ময়মনসিংহের ভালুকায় পোশাক কারখানার শ্রমিক দিপু চন্দ্র দাস (২৭) হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার হওয়া ১২ আসামির তিন দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
সোমবার দুপুরে ময়মনসিংহের ৮ নম্বর আমলি আদালতের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শাহাদাত হোসেন এই আদেশ দেন। এর আগে পুলিশ আসামিদের পাঁচ দিনের রিমান্ড আবেদন করেছিল।
আদালত পুলিশের পরিদর্শক মোস্তাছিনুর রহমান বিষয়টি নিশ্চিত করে জানান, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য পরিকল্পনা, বহিরাগতদের সংগঠিত করার উৎস এবং উসকানিদাতাদের শনাক্ত করার চেষ্টা চলছে।
রিমান্ডে পাঠানো আসামিরা হলেন পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস (বিডি) লিমিটেড কারখানার ফ্লোর ইনচার্জ আলমগীর হোসেন (৩৮), কোয়ালিটি ইনচার্জ মিরাজ হোসেন (৪৬), শ্রমিক তারেক হোসেন (১৯), লিমন সরকার (২২), মানিক মিয়া (২০), এরশাদ আলী (৩৯) ও নিজুম উদ্দিন (২০), ভালুকা উপজেলার বাসিন্দা আজমল হাসান (২৬), আশিকুর রহমান (২৫), কাইয়ুম (২৫) ও শাহিন মিয়া (১৯) এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বাসিন্দা মো. নাজমুল (২১) রয়েছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, রিমান্ডে থাকা এই ১২ জনের মধ্যে অধিকাংশই ময়মনসিংহ জেলার বাইরের বিভিন্ন জেলার বাসিন্দা, যা ঘটনাটিকে স্বতঃস্ফূর্ত ধর্মীয় উত্তেজনা নয় বরং সংগঠিত সহিংসতা হিসেবে চিহ্নিত করছে।
ব্যক্তিগত বিরোধ ও শ্রমিক অধিকার আন্দোলনকে ধর্মীয় উসকানির রূপ দিয়ে দিপু চন্দ্র দাসকে প্রকাশ্যে হত্যা করা হয়েছে এমন অভিযোগ উঠেছে নিহতের পরিবার থেকে। দিপু চন্দ্র দাস জামিরদিয়া ডুবালিয়াপাড়া এলাকার পাইওনিয়ার নিটওয়্যারস (বিডি) লিমিটেড কারখানার শ্রমিক ছিলেন। তিনি তারাকান্দা উপজেলার বানিহালা ইউনিয়নের মোকামিয়াকান্দা গ্রামের রবি চন্দ্র দাসের ছেলে।
পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী, এটি কোনো হঠাৎ উত্তেজিত জনতার কাজ নয়। বরং পরিকল্পিতভাবে ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তৈরি করে তাকে হত্যার দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। ঘটনার পর নিহতের ভাই বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় অন্তত ১৫০ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, দিপু চন্দ্র দাস দীর্ঘদিন ধরে শ্রমিকদের ন্যায্য দাবি আদায়ে সোচ্চার ছিলেন। উৎপাদন বাড়ানো, ওভারটাইম, কাজের পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ে তিনি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলতেন। এতে মালিকপক্ষের সঙ্গে তার বিরোধ তৈরি হয়। অভিযোগ রয়েছে, এ কারণেই তাকে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং একপর্যায়ে চাকরি ছাড়তে চাপ দেওয়া হয়।
নিহতের পরিবার জানায়, গত ১৮ ডিসেম্বর রাতে দিপুকে জোরপূর্বক চাকরি ছাড়তে বলা হয়। তিনি রাজি না হওয়ায় তাকে ধর্ম অবমাননার মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেওয়া হয়। পরে সেই হুমকিই বাস্তবায়িত হয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঘটনার দিন কারখানার ভেতরে দিপুকে হুমকি ও মারধর করা হয়। এরপর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি চক্র বাইরে আগে থেকেই প্রস্তুত থাকা লোকজনকে খবর দেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই কারখানার সামনে শ্লোগান ও বিক্ষোভ শুরু হয়।
সবচেয়ে গুরুতর অভিযোগ হলো-এই পরিস্থিতিতে কারখানা কর্তৃপক্ষ থানা পুলিশকে অবহিত না করে মূল গেট খুলে দেয় এবং দিপু চন্দ্র দাসকে তথাকথিত বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে তুলে দেয়। এরপর একদল লোক তাকে পিটিয়ে হত্যা করে এবং মরদেহ গাছের ডালের সঙ্গে বেঁধে আগুন ধরিয়ে দেয়।
সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনায় দেখা গেছে, যাদের ‘বিক্ষুব্ধ জনতা’ হিসেবে দেখানো হয়েছে, তাদের কেউই আশপাশের এলাকার বাসিন্দা নন। অধিকাংশই ময়মনসিংহ জেলার বাইরের।
নিহতের বোন চম্পা দাস বলেন, “আমার ভাই বিএ পাস। সে সাধারণ বাটন ফোন ব্যবহার করত। ধর্ম নিয়ে তার যথেষ্ট জ্ঞান ছিল। সে নিয়মিত পামের বাসায় মুসলিম পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে আল কোরআনের বিভিন্ন সূরা মুখস্ত করতেন। নবীকে নিয়ে কটূক্তি করার মতো মানুষ সে নয়। শ্রমিক অধিকার নিয়ে কথা বলার কারণেই তাকে হত্যা করা হয়েছে।”
আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

