বীরাঙ্গনা সখিনার সমাধি ঘিরে ময়মনসিংহে পর্যটনের সম্ভাবনা

কামাল উদ্দিন, গৌরীপুর (ময়মনসিংহ)
প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৫, ১২: ০৭

ময়মনসিংহের গৌরীপুরে বীরাঙ্গনা সখিনার সমাধি। যেখানে আজও অমর হয়ে আছে তার প্রেমকাহিনি। ইতিহাসে বর্ণিত অপরূপ রূপবতী ও যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী সখিনার অমর স্মৃতি দেখতে এখনো প্রতিদিন ভিড় করে মানুষ। কবি-সাহিত্যিকরা এ নিয়ে অনেক গল্প, নাটক ও গীতিনাট্য তৈরি করলেও এ গৌরবগাথা অমর স্মৃতিচিহ্ন রক্ষায় প্রশাসনের নেই কোনো উদ্যোগ। এলাকাবাসী মনে করে, সরকারি বা বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এটি একটি সম্ভাবনাময় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে। নয়তো কালের গর্ভে হারিয়ে যাবে সপ্তদশ শতাব্দীর দেওয়ান উমর খাঁর মেয়ের এ অমর প্রেমের স্মৃতিচিহ্ন।

বিজ্ঞাপন

ছায়াঘেরা মায়াভরা প্রকৃতির নির্জন বনভূমিতে চিরনিদ্রায় শায়িত ইতিহাসখ্যাত কন্যা বীরাঙ্গনা সখিনা। ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৪ কিলোমিটার পূর্বদিকে মাওয়া ইউনিয়নের কুমড়ি গ্রামের পতিপ্রাণা এই মহীয়সী নারীর সমাধি সবার নজর কাড়ে। সমাধিস্থলে থাকা চাঁপা ফুলের সুবাস পথিককে আনমনা করে তোলে। তার স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে সখিনার যুদ্ধংদেহী শত্রু হন্তারক রূপ। শ্রদ্ধায় বিগলিত হয়ে শিরনি মানত করা ছাড়াও মাঝেমধ্যে বনভোজনের জন্য ভিড় করে দূরদূরান্ত থেকে আসা মানুষ।

উপজেলার মাওয়া ইউনিয়নের কেল্লাতাজপুরের দেওয়ান উমর খাঁর একমাত্র কন্যা সখিনা। সর্ববিদ্যায় পারদর্শী সখিনাকে এক পলক দেখার জন্য আকুল হয়ে ওঠে বারোভূঁইয়ার অন্যতম পরাক্রমশালী কিশোরগঞ্জ জেলার জঙ্গলবাড়ীর স্বাধীন শাসক ঈশা খাঁর দৌহিত্র ফিরোজ খাঁ। কিন্তু উমর খাঁর পরিবারের কঠোর পর্দাপ্রথা ফিরোজের প্রবল ইচ্ছা বা আকাঙ্ক্ষার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। ফলে আশ্রয় নেওয়া হয় কৌশলের। দরিয়া নামের এক সুন্দরী বাঁদিকে তসবি বিক্রেতা সাজিয়ে উমর খাঁর অন্তঃপুরে সখিনার বাসগৃহে পাঠানো হয়। দরিয়ার মুখে ফিরোজ খাঁর অসামান্য রুপ-গুণের কথা শুনে সদ্যযৌবনা সখিনা নিজের অজান্তেই মন-প্রাণ সঁপে দেন ফিরোজের চরণতলে।

প্রেমানলে দগ্ধ ফিরোজ খাঁ জঙ্গলবাড়িতে ফিরে এসে মা ফিরোজার সম্মতি নিয়ে বিয়ের প্রস্তাব পাঠান উমর খাঁর দরবারে। আভিজাত্যগর্বী কন্যাপক্ষ চরম ঘৃণাভরে সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। ফলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। লজ্জা-ঘৃণা ও ক্ষোভে ফিরোজ খাঁ বিশাল বাহিনী নিয়ে কেল্লাতাজপুরে অভিযান চালান। অতর্কিত আক্রমণে উমর খাঁর বাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে পরাজয় বরণ করলে সখিনা ইচ্ছার টানে, অনিচ্ছার ভানে ফিরোজ খাঁর সঙ্গে জঙ্গলবাড়িতে চলে আসেন। বিয়ের মধ্য দিয়ে উভয়ের অতৃপ্ত প্রেম পূর্ণতা পায়।

এদিকে সময়ের ব্যবধানে প্রতিশোধস্পৃহায় উন্মত্ত পরাজিত সখিনার বাবা উমর খাঁ সম্মিলিত বাহিনী নিয়ে প্রতিআক্রমণ চালালে জঙ্গলবাড়ির সৈন্যদের পরাজয় হয়। বন্দি হন ফিরোজ খাঁ। সখিনাকে তালাক দেওয়ার জন্য ফিরোজ খাঁর ওপর চলে চাপ প্রয়োগ। তার সাফ কথা— জীবন থাকতে প্রেমের অমর্যাদা করে সখিনাকে তালাক দেবেন না তিনি। এ সময়ে হঠাৎ যুদ্ধের ময়দানে আবির্ভূত হলো সতের-আঠার বছর বয়সি এক অনিন্দ্যকান্তি যুবকের। তার তরবারিতে যেন বিদ্যুৎ ঝলকাচ্ছে। তারই নেতৃত্বে ফিরোজ খাঁর বিপর্যস্ত বাহিনী পুনরায় ঘুরে দাঁড়ায়। ক্ষ্যাপা নেকড়ের মতো তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে শক্রসৈন্যের ওপর। দুর্ধর্ষ আক্রমণে উমর খাঁর বাহিনী যখন বিপন্নপ্রায়, এমন সময়েই ঘটল সেই নিন্দনীয় ঘটনা, যা ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত। পরাজয় নিশ্চিত জেনে উমর খাঁর জনৈক উজিরের কুমন্ত্রণায় যুদ্ধক্ষেত্রে রটিয়ে দেওয়া হলো—‘যাকে ঘিরে এই যুদ্ধ সেই সখিনাকে তালাক দিয়েছেন বন্দি ফিরোজ খাঁ’। ফিরোজ খাঁর জাল স্বাক্ষরযুক্ত প্রতারণাপূর্ণ তালাকনামাসহ যুদ্ধ বন্ধের নির্দেশপত্র পৌঁছায় ওই যুবকের হাতে। মুহূর্তে পাল্টে গেল যুদ্ধের ভাব-গতি। যুবক সেনাপতির মাথা ঘুরছে, দেহ কাঁপছে, গলা শুকিয়ে যাচ্ছে, ঘোড়ার লাগাম খসে পড়ছে আর তরবারির হাত হয়ে গেছে স্থবির। আস্তে আস্তে নিথর দেহটি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। শিরোস্ত্রাণ খসে পড়ে বেরিয়ে আসে তার মেঘবরণ অপূর্ব কেশরাশি। অবাক বিস্ময়ে সবাই দেখে এতক্ষণ যে যুবক সেনাপতি অভূতপূর্ব রণকৌশলে যুদ্ধ করছিল সে আর কেউ নয়— উমর খাঁর আদুরের দুলালী সখিনা।

খবর পেয়ে ছুটে এলেন পিতা। কলিজার টুকরো কন্যার প্রাণহীন দেহ কোলে নিয়ে উন্মাদের মতো বিলাপ করলেন। সে ক্রন্দনে জঙ্গলবাড়ির বাতাস কী পরিমাণ ভারী হয়েছিল জানা না গেলেও এই কাহিনি শুনে পূর্ববঙ্গবাসীর অন্তর আজও সিক্ত হয়ে ওঠে।

জানা যায়, পতিপ্রাণা সেই বীর মহীয়সী নারী সখিনাকে কেল্লাতাজপুরের কুমড়ি গ্রামে সমাহিত করা হয়। অন্যদিকে শোকে মুহ্যমান উমর খাঁ তার জামাতা ফিরোজ খাঁকে মুক্ত করে দেন। বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে ফিরোজ যেন বাকপ্রতিবন্ধী হয়ে গেলেন। প্রিয়তমার প্রয়াণে রাজপাট চুকিয়ে একবস্ত্রে গৃহত্যাগ করেন তিনি ।

এলাকাবাসী দেখে প্রতিদিন সন্ধ্যায় এক সৌম্যকান্তি মৌনী দরবেশ সখিনার সমাধিতে সন্ধ্যাপ্রদীপ জ্বেলে নিশ্চল বসে থাকেন। সন্ধ্যা গড়িয়ে অন্ধকার গাঢ় হয়, নিশুতি রাতের নৈঃশব্দ গ্রাস করে চারপাশ। তখনও সে আনমনা ফকির স্ত্রীর চোখে সমাধির দিকে অপলক চেয়ে থাকেন। কালে জানা গেল তিনিই বীরাঙ্গনা সখিনার স্বামী ফিরোজ খাঁ। প্রেমিকার সমাধিতে প্রতি সন্ধ্যায় প্রদীপ জ্বেলে হয়তো প্রেমঋণ শোধের চেষ্টা করে গেছেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত।

দেওয়ান উমর খাঁর কেল্লাতাজপুর আজ অবহেলিত এক জনপদ। এ গৌরবগাথা রক্ষায় প্রশাসনের নেই কোনো উদ্যোগ। স্থানীয়রা জানায়, গত ২০০৭-০৮ অর্থ-বছরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ কে এম ইহসানুল হকের প্রচেষ্টায় এর সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী সরকারের মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীরা এটি পরিদর্শনে এসে নানা আশ্বাস দিলেও কাজের কাজ হয়নি কিছুই।

এলাকাবাসী মনে করে, সরকারি বা বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এটি একটি সম্ভাবনাময় সফল পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত হতে পারে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত