৫৬ দিন বিবস্ত্র রাখে র‌্যাব, মাথা চুবায় পানিতে

আব্দুল কাইয়ুম, ময়মনসিংহ
প্রকাশ : ২৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১৬: ৪৪

ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার নটাকুঁড়ি গ্রামের মোস্তফা কামাল, একজন সাধারণ পোশাকশ্রমিক। ২০১৬ সালে র‌্যাবের হাতে গুম হওয়ায় পর তার জীবনের ৯৬টি দিন, এক বিভীষিকাময় দুঃস্বপ্নের মতো কেটেছে।

মোস্তফাকে গুমের প্রথম ৫৬ দিন উলঙ্গ রেখে কখনো কিছু সময় পানিতে মাথা ডুবিয়ে রাখত, শরীরে কারেন্টের শক, ভারী বস্তা দিয়ে বুকে চাপ, হাত বেঁধে ঝুলিয়ে ও প্লাস দিয়ে নখে চাপ দিয়ে নির্যাতন করত র‌্যাব সদস্যরা। এগুলো শুধু একদিন বা এক সময়ের কথা নয়, ছিল প্রতিদিনের ভয়ংকর বাস্তবতা।

বিজ্ঞাপন

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৬ সালে নারায়ণগঞ্জের একটি টেক্সটাইল কারখানায় শ্রমিক হিসেবে যোগ দেন মোস্তফা। কিন্তু ১৪ নভেম্বর ডিউটি শেষে যখন বাসায় ফিরছিলেন, তখন হঠাৎ তার সামনে এসে একটি গাড়ি থামে এবং সাদা পোশাকের তিন লোক তাকে থানায় নেওয়ার কথা বলে জোরপূর্বক গাড়িতে তুলে নেয়।

সঙ্গে সঙ্গে তার চোখ বেঁধে দুই হাত পেছনে নিয়ে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে দেওয়া হয়। গাড়ির ভেতরেই মোস্তফাকে জঙ্গি বলে স্বীকার করতে চাপ দেওয়া হয় এবং ১০ লাখ টাকার প্রলোভনও দেখানো হয়। অন্যথায় তাকে দেওয়া হয় ক্রসফায়ারে হত্যার হুমকি।

কিন্তু জঙ্গি হিসেবে স্বীকার করে না নেওয়ায় গাড়ির ভেতরেই লাথি দেওয়া হয় মোস্তফাকে; যে কারণে সঙ্গে সঙ্গেই বমি করেন তিনি। অসুস্থ মোস্তফা তখন তাদের পরিচয় জানতে চাইলে তারা নিজেদের শেখ হাসিনার সৈনিক বলে পরিচয় দেন এবং আবারও লাথি দিয়ে সিটের নিচে মাথা ঢুকিয়ে দেন।

মোস্তফা বলেন, দীর্ঘসময় চলার পর গাড়িটি থামে এবং একজন অফিসারের সামনে আমি যেন নিজেকে জঙ্গি স্বীকার করে নিই, সেজন্য আবার প্রলোভন দেখানো হয়। কিন্তু স্বীকার না করায় আমাকে একটি টর্চার সেলে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে চোখের কাপড় সরিয়ে একটি লম্বা মেশিন দেখানে হয় এবং বলা হয় স্বীকার না করলে সেখানে ঝোলানো হবে।

তারপরও স্বীকার না করায় দু’হাত গামছা দিয়ে বেঁধে গামছার ওপর হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে মোস্তফাকে মেশিনে ঝোলানো হয়। তিনি বলেন, ঝোলানোর পর একজন ‘হু’ বলার সঙ্গে সঙ্গে আমার ওপর নির্যাতন শুরু হয়। নিচে নামিয়ে চোখে মুখে স্প্রে দেওয়ার পর আবারও জঙ্গি হিসেবে স্বীকার করতে বলা হয়। কিন্তু আমি অস্বীকার করলে এবার আমাকে কারেন্টের শক দেওয়া হয়।

এ পোশাকশ্রমিক বলেন, পরে একজন অফিসার বলেন, তোর স্ত্রীকে আমার সৈনিকরা তুলে নিয়ে আসছে। তুই নিজেকে জঙ্গি হিসেবে স্বীকার না করলে তোর স্ত্রীকে আমরা ধর্ষণ করব। তারপরও স্বীকার না করায় ৫৬ দিন পর্যন্ত উলঙ্গ করে রাখা হয় আমাকে। কয়েকদিন পরপর একেকজন এসে জঙ্গি হিসেবে স্বীকার করে নেওয়ার জন্য বলত, না হয় উলঙ্গ ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিত।

এ ৫৬ দিনের নির্যাতনের কারণে মোস্তফা গুরুতর অসুস্থ হন। তবে মোস্তফা জানান, তাকে গুমখানার ভেতরে ডাক্তাররা চিকিৎসা দিয়েছেন। একটু সুস্থ হলে তাকে শার্ট-প্যান্ট পরতে দেওয়া হয়।

অবশেষে ৯৬ দিন পর কয়েকজন সাদা পোশাকধারী মোস্তফার সেলের সামনে যায় এবং তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে জানায়। তিনি বলেন, যখন খাবারের জন্য চোখ খুলে দেওয়া হয়, তখন কম্বলের সঙ্গে র‌্যাব-১ লেখা একটি কাপড়ের স্টিকার দেখতে পাই। পরে আমাকে র‌্যাব-১ থেকে নিয়ে যাওয়া হয় নারায়ণগঞ্জ র‌্যাব-১১তে।

পরদিন র‌্যাব-১১-এর সদস্যরা মোস্তফাকে গাড়িতে তোলেন এবং ফজরের নামাজের সময় একটা ব্রিজের কাছে নিয়ে যান এবং তার চোখ থেকে কালো কাপড় খুলে ফেলেন। তখন তার পাশে অপরিচিত আরো দু’জনকে দেখতে পান মোস্তফা। তখন মোস্তফাসহ সঙ্গে থাকা দু’জনকে র‌্যাব সদস্যরা গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে লোকজনকে ডেকে বলে এখানে জঙ্গি পাওয়া গেছে।

মোস্তফা বলেন, ৯৬ দিন পর্যন্ত যে ঘরে আমাকে রাখা হয়েছিল, সেই ঘরে কোনো জানালা ছিল না। প্রথম দিন খাবারের সময় যখন চোখ খুলে দিয়েছিল, তখন ঘরের রং দেখে আমি ভয় পাই। ঘরটি মাত্র দেড় হাত জায়গা নিয়ে ছিল। কোনোমতে থাকতে পারছি।

এ পোশাকশ্রমিক বলেন, খাওয়া, গোসল ও বাথরুমে যাওয়ার সময় ছাড়া সারাক্ষণ চোখ বাঁধা থাকত, হাত পেছনে নিয়ে হ্যান্ডকাফ লাগিয়ে রাখত। যখন অন্যদের মারধর করত, তখন প্রচুর কান্নাকাটির শব্দ শুনতে পেতাম। আর মারধরের সময় উচ্চশব্দে হিন্দি গান বাজত। কয়েকদিন পরপর আমাকে বড় কর্মকর্তাদের সামনে নিয়ে যেতেন। তখন র‌্যাবের কর্মকর্তারা বলতেন, ‘মোস্তফা তুমি স্বীকার করো যে, তুমি জেএমবি সদস্য, এ কথা বললেই তোমাকে আমরা অনেক কিছুর ব্যবস্থা করে দেব, তোমাকে আমরা ছেড়ে দেব, তোমাকে বাড়ি করে দেব।’

মোস্তফা বলেন, একদিন আমার গোঁফ কাটতে দাঁড়িওয়ালা এক লোক আসে। তখন সে বলে, ভাই আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারলাম না। সরকারের নির্দেশে র‌্যাব এসব কাজ করছে। তোমার মতো গ্রামের এক কলা ব্যবসায়ীকেও গতকাল ধরে আনছে। একজন বলে, এখন তোকে আদালতে একজনের সামনে নিয়ে যাব এবং সেখানে বলবি তুই জঙ্গি, তাহলেই তোকে ছেড়ে দেব। তখন আমি বলি আপনারা আমাকে জোর করে জঙ্গি হিসেবে স্বীকার করাতে চাচ্ছেন, তা পারবেন না। তখন তারা আবারও চড়থাপ্পড় ও লাথি দেয়।

পরে মোস্তফাকে সাদা পোশাকধারী কয়েকজন আদালতে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নিয়ে যায়। তিনি বলেন, ম্যাজিস্ট্রেট আমার নাম-ঠিকানা জিজ্ঞেস করে, তখন আমি বলি, স্যার আমি একজন শ্রমিক। আমাকে ধরে এনে ৯৬ দিন ধরে গুম করে রাখছে। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ম্যাজিস্ট্রেট বলেন- এই, একে কে নিয়ে আসছে, নিয়ে যান! পরে আমাকে তারা আবারও নিয়ে যায়। পরে তারা আমাকে বলে এবার শ্বশুরবাড়ি যা, এভাবেই আমাকে জেলে পাঠান।

মোস্তফা আরো বলেন, আমি যখন গুম ছিলাম, তখন আমার বাবা, ভাই ও স্ত্রী বারবার সোনারগাঁও ও মুক্তাগাছা থানায় গিয়েছিল জিডি করতে, কিন্তু জিডি নেওয়া হয়নি। ৯৬ দিন পর যখন সোনারগাঁও থানায় নেওয়া হয়, তখন আমি শাহ আলম নামে এক অফিসারকে অনুরোধ করে বলি যে, আমাকে ৯৬ দিন ধরে গুম করেছিল র‌্যাব। আমার পরিবারের সদস্যরা চিন্তায় আছে। একটু ফোন দিয়ে বলতে পারবেন? পরে আমার শাশুড়ির নম্বরে কল দিয়ে বলি, র‌্যাব আমাকে গুম করেছিল, এখন আমি সোনারগাঁও থানায় আছি। পরে পরিবারের সদস্যরা থানায় গিয়ে না পেয়ে জেলে গিয়ে সাক্ষাৎ করে।

মোস্তফা জানান, মিথ্যা মামলা পরিচালনা করে এখন ক্লান্ত হয়ে গেছেন তিনি। শেষ সম্বল জমি বিক্রি করে হাইকোর্ট থেকে মামলায় জামিন নিয়েছেন এবং হাজিরা দিচ্ছেন। মামলার খরচের জন্য জমি বিক্রির পর স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে থাকার মতো জায়গা নেই। তাকে র‌্যাব সর্বহারা করেছে। তিনি এখন শারীরিকভাবে অক্ষম। তার কোমর ও হাঁটুর হাড় ভেঙে দিয়েছে র‌্যাব।

সরেজমিনে দেখা যায়, মোস্তফা, তার স্ত্রী, তিন সন্তান একটি মাটির ঘরে বসবাস করেন, যে জায়গাটি তাদের নিজস্ব নয়। চুলা না থাকায় পাশের বাড়ির চুলায় রান্না করতে হয় মোস্তফার পরিবারকে। অসুস্থতার কারণে মোস্তফার স্ত্রী বিছানায়। মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের সহায়তায় মোস্তফার স্ত্রীর অপারেশন হয়।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত