আমার দেশ জনপ্রিয় বাংলা নিউজ পেপার

পেঁয়াজ–রসুনের চাষে আশার বীজ বুনলেও সার সংকটে দুশ্চিন্তায় কৃষক

উপজেলা প্রতিনিধি, নলডাঙ্গা (নাটোর)

পেঁয়াজ–রসুনের চাষে আশার বীজ বুনলেও সার সংকটে দুশ্চিন্তায় কৃষক
ছবি: আমার দেশ।

রোদে পোড়া খোলা মাঠ। শক্ত মাটির ওপর বসে একজন কৃষক আর তার কিশোর সন্তান, হাতে হাতে রসুনের কোয়া পুঁতে চলেছেন। পাশে রাখা একটি ধাতব বাটি—সেখানেই বীজ। কোনো কথাবার্তা নেই, নীরব মনোযোগে চলছে কাজ। ছবির এই দৃশ্য নাটোরের নলডাঙ্গা উপজেলার একেবারেই চেনা বাস্তবতা। এখানে কৃষিকাজ শুধু ফসল ফলানোর গল্প নয়—এটি একটি পরিবারের টিকে থাকার নিরব সংগ্রাম।

হালকা শীতের আমেজ, ভোরের কুয়াশা আর কোমল রোদের সঙ্গে সঙ্গে নলডাঙ্গার মাঠে মাঠে শুরু হয়েছে পেঁয়াজ ও রসুন লাগানোর মৌসুম। লাঙল–জোয়াল আর কোদালের শব্দে মুখর হয়ে উঠছে গ্রামবাংলা। নতুন মৌসুম মানেই কৃষকদের চোখে নতুন স্বপ্ন—ভালো ফলন, ন্যায্য দাম আর সংসারে একটু স্বস্তি।

বিজ্ঞাপন

মাঠজুড়ে ব্যস্ততা, কৃষকের চোখে প্রত্যাশা

নলডাঙ্গা উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে এখন চাষাবাদের ব্যস্ততা চোখে পড়ার মতো। কেউ জমি প্রস্তুত করছেন, কেউ বীজতলা বানাচ্ছেন, আবার কেউ স্ত্রী–সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে জমিতে পেঁয়াজ ও রসুনের কোয়া রোপণ করছেন।

কৃষকরা জানান, চলতি মৌসুমে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় আগাম চাষে আগ্রহ বেড়েছে। সঠিক সময়ে চাষ করতে পারলে ফলন ভালো হয় এবং বাজারে তুলনামূলক ভালো দাম পাওয়া যায় এই প্রত্যাশাই তাদের মাঠে নামিয়েছে।

নলডাঙ্গা উপজেলার কৃষক মোঃ ইউছুফ আলী বলেন, গত বছর পেঁয়াজের দাম ভালো ছিল। তাই এবার জমির পরিমাণ বাড়িয়েছি। আবহাওয়া ঠিক থাকলে লাভের আশা করছি।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সূত্রে জানা যায়, চলতি মৌসুমে নলডাঙ্গা উপজেলায় কয়েক হাজার একর জমিতে পেঁয়াজ ও রসুন চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। উন্নত জাতের বীজ ব্যবহার, সময়মতো সার প্রয়োগ এবং রোগবালাই দমনে কৃষকদের নিয়মিত পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।

সার সংকটে কৃষকের দীর্ঘশ্বাস

তবে মাঠের এই কর্মচাঞ্চল্যের মাঝেই কৃষকদের কণ্ঠে শোনা যাচ্ছে দীর্ঘশ্বাস। ডিলারদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সার না পাওয়ায় অনেকেই কাঙ্ক্ষিতভাবে চাষাবাদ করতে পারছেন না। ডিলার পর্যায়ে অনিয়মের অভিযোগে খুচরা বাজারে অতিরিক্ত দাম ও ওজনে কম দেওয়ার ঘটনায় ছোট ও মাঝারি কৃষকেরা পড়েছেন চরম চাপে।

নলডাঙ্গা উপজেলার কৃষক মো. সোহেল হোসেন বলেন, ডিলাররা তাদের পছন্দের লোকদেরই সার দিচ্ছে। আমার চার বিঘা জমি আছে, কিন্তু সার না পেয়ে ঠিকমতো চাষ করতে পারছি না। খুচরা বাজারে বস্তাপ্রতি ২২০০ টাকা দিতে হয়, যা সরকারি মূল্যের চেয়ে প্রায় ১০০০ টাকা বেশি। তাও আবার ওজনে ৪–৫ কেজি কম। আমরা রসুন বিক্রি করি মণপ্রতি ১৫০০–১৬০০ টাকায়—এভাবে চাষ করে লাভ থাকে না।

আরেক কৃষক মামুনুর রশিদ মোল্লা বলেন, পেঁয়াজ চাষে সার ছাড়া চলে না। কিন্তু সাধারণ কৃষক সার পায় না। খুচরা বাজারে দাম বেশি, বিশ্বাসও নেই। বছরে একবার ভালো ফলন না হলে সংসার চালানোই কঠিন হয়ে যায়।

কৃষকদের আশঙ্কা, সময়মতো সার সংকট সমাধান না হলে পেঁয়াজ ও রসুনের আবাদ ব্যাহত হবে। এর প্রভাব পড়তে পারে সামনের বাজারেও—সরবরাহ কমে গেলে দাম বাড়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।

তারা দাবি জানান, সার বিতরণে ডিলারদের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, উপজেলা প্রশাসন ও কৃষি বিভাগের মাঠপর্যায়ের নজরদারি বাড়াতে হবে এবং খুচরা বাজারে অতিরিক্ত দাম ও ওজনে কম দেওয়ার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

সব মিলিয়ে, নলডাঙ্গার মাঠে শুরু হওয়া পেঁয়াজ–রসুনের এই মৌসুম কেবল চাষাবাদের গল্প নয়—এটি কৃষকের ঘাম, শ্রম আর টিকে থাকার লড়াইয়ের প্রতিচ্ছবি। মাঠে আশার চাষ চলছে ঠিকই, কিন্তু সার সিন্ডিকেটের বাস্তবতায় কৃষকের দীর্ঘশ্বাস যেন দিন দিন আরও গভীর হয়ে উঠছে।

Google News Icon

আমার দেশের খবর পেতে গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন

এলাকার খবর

খুঁজুন