গজলডোবার সব গেট খুললো ভারত, নির্ঘুম রাত তিস্তাপাড়ের লাখো মানুষের

হাসান উল আজিজ, লালমনিরহাট
প্রকাশ : ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ১২: ২৭
আপডেট : ০৬ অক্টোবর ২০২৫, ১৬: ৩৭

কোনো রকম আগাম তথ্য না দিয়ে ভারত নিয়ন্ত্রিত গজলডোবা ব্যারাজের সবগুলো গেট খুলে দিয়েছে ভারত। তিস্তা ব্যারাজ কন্ট্রোল রূম ও বন্যা সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, এই বিপুল পরিমাণ পানি ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে আগে থেকে কিছুই জানা ছিলো না। পানি আগ্রাসী ভারত বরাবরই বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে অমানবিক আচরণ করে চলেছে।

বিজ্ঞাপন

ভাটির প্রতিবেশী বাংলাদেশকে শুষ্ক মৌসুমে শুকিয়ে মারে ভারত। আর নদ-নদী প্লাবিত হলে নিজেদের বন্যামুক্ত রাখতে অকাতরে পানি ছেড়ে ভাসিয়ে দেয় তিস্তাপাড়ের লাখ লাখ মানুষকে।

রোববার সন্ধায় ভারত বিনা নোটিশে উজানে গজলডোবা বাঁধের সবকটি গেট খুলে পানি ছেড়ে দিয়েছে। উজানে সিকিম, দার্জিলিং, জলপাইগুড়িসহ ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ব্যাপক বৃষ্টিপাতের ফলে তিস্তা ব্যারেজের ৮৫ কিলোমিটার উজানে গজলডোবা ব্যারেজ খুলে দেওয়ায় হঠাৎ এই ঢল নামে তিস্তায়।

রোববার সন্ধ্যা ৬টায় তিস্তার ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টে পানিপ্রবাহ বাড়তে শুরু করে। রেকর্ড করা হয় ৫২.২৫ মিটার। যা বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার ওপরে। রাত ৯টায় বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে। রাত ১২টায় পানিপ্রবাহ আবারো বেড়ে দাঁড়ায় ৫২ দশমিক ৫০ মিটারে। যা বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটারের ওপরে।

ডালিয়া ডিভিশনের নির্বাহী প্রকৌশলী অমিতাভ চৌধুরী বলেন, রোববার রাত ১২টায় তিস্তার পানি ডালিয়া ব্যারেজ পয়েন্টে পানি বিপদসীমার ৩৬ সেন্টিমিটার ওপরে, রাত ১০টা যা ছিল ৩০, ৮টায় ২৯, ৯টায় ৩৩ এবং সন্ধ্যা ৬টায় ১০ সেন্টিমিটার উপরে। সোমবার (৬ অক্টোবর) সকাল ৬টায় তিস্তার পানি ডালিয়া পয়েন্টে বিপদসীমার ১০ সেন্টিমিটার উপর দিযে প্রবাহিত হচ্ছে।

এরইমধ্যে পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রাম, শ্রীরামপুর, পাটগ্রাম পৌরসভা, হাতীবান্ধার সানিয়াজান, গড্ডিমারী, ডাউয়াবাড়ী, সিঙ্গীমারী, পাটিকাপাড়া, সিন্দুর্না, কালীগঞ্জের কাকিনা, তুষভান্ডার, চন্দ্রপুর, আদিতমারীর মহিষখোচা, দুর্গাপুর, পলাশী, লালমনিরহাট সদর উপজেলার গোকুন্ডা, রাজপুর, মোঘলহাট, কুলাঘাট ও খুনিয়াগাছ ইউনিয়নে পানি ঢুকে পড়েছে। পানি নিচে ডুবে গেছে কয়েক হাজার হেক্টর জমির ফসল বিনষ্ট হয়েছে সবজি ও মরিচ ক্ষেত। বন্যার পানিতে ভেসে গেছে কয়েক হাজার পুকুরের মাছ।

এদিকে তিস্তার পানি নিয়ন্ত্রণে রাখতে লালমনিরহাটের হাতিবান্ধায় তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি জলকপাট ২৪ ঘণ্টা খুলে রাখা হয়েছে। তারপরও পানি পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না পাউবো কর্তৃপক্ষ।

তিস্তা নদী সংলগ্ন গড্ডিমারী গ্রামের সাবেক স্কুল শিক্ষক শহিদার রহমান বলেন, গজলডোবা ব্যারাজ বাংলাদেশের মানুষের জন্য বিষফোঁড়া। কারণ এটি তিস্তা নদীর পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। যার ফলে বাংলাদেশে শুষ্ক মৌসুমে দেখা দেয় পানি সঙ্কট। বর্ষা মৌসুমী ব্যারেজ থেকে হঠাৎ করে বিপুল পরিমাণ পানি ছাড়ার কারণে বাংলাদেশে বন্যা ও প্লাবনের শিকার হয়। যা জনজীবনের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটা বাংলাদেশের মানুষের প্রতি অমানবিক আচরণ করছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। যা কোনভাবেই কাম্য নয়।

দহগ্রামের বাসিন্দা মালেকা বেগম বলেন,রাস্তাঘাট ডুবে গেছে, আমাদের পুকুরের মাছ ভেসে গেছে। কারন উজানের ঢল এখন ভাটিতে এসেছে। গতরাতে পানি বাড়িতে ঢুকে গেছে, সারারাত গরু-ছাগল নিয়ে জেগে ছিলাম! আমাদের মতো অনেকেই নির্ঘুম রাত কাটিয়েছে । অনেক কষ্টে আছি। ভারত পানি ছাড়িয়া হামারগুলার তামাশা দেখে বাহে।

আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের গোবরধন গ্রামের বিলকিছ বেগম বলেন, ভারত পানি ছেড়ে দিযেছে খবর পেয়ে রোববার রাতেই স্বামী, সন্তান,গরু- ছাগল নিয়ে পাশের গ্রাম সদারপাড়ায় বোনের বাড়ীতে আশ্রয় নিযেছি।

লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. শায়খুল আরিফিন বলেন, তিস্তা তীরবর্তী এলাকায় এখন রোপা আমন, চিনাবাদাম ও সবজির চাষ চলছে। পানি যদি তিন থেকে চার দিন স্থায়ী হয়, তাহলে কৃষকদের ব্যাপক ক্ষতি হবে। তবে এক থেকে দুই দিনের মধ্যে পানি নেমে গেলে ক্ষতি তুলনামূলক কম হবে।

লালমনিরহাট পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী শুনীল কুমার বলেন, আমরা পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছি এবং নদীপাড়ের বাসিন্দাদের সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়ে মাইকিং করা হয়েছে।

লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক এইচ এম রকিব হায়দার বলেন, উজান আর বাংলাদেশের কয়েকদিনের ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে তিস্তা নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করেছে। বন্যা মোকাবিলায় জেলা প্রশাসনের সকল প্রস্তুতি রয়েছে।

এলাকার খবর
খুঁজুন

সম্পর্কিত