গুরুদাসপুর পৌরসভা চুষে খাচ্ছে মেয়রের অনুসারীরা

নাটোর ও গুরুদাসপুর প্রতিনিধি
প্রকাশ : ১০ মার্চ ২০২৫, ১৪: ২৩

নাটোরের গুরুদাসপুরে আছে অদ্ভুত পৌরসভা। ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে ছোঁয়া লাগেনি উন্নয়নের। কিন্তু লোকবল নিয়োগ হয়েছে মেয়রদের খেয়ালখুশিমতো। আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট হলেই দেওয়া হয়েছে রাজস্বের অধীনে পদ, পুনর্বাসন করা হয়েছে আত্মীয়স্বজন। এভাবে জনপ্রতিনিধিদের পকেট ভরলেও শুধু লাভের গুড় কপালে জোটেনি পৌরবাসীর। উল্টো বছরে বছরে বাড়তি করের বোঝা বহন করছেন তারা।

স্থানীয়রা জানান, অনিয়ম-দুর্নীতি ও লুটপাটে খোকলা হয়ে যাওয়া গুরুদাসপুর পৌরসভা ‘ক’ শ্রেণিতে উন্নত হয়েছে ২০০৫ সালে। এই শ্রেণির কোনো বৈশিষ্ট্য না থাকলেও গ্রেড পরিবর্তন করা হয়েছে শুধু লোকবল বাড়ানোর অসৎ উদ্দেশ্যে। ১১ বর্গকিলোমিটার আয়তনের পৌর এলাকায় বসবাস করেন ৩০ হাজারের মতো মানুষ। তাদের সেবায় ৭২ জন কর্মী রয়েছে রাজস্ব বিভাগের অধীনে। সদ্য অবসরে গেছেন দুজন। এ ছাড়া চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে আরো ৪২ জনকে। অথচ প্রায় দ্বিগুণ জনসংখ্যা হলেও সদর পৌরসভায় লোকবল ৩২ ও সিংড়ায় ৪০ জন।

বিজ্ঞাপন

পৌরবাসীর অভিযোগ, প্রতিষ্ঠার ৩৫ বছরে উল্লেখযোগ্য কোনো উন্নয়ন হয়নি গুরুদাসপুর পৌরসভায়। ময়লা ফেলার জন্য নেই ডাম্পিং স্টেশন। সব বর্জ্য নিক্ষেপ করা হচ্ছে নন্দকুজা নদীতে। রাস্তাঘাট, কালভার্ট ব্রিজের উন্নয়নও হয়নি। সব অবকাঠামো শুধু জোড়াতালি দিয়ে ভালো দেখানো হয়েছে। দফায় দফায় কর বাড়িয়ে নামে-বেনামে আত্মসাৎ করা হয়েছে পৌর তহবিল। এখন পরিস্থিতি এতটাই প্রকট হয়েছে যে ২৮ মাস ধরে কর্মীদের বেতন-ভাতা বন্ধ রয়েছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, এ পৌরসভায় মশিউর রহমান বাবলু দুই মেয়াদ, আমজাদ হোসেন এক মেয়াদ ও সর্বশেষ শাহনেওয়াজ আলী মোল্লা টানা তিন মেয়াদে মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন। তাদের সময় পৌরবাসীর উন্নয়ন না হলেও পকেট ভরে তাদের সবার। অনিয়ম-দুর্নীতি ও নিয়োগ বাণিজ্য ছিল রমরমা।

পৌরসভায় টিকাদান কেন্দ্র না থাকলেও এ খাতে সুপারভাইজার পদে ২, ইন্সপেক্টর ১, ভিজিটর ১ ও টিকাদানকারী ২ জন মিলে সংশ্লিষ্ট পদে ৬ জনকে নিয়োগ দেওয়া রয়েছে। কোনো শিল্প-কারখানা না থাকলেও মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ দেওয়া রয়েছে। এভাবে নতুন নতুন পদ তৈরি করে পুনর্বাসন করা হয়েছে আত্মীয়স্বজন ও দলীয় অনুসারীদের। এমনো কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী আছেন তারা নিজেরাও জানেন না যে তাদের পদ বা কাজ কী।

শাহনেওয়াজ আলী মোল্লা টানা তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালনকালে সবচেয়ে বেশি আত্মীয়স্বজন ও দলীয় কর্মী নিয়োগ দিয়েছেন। এর মধ্যে তার দুই ভাই এমদাদুল হক ও তারিকুল ইসলাম, ভাগিনা এস এম কামরুল হাসান রহিম, ভগ্নিপতি, শ্যালকসহ বেশ কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী রয়েছেন।

পৌরসভার নথিপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রাজস্ব খাতের ৭২ জন ও চুক্তি ভিত্তিক ৪২ কর্মচারী মিলে ১১৪ কর্মীকে বেতন দিতে বছর ৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা খরচ করতে হয়। অথচ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রাজস্ব খাতে আয় হয়েছে ৪ কোটি ২৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে ৪৬ লাখ টাকা। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দিতে হয়েছে ৩ কোটি ৪৫ লাখ টাকা এবং মেয়র ও কাউন্সিলরদের সম্মানীভাতাসহ বিভিন্ন কাজে বাকি টাকা ব্যয় হয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত রাজস্ব খাতে আয় হয়েছে দুই কোটি ৩৫ লাখ টাকা। অথচ তিন মাস পরেই শুধু বেতনই গুনতে হবে প্রায় সাড়ে তিন কোটি টাকা।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন বলেন, এই পৌরসভায় উন্নতি হয়েছে শুধু মেয়র, কয়েকজন কাউন্সিলর ও কিছু কর্মচারী। তারা বেতন না পেলেও গড়েছেন প্রাসাদসম বাড়ি, কিনেছেন দামি দামি গাড়ি। পৌর এলাকায় ৩০ হাজার নাগরিকের জন্য নেই কোনো বিনোদনের জায়গা ও কমিউনিটি সেন্টার। রাস্তাঘাট, ড্রেন, কালভার্ট নির্মাণ হয় না দীর্ঘদিন ধরে। যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনায় ফেলায় দুর্গন্ধে মানুষ অতিষ্ঠ। ভ্যাট-ট্যাক্স বাড়ানো হলেও বাড়েনি নাগরিক সেবা।

নাম প্রকাশ না করে কয়েক কর্মচারী বলেন, লুটপাটের জন্য ‘ক’ শ্রেণির পৌরসভা বানিয়ে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও আত্মীয়স্বজনকে পুনর্বাসন করেছেন মেয়র-কাউন্সিলররা। ১১৪ জন কর্মীর অধিকাংশেরই কোনো কাজ নেই। অনেকে নিয়মিত অফিসেও আসেন না। কেউ কেউ শুধু হাজিরা দিয়ে চলে যান। কিন্তু মাসে মাসে তাদের জন্য প্রায় ২৮ লাখ টাকা তরে বেতন দিতে হয়। এর জন্য করের বোঝা বাড়ানো হয় পৌরবাসীর ওপর। এভাবে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হওয়ায় দুই বছরের বেতন বাকি পড়েছে। সেই বকেয়া বেতন-ভাতা দাবিতে নিয়মিত আন্দোলন করছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

এরই মধ্যে গত ৮ জানুয়ারি পৌর প্রশাসকের দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাহমিদা আফরোজ। তিনি এরই মধ্যে চার মাসের বেতন পরিশোধ করেছেন। কিন্তু তার ওপর অব্যাহতভাবে চাপ প্রয়োগ করায় স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।

পৌর নির্বাহী কর্মকর্তা হাসান আলী বলেন, নাটোর জেলার অন্য কোনো পৌরসভায় এত লোকবল নেই। অথচ তাদের জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। তাই বেতন নিয়েও কোনো সমস্যা হয় না।

পৌর প্রশাসক ফাহমিদা বলেন, পৌরসভার বেতন দেওয়ার সামর্থ্য না থাকলেও অতিরিক্ত লোক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ কারণে দীর্ঘদিনের বকেয়া বেতন পরিশোধ করা সম্ভব নয়। কিন্তু নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেভাবে আন্দোলন করছেন তাতে এই পৌরসভার কার্যক্রম যেকোনো মুহূর্তে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত