শান্তিপ্রিয় ও ধর্মপ্রাণ মানুষের জেলা হিসেবে পরিচিত রাজশাহী। এ অঞ্চলের সহজ-সরল অধিবাসীদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল ফ্যাসিবাদী সরকার। আওয়ামী দুঃশাসনের সাড়ে পনের বছরে ৩০ জনকে তুলে নিয়ে অন্ধকার কুঠুরিতে আটকে রাখা হয়।
চলে নির্মম নির্যাতন। তাদের মধ্যে পাঁচজন এখনো বাড়ি ফিরতে পারেননি। এছাড়া ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে জনগণের কণ্ঠরোধ করেছিল পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সদস্যরা। তারা আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে মিলে জামায়াতে ইসলামী, বিএনপি ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের ২৬ নেতাকর্মীকে হত্যা করেছে। জঙ্গি নাটক করতে গিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় করে দিয়েছে পুরো একটি পরিবারকেই।
আওয়ামী অপশাসনের আরেকটি হাতিয়ার ছিল মিথ্যা ও গায়েবি মামলা। দেড় দশকে বিরোধী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে আট শতাধিক মামলা দেওয়া হয়েছিল। আসামি করা হয় বিএনপি ও জামায়াতের অন্তত সাড়ে পাঁচ হাজার নেতাকর্মীকে। ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে বহু সম্পদ, জমি ও ব্যবসা-বাণিজ্য। গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বসতবাড়ি। আহত করা হয়েছে দুই সহস্রাধিক নেতাকর্মীকে। ৫০ জনকে পঙ্গু করে দিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর আওয়ামী সদস্য এবং আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। এছাড়া গ্রেপ্তার, হয়রানি ও ভয়ভীতি দেখানো ছিল নিত্যদিনের চিত্র। বিএনপি-জামায়াতের কেউ শান্তিতে রাতে ঘুমাতেও পারেননি।
দলীয় সূত্রে পাওয়া হিসাব অনুযায়ী, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনে প্রধান বিরোধীদল বিএনপির ৭ নেতাকর্মী খুন হন এবং আহত হন সহস্রাধিক। জামায়াতের রাজশাহী মহানগরীতে নিহত হন ১৪ এবং জেলায় ৫ নেতাকর্মী। পুলিশ ও ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুলিতে আহত হয়েছেন অন্তত কয়েক হাজার, পঙ্গুত্ববরণ করেছেন অর্ধ শতাধিক নেতাকর্মী।
রাজনৈতিক মামলা
রাজশাহী মহানগর আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর আলী আশরাফ মাসুম বলেন, ফ্যাসিবাদের আমলে ৫ শতাধিক গায়েবি ও রাজনৈতিক মামলা হয়। এর অধিকাংশই কথিত নাশকতার অভিযোগে পুলিশ বাদী হয়ে করে। এছাড়া আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও অনেক মামলা করেন।
রাজশাহী জেলা আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর রইসুল ইসলাম বলেন, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সময় রাজশাহীর প্রায় দুই শতাধিক গায়েবি বা নাশকতার মামলা দায়ের হয়। এসবের অধিকাংশই প্রত্যাহার করা হয়েছে।
প্রধান টার্গেট ছিল জামায়াত-শিবির
ক্ষমতা নেওয়ার পর রাজশাহীতে আওয়ামী দমন-পীড়নের মূল লক্ষ্য ছিল জামায়াত ও শিবির নেতাকর্মী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) দখল ও স্থানীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাদের প্রধান বাধা হিসেবে নিয়ে চালায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ। এতে শুধু রাবিতে পাঁচ শিবির নেতাকর্মীকে খুন করে পুলিশ ও ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। তাদের প্রথম টার্গেট ছিলেন রাবি ছাত্রশিবিরের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শরিফুজ্জামান নোমানী। তাকে ২০০৯ সালের ১৩ মার্চ প্রকাশ্যে কুপিয়ে হত্যা করে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা।
রাবির শেখ মুজিবুর রহমান হল দখল নিতে ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ ক্যাডাররা ছাত্রশিবিরের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। তাদের প্রতিরোধ করলে বেধে যায় তুমুল সংঘর্ষ। এতে নিহত হন ছাত্রলীগ কর্মী ফারুক। পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মাজেদুল ইসলাম বাদী হয়ে শিবিরের ৩৫ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখ এবং অজ্ঞাত পরিচয়ের কয়েকশ জনের নামে নগরীর মতিহার থানায় মামলা করেন। শুরু হয় ব্যাপক ধরপাকড়, হয়রানি ও গুম। একপর্যায়ে এ মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয় জামায়াতের তৎকালীন আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, নায়েবে আমির আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, রাজশাহী মহানগর আমির আতাউর রহমান, রাবি ছাত্রশিবিরের সভাপতি শামসুল আলম গোলাপ, সেক্রেটারি মোবারক হোসেনসহ ১১০ জনকে।
মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে ওঠে গুম
আওয়ামী ফ্যাসিবাদের সাড়ে ১৫ বছরে শুধু রাজশাহীতে র্যাব ও পুলিশের হাতে ৩০ জনের অধিক বিএনপি-জামায়াত নেতাকর্মী গুমের শিকার হন। তাদের মধ্যে কয়েক জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে, কয়েকজনকে মিথ্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তবে ৫ জনকে এখনো ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। ফিরে আসা অনেকেই ভুগছেন মানসিক সমস্যায়। তাদের প্রায় সবার পক্ষে গুম কমিশনে অভিযোগও দেওয়া হয়েছে।
রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার কাঁঠালবাড়ি গ্রামের স্কুল শিক্ষক আবদুস সামাদ ও আবেদা বিবি দম্পতির ছেলে আবদুল কুদ্দুসকে ২০১৭ সালে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। সেই থেকে তার জন্য অপেক্ষায় আছেন এই দম্পতি। আবেদা বিবি বলেন, ‘আবদুল কুদ্দুসকে ফিরে পাওয়ার আশায় প্রতিদিন দরজার সামনে বসে থাকি। পুলিশ ওকে নিয়ে গেল, কিন্তু কোনো কাগজ দিল না, কোনো মামলাও হলো না। আটটি বছর চলে গেল, আর ফিরে এলো না, শুধু নীরবতা। সন্তানের জন্য চোখের পানি ফেলতে ফেলতে অন্ধ হয়ে গেছি। কাঁদার পানিও আর চোখে নেই। বুকের ধন কুদ্দুসের সঙ্গে কী হয়েছে কেউ কিছু জানালও না। মনটাকে বুঝ দেব কী দিয়ে?’
প্রায় একই সময়ে গুমের শিকার বিএনপি কর্মী মুরসালীনুর ইসলামের সন্তান রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থী সাইফুল ইসলাম সাগরের কাছে তার বাবার কথা জানতে চাইতেই দুই চোখ দিয়ে অশ্রুর নহর ছেড়ে দিলেন। দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বললেন, ‘চলতে ফিরতে একাকিত্ব সময়ে আমার বাবা এসে বলে, আমাকে এখনো বের করলি না তো তোরা, আমাকে বের কর। আমি বাবার সঙ্গে হাত ধরে স্কুলে যেতাম, প্রাইভেট পড়তে যেতাম। সেই বাবাকে ৮ বছর ধরে দেখি না, আমি বাবার বুকে মাথা গুঁজে কান্না করতে চাই। আমি রাতে ঘুমাতে পারি না, স্বপ্নেও বার বার আসেন এবং ডাকে যে, আমাকে খুঁজে নিয়ে আসবি না। আমি এ ধরনের স্বপ্নগুলোই দেখি।’
গুমের শিকার আরেক বিএনপি কর্মী আবদুল কুদ্দুসের স্ত্রী জামিলা আক্তার বলেন, আমার স্বামী জীবিত না মৃত, আমি বিধবা না সধবা, আমার সন্তানরা কি পিতৃহারা? আল্লাহর কাছে আমার স্বামীর জন্য কবরের আযাব থেকে মুক্তি চাইব, না সুস্থতার জন্য দোয়া চাইব? জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে গঠিত অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে এর সঠিক উত্তর চাই।
গোদাগাড়ী থেকে ২০১৬ সালে জামায়াত কর্মী ইসমাঈল হোসেনকে গুম করে নিয়ে যায় র্যাব-৫-এর তৎকালীন রেলওয়ে কলোনি ক্যাম্পের সদস্যরা। এরপর থেকে তার কোনো হদিস নেই। কোথায় আছে, কেমন আছে কেউ বলতে পারছে না।
গোদাগাড়ী মাটিকাটা ইউনিয়নের রেলগেট এলাকার আবদুর রাজ্জাক শামির র্যাব-৫ নাটোরে গুম করে প্রায় ৩ মাস রেখে শারীরিক নির্যাতন করার পর অবস্থার অবনতি হলে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে। কিছুদিন পরে তিনি মারা যান।
গোদাগাড়ী পৌর এলাকার বারুইপাড়া গ্রামের আমিনুল ইসলামকে ২০১৮ সালে ১২ মে র্যাব-৫ তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে উঠিয়ে নিয়ে তিন মাস ১৮ দিন গুম রাখে। পরে আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ ও ইসলামী বই দিয়ে মামলা দায়ের করে। ভুক্তভোগী আমিনুল আমার দেশ-কে বলেন, তার সঙ্গে আয়নাঘরে বন্দি ছিলেন মোশারফ হোসেন, সাইফুল ইসলাম, কামাল উদ্দিন, জাহাঙ্গীর আলম, ইসমাইল হোসেন, রফিকুল ইসলাম, আবদুল মতিন ও খাইরুল ইসলাম। তাদের মধ্যে সবাই ফিরে এলেও ইসমাইল নামে একজন মুক্তি পাননি। পরে তার সঙ্গে কী হয়েছে তা কেউ জানে না।
গুম-খুনের মাস্টারমাইন্ড ও সহযোগীরা
মহানগরসহ পুরো জেলায় একাই রাজত্ব করতে চেয়েছিলেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রাজশাহী সিটি করপোরেশনের (রাসিক) সাবেক মেয়র খায়রুজ্জামান লিটন। গণতান্ত্রিক পন্থায় তা সম্ভব না হওয়ায় তিনি বেছে নেন গুম-খুনের অপকৌশল। এর জন্য তিনি পাশে পান পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কিছু অসৎ ও দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাকে। তারা যৌথভাবে চালান ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি খুন-খারাবি হয়েছে ২০১৩ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে। এই সময়ে র্যাব ও পুলিশের হাতে অন্তত ৩০ নেতাকর্মী নিহত হন। এতে নেতৃত্ব দেওয়া র্যাব-পুলিশের ৬ কর্মকর্তা হলেনÑর্যাব-৫-এর তৎকালীন অধিনায়ক লে. কর্নেল আনোয়ার লতিফ খান, আরএমপির কমিশনার ডিআইজি এসএম মনির-উজ-জামান ও ডিআইজি মো. শামসুদ্দিন, ডিসি নাহিদ হোসেন, ডিবির ওসি আলমগীর হোসেন এবং ডিবির ওসি জিয়াউল হক। তারা বিরোধী মতের নেতাকর্মীদের জন্য রাজশাহীকে মৃত্যুপুরীতে পরিণত করেছিলেন।
ক্রসফায়ারের নামে হত্যার গল্প
২০১৩ সালের ২ মে ঢাকা থেকে শিবিরকর্মী শাহাদাত হোসেনকে আটক করে গুম করে র্যাব। এরপর তার হাত-পা ভেঙে ১২ মে গভীর রাতে চোখ বেঁধে রাজশাহী নগরীর বিনোদপুরের বেতার মাঠে ‘বন্দুকযুদ্ধে’র নাটক সাজিয়ে গুলি করে হত্যা করে। শাহাদাতের স্ত্রী রিনা খাতুন বলেন, ‘শাহাদাতকে আটকের পর নির্মমভাবে নির্যাতন করে র্যাব। তার দুই হাত কেবল মাংসের সঙ্গে ঝুলছিল। তার পায়ের হাড় কুচি কুচি করে দেওয়া হয়েছিল। শরীরের বিভিন্ন অংশে কোপানো হয়েছিল। দুই হাত ও দুই চোখ বেঁধে বেতার মাঠে তাকে হত্যা করে বন্দুকযুদ্ধের নাটক সাজায় র্যাব।’
এর আগে ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি রাজশাহী নগরীর বিনোদপুর ইসলামিয়া কলেজের শিক্ষক ও জামায়াত কর্মী নুরুল ইসলাম শাহীনকে নগরীর মালোপাড়ার নিজস্ব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়। পরদিন নগরীর আশরাফের মোড় এলাকায় তার গুলিবিদ্ধ লাশ পাওয়া যায়। নিহতের ছোট ভাই ড. ফজলুল হক তুহিন বলেন, তৎকালীন সিটি মেয়র লিটনের নির্দেশে আমার ভাইকে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় জড়িত ছিলেন তৎকালীন আরএমপি কমিশনার শামসুদ্দিন ও ডিবি পুলিশের কয়েক কর্মকর্তা।
২০১৫ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের তথ্য সম্পাদক মোহাম্মাদ শাহাবুদ্দিনকে গুলি করে হত্যা করে পুলিশ। আগের দিন ৫ ফেব্রুয়ারি কাটাখালী পৌর এলাকায় সড়ক থেকে পুলিশ শাহাবুদ্দিনসহ তিনজনকে তুলে নেয়। পরে গভীর রাতে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে অমানুষিক নির্যাতনের পর তাদের গুলি করে পুলিশ। তাদের মধ্যে শাহাবুদ্দিনকে মৃত অবস্থায় এবং অপর দুই শিবিরকর্মী হাবিবুর রহমান এবং মফিজুল ইসলামকে পায়ে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
২০১৫ সালের ১৩ এপ্রিল পুলিশের গুলিতে নিহত হন শিবিরকর্মী শহিদুল ইসলাম। তার বাড়ি নগরীর ভাঁড়ালিপাড়ায়। খড়খড়ি বাইপাস সড়কের বড়বনগ্রাম এলাকায় তার গুলিবিদ্ধ লাশ পড়েছিল। এর কয়েকদিন আগে পুলিশ শহিদুলকে তুলে নিয়েছিল। পরিবারের অভিযোগ, তৎকালীন আরএমপি কমিশনার শামসুদ্দিনের পরিকল্পনায় এ হত্যাকাণ্ড হয়।
আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে ফাঁসির রায় দেওয়ায় ২০১৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ৬ মার্চ টানা সাত দিন সাধারণ মানুষের প্রতিবাদে অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল পুরো দেশ। সে সময় বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), পুলিশ ও র্যাব মিলে যৌথবাহিনী গঠন করে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, নির্যাতন-নিপীড়ন চালায়। এতে রাজশাহীতে তিন জামায়াত ও শিবির নেতাকর্মীকে খুন করা হয়। নির্যাতন করা হয় পাঁচ শতাধিক, পঙ্গু করে দেয় অন্তত দশ জনকে। তখন পুলিশের গুলিতে নিহত হন গোদাগাড়ীর মহিশালবাড়ি কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন মোজাহিদ এবং গোদাগাড়ী পৌর এলাকার গোলাম মোস্তফার ছেলে রফিকুল।
জঙ্গি নাটকে পরিবার ধ্বংস
২০১৭ সালের ১১ মে ভোরে সোয়াহেব ওরফে আশরাফুল নামে যুবককে ধরে আনে বগুড়া পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। তাকে গোদাগাড়ী উপজেলার মাটিকাটা ইউনিয়নে বেনীপুর এলাকায় সাজ্জাদ হোসেনের বাড়িতে নিয়ে জঙ্গি নাটক সাজানো হয়। এই নাটক মঞ্চস্থ করতে ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ ৬ জনকে হত্যা করা হয়।
প্রথমে গোদাগাড়ী সাব-স্টেশনের ফায়ার সার্ভিস কর্মী আবদুল মতিনকে গুরুতর আহত করে জঙ্গি নাটক সাজানো হয়। পরে তিনি হাসপাতালে মারা যান। নিহতের স্বজনদের অভিযোগ, পিআইবি সদস্যরাই মতিনকে শাবল দিয়ে খুঁচিয়ে আধমরা করেন। কারণ, তিনি বাহিনীতে বিএনপিপন্থি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিলেন। এছাড়া নিরীহ ও অত্যন্ত সহজ-সরল কর্মচারী হওয়ায় আওয়ামীপন্থিদের রোষানলে পড়েছিলেন তিনি।
মতিন হত্যার দায় সাজ্জাদের পরিবারের ওপর চাপিয়ে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয় পাঁচজনকে। তারা হলেনÑসাজ্জাদ, তার স্ত্রী বেলী বেগম, ছেলে আল আমিন ও মেয়ে কারিমা খাতুন এবং বগুড়ার আশরাফুল।
এছাড়া গোদাগাড়ী পৌর এলাকার মহিশালবাড়ি মহল্লার গোলাম কিবরিয়ার ছেলে নাইমুল, গোদাগাড়ী পশু হাসপাতালের মোড়ের আবদুস সালামের ছেলে পিয়ারুল, গোদাগাড়ী পৌর এলাকার মহিশালবাড়ি মহল্লার আবদুস সালামের ছেলে হাসান আলীকে তুলে নিয়ে জঙ্গি নাটক সাজিয়ে বিভিন্ন ধরনের বিস্ফোরক দ্রব্য উদ্ধার দেখিয়ে মামলা দেওয়া হয়।
ভূমি দখল
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আওয়ামী দুঃশাসনের প্রায় গোটা সময় বিশেষ করে ২০১৪ সালে নির্বাচনের পর রাজশাহী নগরীর ৩০টি ওয়ার্ডসহ জেলার কিছু জায়গায় পলাতক মেয়র লিটন, আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল আউয়াল এবং নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার ভূমিদস্যুতায় ঝাঁপিয়ে পড়েন। বিবদমান কোনো জমির সন্ধান পেলেই তাদের কুদৃষ্টি পড়ত। কখনো নিজেরাই দখল করেন, আবার কখনো দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দেওয়ার নামে মোটা অংকের টাকা আদায় করেন। এছাড়া কেউ জমি বিক্রি করতে গেলেই তারা কমিশন আদায় করতেন। তাদের পাশাপাশি দখলদারিত্বের মাধ্যমে বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের পলাতক সাবেক এমপি আয়েনউদ্দিন ও রাজশাহী-৪ বাগমারা আসনের এমপি ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক।
রাজশাহী জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বিশ্বনাথ সরকার আমার দেশকে বলেন, আওয়ামী লীগ ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের পর আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। যেহেতু ক্ষমতায় টিকে থাকতে তাদের আর ভোটের প্রয়োজন ছিল না, তাই বিরোধীদের ওপর যত ধরনের নিপীড়ন-নির্যাতন করা সম্ভব, সবই তারা করেছে।
রাজশাহী মহানগর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি অধ্যাপক শাহাদৎ হোসেন বলেন, রাসিক মেয়র লিটন সিটি করপোরেশনের ভেতরে টর্চার সেল এবং অস্ত্রের গুদাম বানিয়েছিলেন। সেখান থেকেই নির্দেশনা দেওয়া হতো কার উপর কখন নির্যাতন বা নিপীড়ন করতে হবে।
তিনি আরো বলেন, প্রতিপক্ষকে দুর্বল করতে লিটন আমাদের নেতাকর্মীদের হত্যা, গুম, পঙ্গু করেছেন। আওয়ামী দুঃশাসনের প্রায় গোটা সময় জামায়াতের মহানগর, ওয়ার্ড থেকে শুরু করে জেলা পর্যায়ের ইউনিয়ন পর্যন্ত সব কার্যালয় বন্ধ করে দেয় পুলিশ ও আওয়ামী সন্ত্রাসীরা। তাদের চোখ এড়িয়ে গোপনে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে হয়েছে। খবর পেলেই পুলিশ হানা দিয়ে ‘নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগ’ এনে আটকের পর মামলা দিত।
অধ্যাপক শাহাদৎ বলেন, বিগত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দুঃশাসনে রাজশাহী নগরীতে সবচেয়ে বেশি শহীদ হতে হয়েছে জামায়াত ও ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীকে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজশাহী মহানগরীতে ১২ জন শহীদ হয়েছেন। তারা হলেন, শরিফুজ্জামান নোমানী, হাফিজুর রহমান শাহীন, ওমর শাহাদত, রাশিদুল হক রিন্টু, নুরুল ইসলাম শাহীন, সাফিকুল ইসলাম, শফিকুল ইসলাম, শাহাবুদ্দিন, আলী রায়হান, হাফিজুল রহমান, হাফেজ রশিদুল ইসলাম ও আবু রায়হান। তাদের মধ্যে ৫ জনই রাবি শিক্ষার্থী ও শিবিরের নেতাকর্মী। তাদের তুলে নিয়ে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সর্বশেষ জুলাই বিপ্লবের দিন ৫ আগস্ট ছাত্রশিবিরের কর্মী শহীদ সাকিব আনজুম এবং ৮ আগস্ট শহীদ হয়েছেন ছাত্রশিবিরের রাজশাহী মহানগর শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক আলী রায়হান।
জামায়াতের জেলার সাধারণ সম্পাদক গোলাম মুর্তূজা বলেন, তিনি নিজেও দীর্ঘ ১৮ মাস গুম হয়ে আয়নাঘরে অসহনীয় নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তিনি বলেন, দুঃশাসনের এই অধ্যায় শেষ হলেও ভুক্তভোগীদের ক্ষত আজও শুকায়নি। ইতিহাসের পাতায় সময়টিকে মনে রাখা হবে এক অন্ধকার, ভয়ের এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের যুগ হিসেবে। সাড়ে ১৫ বছরে রাজশাহী জেলা জামায়াতের ৫ নেতা-কর্মী শহীদ হয়েছেন। তারা হলেন, হাফেজ আমিরুল ইসলাম, মুজাহিদুল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম, হাফেজ রাশিদুল ইসলাম, আবদুল্লাহ ওমর নাফিস শাহাদাত, এছাড়া গত ১৫ বছরে জামায়াত ও শিবিরের নেতাকর্মীদের নামে ২১০টি মামলা দেওয়া হয়েছে। যেখানে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার নেতাকর্মীর নাম আছে। এছাড়া অজ্ঞাত আসামি আছে দেড় হাজারের বেশি।
বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু আমার দেশকে বলেন, হাসিনার সাড়ে ১৫ বছরে রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের হাতে বিএনপির সাত নেতাকর্মী হত্যার শিকার হয়েছেন। আওয়ামী ক্যাডার ও প্রশাসনের অতিউৎসাহী কর্মকর্তারা বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন-নিপীড়ন করেছে। টার্গেট করে হত্যা এবং পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া নির্যাতনে শিকার হয়েছে প্রায় পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী। আমাকেসহ বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির ত্রাণ ও পুনর্বাসনবিষয়ক সহ-সম্পাদক অ্যাডভোকেট শফিকুল হক মিলন, বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির বন ও পরিবেশবিষয়ক সম্পাদক সাবেক মেয়র মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুলকে কয়েকবার জখম করা হয়েছে।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ও রাজশাহী মহানগরীর আমির ড. মাওলানা কেরামত আলী বলেন, ‘সাড়ে ১৫ বছরের ফ্যাসিস্ট রেজিম ছিল অত্যাচারী শাসকের আমল। সবচেয়ে বেশি জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন জামায়াত ও ছাত্রশিবির নেতাকর্মীরা। আমরা কোনো প্রতিবাদও করতে পারিনি। এমনকি কেউ মারা গেলে জানাজার নামাজটাও পড়তে দেওয়া হয়নি। আমাদের লোকজন যে কান্না করবে সেই স্বাধীনতাটুকুও ছিল না।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজশাহী মহানগরী ও জেলায় ১৯ জন শহীদ হয়েছেন। তাদের সবাইকে তুলে নিয়ে কুপিয়ে ও গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত ছিল পুলিশসহ আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ। যারা শহীদ হয়েছেন সেই পরিবারগুলোকে জামায়াতের পক্ষ থেকে সার্বিক সহযোগিতা করা হচ্ছে।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন গোদাগাড়ীর প্রতিনিধি সাইফুল ইসলাম]

