশের নিচেই আখ শুয়ে যায়। এদিকে ২০২২/২৩ মাড়াই মৌসুমে চিনিকলটি ৩৪ কোটি টাকা লোকমান খেয়েছি।

মহাব্যবস্থাপক (কৃষি) গৌতম কুমার বলেন, নিচু জমিতে উৎপাদিত আখে চিনির উৎপাদন হার কম হয়। তাছাড়া মাড়াই মৌসুম শুরু হলে এক শ্রেণির অসাধু আখচাষি ওজন বৃদ্ধি করতে জমিতে সেচ ও সার প্রয়োগ করেন, ফলে চিনি উৎপাদন হার কমে যায়।

বাংলাদেশ চিনিকল শ্রমিক ফেডারেশন সভাপতি ও মোচিক শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের সভাপতি শফিকুর রহমান রিঙ্কু বলেন, মোবারকগঞ্জ চিনিকলের সঙ্গে এ অঞ্চলের অনেক আখচাষি, শ্রমিক কর্মকর্তার জীবন-জীবিকা জড়িত।

মোবারকগঞ্জ চিনিকলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী আ.ন.ম জোবায়ের বলেন, ইতোমধ্যে আখের মূল্যবৃদ্ধির জন্য চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশনে আবেদন করেছি। মোবারকগঞ্জ চিনিকলটি লোকসানের কবল থেকে লাভজনক করার জন্য নানা পরিকল্পনা কর্পোরেশনের সদর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত