‘আয়নাঘরের নাম শুনেছি, কিন্তু বুঝলাম সেদিন’

জহুরুল ইসলাম, পাবনা
প্রকাশ : ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১৩: ০৯

‘মেস থেকে বেরিয়ে কলেজে যাওয়ার পথে আমাকে গাড়িতে তুলে নেন কিছু লোক। এরপর চোখ-হাত বেঁধে কোথায় যেন নিয়ে যান। দুই জায়গায় স্থানান্তর করা হয়। কিছুই বুঝতে পারিনি। এর মাঝে আমাকে একটা ছোট্ট ঘরে আটকে রাখা হতো।

আয়নাঘরের নাম শুনেছি, কিন্তু বুঝলাম সেদিন। যখন চোখ খোলা হলো তখন বুঝলাম আমি র‌্যাবের হাতে আটক। সবশেষ আমাকে জঙ্গি আখ্যা দিয়ে থানায় সোপর্দ করে র‌্যাব। ৫ আগস্ট ছাত্র জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আমাকে কারাগার থেকে জামিন দেওয়া হয়।’

বিজ্ঞাপন

এভাবেই নিজের সেই দুর্বিষহ দিনের কথা বলছিলেন কলেজ শিক্ষার্থী ২১ বছর বয়সী আব্দুল আহাদ ইসলাম। তিনি পাবনার ফরিদপুর উপজেলার আগজন্তিহার গ্রামের গোলাম মওলার ছেলে। চার ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট। পাবনার সরকারি শহিদ বুলবুল কলেজের বিএ (অনার্স) গণিত বিভাগের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী তিনি।

কেন তাকে এভাবে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হলো। কি অপরাধে তাকে জঙ্গি সদস্য বানানো হলো। তা আজও জানেন না আহাদ। তবে তার ওপর হওয়া নিষ্ঠুর আচরণের বিচার চান তিনি।

আহাদ বলেন, গত বছরের ১৬ জুন সকাল সাড়ে নয়টার দিকে হেঁটে কলেজে যাচ্ছিলাম। পথে শালগাড়িয়া মালিগলি স্কুলের পশ্চিম পাশে পৌঁছাতেই পাঁচ থেকে সাতজন লোক একটি সাদা রঙের হায়েস মাইক্রোবাস নিয়ে আমাকে তুলে চোখ বেঁধে অজানা স্থানে নিয়ে যান। এ ঘটনার পর বিভিন্ন স্থানে খোঁজাখুঁজি করে না পেয়ে পরদিন ১৪ জুন পাবনা সদর থানায় অপহরণ মামলা করেন আমার বড় ভাই বকুল হোসেন।

এই শিক্ষার্থী বলেন, বাঁধা অবস্থায় চোখের কাপড় তুলে দেখি আমি পাবনা র‌্যাব অফিসে। তখন বুঝলাম আমাকে র‌্যাব তুলে এনেছে। পাবনা কার্যালয়ে আটকে রাখে সন্ধ্যা পর্যন্ত। এরপর সন্ধ্যার পর পাবনা থেকে ঢাকায় র‌্যাব-১ কার্যালয়ে নেয়া হয়। সেখানে ছোট্ট একটা ঘরে রাখা হয়। যেন আয়নাঘরের মতো। কোনো দিকে হাত-পা নাড়াচাড়া করা যেতো না। একজন মানুষ শুয়েও থাকা যায় না। তখন বুঝলাম আয়নাঘর কি জিনিস। শরীরের লোম শিউরে উঠেছিল। টয়লেটে যেতে বা অজু করার জন্য হাত, চোখ খুলে দিতে অনুরোধ করলে তারা খুব মারধর করতো।

চোখ ছলছল করে ওঠে আব্দুল আহাদের। দম নিয়ে আবার শুরু করেন। বলেন, এরপর সেখানে আগে থেকে আটক আরেক তরুণ পঞ্চগড়ের আসাদুজ্জামান আসিফের সঙ্গে আমাকে রাতের কোনো এক সময় ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে র‌্যাব-৭ এর কার্যালয়ে নেয়া হয়। সেখানে যাওয়ার পর আমাদের চোখ বাঁধা অবস্থায় র‌্যাব থেকে জানতে চাওয়া হয় আমরা কোথায়। তখন আমি বলি সম্ভবত ঢাকায়। এটা বলে চোখ খুলে দিলো। তখন চারদিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি সেটা র‌্যাব-৭ চট্টগ্রামের কার্যালয়। এরপর বলে তোমাদের ধরে আনা হলো কেন। আমরাও তাদের অনেক প্রশ্ন করেছি, আমাদের কেন ধরে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু তারা শুধু বলে আমাদের একটা ভাই আছে, তোমাদের তিনটা প্রশ্ন করেই ছেড়ে দিবে। আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল আমি কোনো দল করি কিনা। তখন আমি বলেছিলাম, আমি গরিব ঘরের ছেলে। কোনো দল করি না। একটা স্কুলে চাকরি করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালাই। তারা আমাদের নাম ঠিকানা লিখে নেয়।

আহাদ বলেন, ১৪ জুন দুপুরের পর আমাদের দুজনকে নিয়ে অফিসের কক্ষের বাইরে সংবাদ সম্মেলনে হাজির করা হয়। সেখানে সাংবাদিকদের সামনে আমাদের দুজনকে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের সদস্য হিসেবে পরিচয় দেয় র‌্যাব। সেখানে বলা হয়, আমাদের চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানার শিকলবাহা ইউনিয়নের ভেল্লাপাড়া ব্রিজের পশ্চিমপাশে পরিত্যক্ত একতলা ভবনে অভিযান চালিয়ে আমাদের গ্রেফতার করেছে। আমাদের কাছ থেকে জিহাদি বই, লিফলেট, মোবাইল উদ্ধার করেছে বলে জানানো হয়। অথচ আমরা দুজন কেউ কাউকে চিনি না, কোনোদিন দেখিনি। পরে আমাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা করে কর্ণফুলী থানায় সোপর্দ করে র‌্যাব। এরপর আদালত হয়ে কারাগারে।

আহাদ বলেন, র‌্যাব থেকে থানায় সোপর্দ করার পর আমার পরিবার জানতে পারে আমি সেখানে আছি। পরিবারের লোকজন চট্টগ্রামে গিয়ে জামিনের চেষ্টা করলেও হয়নি। এর মাঝে মামলায় আমাকে তিনদিনের রিমান্ডে নিয়েছিল পুলিশ। রিমান্ডে আমাদের জোর করে জঙ্গি সদস্য হিসেবে স্বীকারোক্তি নেয়া হয়।

ছাত্র জনতার আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ১২ আগস্ট আমাদের জামিন দেয় আদালত। আর ১৩ আগস্ট কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয় আমাদের দুজনকে। পরে জানতে পারি আমাদের দুজনের বিরুদ্ধে মামলাটি করেছেন চট্টগ্রামের চান্দগাঁও সিপিসি-৩, র‌্যাব-৭ এর ডিএডি রেজাউল ইসলাম (বিজিবি)। আর কর্ণফুলী থানার পরিদর্শক মেহেদি হাসান মামলাটি নিয়ে তদন্তের জন্য থানার এসআই আবুল কালামকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

তিনি বলেন, এই মিথ্যা ও বানানো মামলা থেকে আমি ও পঞ্চগড়ের আসিফ মুক্তি চাই। আর অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

বিষয়:

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত