উপকূলজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব

কেনা পানিই যেখানে একমাত্র ভরসা

গাজী শাহনেওয়াজ, শ্যামনগর (সাতক্ষীরা) থেকে ফিরে
প্রকাশ : ০৪ আগস্ট ২০২৫, ১১: ০০

জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানছে উপকূলীয় এলাকায়। এতে উপকূলজুড়ে বাড়ছে লবণাক্ততা, কমছে মিঠা পানির উৎস। দেখা দিচ্ছে সুপেয় পানির সংকট। ফলে উপকূলীয় বাসিন্দাদের নির্ভর করতে হচ্ছে কেনা পানির ওপর। এই পানি দিয়েই চলে রান্না ও খাওয়া। ক্ষেত্রবিশেষে গোসলও সারতে হয় এ পানিতেই। এতে একদিকে যেমন বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়, অন্যদিকে রোগ বাসা বাঁধছে শরীরে। সব মিলিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে নিম্নবিত্তদের, মধ্যবিত্তের অবস্থাও নাজুক।

বিজ্ঞাপন

সরেজমিন দেখা যায়, সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার কৈখালী, পদ্মপুকুর, গাবুরা, মুন্সীগঞ্জ ও নওয়াবেঁকী এবং খুলনার কয়রা ও প্রতাপনগরে মিঠা পানি প্রায় দুর্লভ। ফলে এসব এলাকায় বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করার জন্য গড়ে উঠেছে ‘ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট’। সাতক্ষীরার শ্যামনগর, আশাশুনি ও খুলনার কয়রায় এ ধরনের ১৫ থেকে ২০টি পানির প্লান্ট বসানো হয়েছে। এর মধ্যে শ্যামনগরে রয়েছে ৭টির মতো। এর প্রতিটিতে দৈনিক ২৫ থেকে ৩০ হাজার লিটার পানি বিশুদ্ধ করা হয়।

স্থানীয়রা জানান, সুপেয় পানির সংকট রয়েছে শ্যামনগর উপজেলার ১২ ইউনিয়নের কম-বেশি প্রায় সব গ্রামেই। এসব জায়গায় এক কলসি পানি সংগ্রহের জন্য নারীদের লম্বা পথ হাঁটতে হয়। ঘরের কাজ শেষ করে তারা ছোটেন পানি সংগ্রহের জন্য। এতে নানা ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে হয় তাদের।

জানা যায়, শ্যামনগরের নূরনগর, কৈখালী ও রমজাননগর ইউনিয়নের প্রায় চার হাজার পরিবার নূরনগরের মঈনুদ্দীন লাভলুর প্লান্ট থেকে পানি নেন। এসব এলাকার মানুষের চাহিদা অনুযায়ী ঘরে ঘরে পানি পৌঁছে দেওয়া হয়। ৩০ লিটার জারের পানির মূল্য সর্বনিম্ন ২৫ থেকে সর্বোচ্চ ৪০ টাকা। এলাকা ও দূরত্বভেদে জারপ্রতি ওই টাকা আদায় করা হয় গ্রাহকের কাছ থেকে।

নূরনগরের ঢালীপাড়া গ্রামের বাসিন্দা আশরাফ ঢালী প্লান্ট থেকে পানি সংগ্রহ করে তা মানুষের ঘরে পৌঁছে দেন। আমার দেশকে তিনি বলেন, প্রায় এক দশক ধরে আমি এই কাজ করছি। সাড়ে তিন হাজার পরিবারের সঙ্গে আমার জীবন জড়িত। প্রথম দিকে পানির চাহিদা কম থাকলেও ক্রমান্বয়ে তা বাড়ছে। শুরুতে কেনা পানিতে খাওয়া এবং রান্নার কাজই চলত। বর্তমানে অনেক পরিবার গোসলের কাজেও এই পানি ব্যবহার করছে। বছরে বর্ষার দুই মাস (আষাঢ়-শ্রাবণ) ছাড়া বাকি ১০ মাস কেনা পানিতেই চলতে হয় এখানকার মানুষদের।

গাবুরা ইউনিয়নের রবিউল ও মাসুদ আমার দেশকে জানান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ঘূর্ণিঝড়ের কারণে এলাকায় প্রায়ই জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। এর প্রভাবে সুপেয় পানির উৎস অনেকাংশে নষ্ট হয়ে গেছে। উপজেলায় লবণাক্ততার প্রকোপও বেশি। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে পানি থাকলেও সেগুলো লবণ পানি, যা ব্যবহারযোগ্য নয়। আর লবণ পানির চিংড়ি ঘেরের কারণে পার্শ্ববর্তী পুকুর বা জলাশয়ের পানিও লবণাক্ত হয়ে যায়। এ ছাড়া শুষ্ক মৌসুমে সুপেয় পানির তীব্র সংকট দেখা দেয়। সুপেয় পানির অভাবে অনেক পরিবারের সদস্যই চর্মরোগ, আমাশয়, ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।

বর্ষায় পুরো এলাকা ডুবে যাওয়ায় কেনা পানিই একমাত্র ভরসা বলে জানালেন প্রতাপনগর ইউনিয়নের সমাজকর্মী শাহিন শানা। তিনি বলেন, বর্ষায় পুরো এলাকা ডুবে গেছে। প্রতি বছরই এমন হয়। মিঠা পানি বলতে অবশিষ্ট কিছু নেই। খাওয়া, গোসল ও রান্নার কাজ কেনা পানি দিয়েই চালাতে হচ্ছে। আমাদের কষ্টের জীবনের কথা বলে শেষ করা যাবে না।

শ্যামনগর উপজেলার একটি বেসরকারি সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মোহন কুমার মণ্ডল জানান, কেনা পানিতেই চলে তার ঘরের সব কাজ। গ্রীষ্মে গোসলের পানিও কিনতে হয়।

এ বিষয়ে শ্যামনগর উপজেলার জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান আমার দেশকে বলেন, সুপেয় পানির জন্য সরকারি উদ্যোগে আমরা রিভার্স অসমোসিস প্লান্ট বসিয়ে দিই। এক বছর পর্যন্ত সেগুলো তদারকি করা হয়। এরপর কমিটি করে দেওয়া হয়। তাদের দায়িত্ব থাকে এগুলো দেখভাল করার। পরবর্তীতে এ খাতে সরকারের কোনো বরাদ্দ না থাকায় সহযোগিতা করা সম্ভব হয় না। উপকূলজুড়ে লবণাক্ততার কারণে সুপেয় পানির সংকট রয়েছে।

শ্যামনগর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রনি খাতুন আমার দেশকে বলেন, চিংড়ি চাষ এ অঞ্চলের মানুষের অন্যতম আয়ের উৎস। যখন থেকে ব্যাপক আকারে এই চাষ ছড়িয়ে পড়েছে, মিঠা পানির উৎসগুলোও ধীরে ধীরে কমে গেছে। এ অবস্থায় জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা কারণে লবণাক্ততাও বাড়ছে। এখন আমরা মিঠা পানির উৎসগুলো সচল রাখতে খাল ও নালা সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি। পুকুর খননের চেষ্টা চলছে, যাতে মানুষ সুপেয় পানি পায়। লবণাক্ততা কমানো সম্ভব না হলে সুপেয় পানির সংকট দূর করা সম্ভব হবে না।

জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও ওয়াটারকিপার অ্যালায়েন্সের কার্যনির্বাহী সদস্য শরীফ জামিল আমার দেশকে বলেন, দশকের পর দশক চলে যাচ্ছে; কিন্তু সরকার মিষ্টি পানির উৎস কমে যাওয়ার কারণ চিহ্নিত করতে পারছে না। আমাদের নদীগুলো আন্তঃবিষয়ক নদীর ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে ভারত একতরফাভাবে কমন রিভার সিস্টেমগুলো থেকে শুষ্ক মৌসুমে পানি সরিয়ে নিয়ে যায়। ফলে লবণাক্ততা বাড়বে—এটাই স্বাভাবিক। জলবায়ুর ক্ষতিকর প্রভাবের কারণে সাগরের উচ্চতা বাড়ছে। ফলে উজানের দিকে লবণাক্ততার চাপটা বাড়ছে এবং মিষ্টি পানির উৎস কমছে।

সাব-জেলে অভিযুক্ত সেনা কর্মকর্তারা, সরকারের কাছে যে আহ্বান জানালেন ব্যারিস্টার আরমান

অসদাচারণের দায়ে টঙ্গী পাইলট স্কুলের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষকে শোকজ

জরুরি অবস্থা জারি করলেন পেরুর প্রেসিডেন্ট

গুম-খুনে জড়িত ১৫ সেনা কর্মকর্তা চাকরিচ্যুত। ট্রাইব্যুনালে হাজির। সাবজেলে প্রেরণ

এবার ১ টাকায় গরুর মাংস বিতরণের ঘোষণা সেই এমপি প্রার্থীর

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত